সেনাসমর্থিত সরকার একপর্যায়ে দুই নেত্রীকেই মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। মুক্তি দেয়ার আগে তারা দুই নেত্রীর সঙ্গেই আলাদাভাবে আলোচনা করে। বলা যায়, সেনাসমর্থিত সরকারের অপরিণামদর্শিতার কারণে কার্যত দুই নেত্রী আরও শক্তিশালী হয়েই রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন করেন। এই সময়ে সেনাবাহিনী প্রধান মইন ইউ আহমেদ খালেদা জিয়ার সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করেন; কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার অনমনীয় মনোভাবের কারণে তা সম্ভব হয়নি।
মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামান সদ্য প্রকাশিত ‘ফাঁসির সেল থেকে দেখা বাংলাদেশ’ শীর্ষক বইতে এসব কথা লিখেছেন।
তিনি লিখেছেন, আমরা কেউ কেউ চেয়েছিলাম যে, এই বৈঠকটি হওয়া উচিত। আমরা অনুভব করেছিলাম, সেনাবাহিনীর সঙ্গে হয়তো-বা আওয়ামী লীগের একটি সমঝোতা হয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত সেনাবাহিনীর ভেতর থেকে মইন ইউ আহমেদ একটা চাপের কারণেই খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করতে চেয়েছিলেন। এ বৈঠক হলেও তা আদৌ কোনো ফলদায়ক হতো নাকি একটি লোক দেখানো ব্যাপার ছিল, তা বলা মুশকিল। ওদিকে মইন ইউ আহমেদের ছয়দিনের ভারত সফরে বিপুল সংবর্ধনা এবং সেটা যে একটি বড় ধরনের মিশন ছিল বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য, সে বার্তাও আমরা পাচ্ছিলাম। ভারতীয় নেতৃবৃন্দ যেভাবে মইন ইউ আহমেদকে রেড কার্পেট সংবর্ধনা দিয়েছেন তা নজিরবিহীন। আমরা বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারি, ভারত সফরকালে কতিপয় বিষয়ে মইন ইউ আহমেদের সঙ্গে সেখানকার সংশ্লিষ্টদের একটি চুক্তি হয়। এ চুক্তির প্রধান শর্ত ছিল- আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে সহায়তা করা। দ্বিতীয় শর্ত ছিল- বাংলাদেশে ইসলামী শক্তির উত্থান রোধ করতে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা এবং তথাকথিত যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করা। বিনিময়ে মইন ইউ আহমেদকে রাষ্ট্রপতি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ভারত।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের যে আয়োজন করা হচ্ছিল, সেটা ছিল মূলত শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসানোর একটি নীলনকশা। ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী শক্তিকে খতম করে ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদারদের ক্ষমতায় বসানোর এ সাজানো নির্বাচনের পেছনে পশ্চিমাশক্তি ও ভারত একযোগে কাজ করেছে। যেকোনো কারণেই হোক, বিএনপি বিশেষ করে পশ্চিমা শক্তির আস্থা হারিয়েছিল এবং বিএনপিকে তারা পুনরায় ক্ষমতায় দেখতে চায়নি।
নবম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি যে ক্ষমতায় ফিরতে পারবে না এবং বিএনপিকে পার্লামেন্টে একটি নগণ্য দলে পরিণত করে সংবিধান সংশোধন করার মতো দুই-তৃতীয়াংশ আসনে ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগকে জিতিয়ে আনার জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন, তার সব পদক্ষেপই নেয়া হয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়ার কাছে এ খবর ছিল যে, কোনোমতেই নির্বাচনে বিএনপিকে ভালো করতে দেয়া হবে না এবং ৩০-৪০টি আসন দেয়া হবে। তিনি চারদলীয় জোটের এক বৈঠকে এ ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে এ কথা বলেছিলেন। তিনি নির্বাচনে যেতে চাননি। আবার তিনি নির্বাচনবিরোধী এমন দায়দায়িত্বও নিতে দ্বিধান্বিত ছিলেন।
জামায়াত নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে ছিল। জামায়াতের সিদ্ধান্ত ছিল- জামায়াত নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে, যদি বিএনপিকে সঙ্গে নেয়া যায়। নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে জামায়াতের শক্ত অবস্থান দেখার পরও তিনি বলেছিলেন- ‘দেখুন, এটা নীলনকশার নির্বাচন। তারা বিএনপিকে হয়তো কয়েকটা আসন দিবে এবং জামায়াতকে একটি আসনেও বিজয়ী হতে দেবে না।’ যাহোক, বেগম খালেদা জিয়ার ধারণা ছিল- জামায়াত বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচনে চলে যেতে পারে। মনে করা হয়, শেষপর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়া এসব বিবেচনা করেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ কারণে বিএনপি’র পক্ষ থেকে জামায়াতকে দোষারোপ করা হয়ে থাকে। তবে ডিজিএফআইয়ের এটা সাফল্য যে, বিএনপি ও জামায়াতকে নীলনকশার নির্বাচনে নিতে পেরেছে।
দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে এ নির্বাচনে অংশ নেয়ার ফলে হাসিনা-এরশাদ-মইন ইউ আঁতাতের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন সহজ হয়ে যায়। ফখরুদ্দীন-মইন ইউ আহমেদ তাদের তথাকথিত দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আয়ু দীর্ঘায়িত করতে না পারলেও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর পরিকল্পনায় শতভাগ সফল হন। এভাবে ত্রিমুখী ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়াটা ছিল বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের জন্য এক ঘন ঘোর অশনিসংকেত।
নির্বাচনটা ছিল বিএনপি বনাম আওয়ামী লীগ। অন্য কথায় চারদলীয় জোট বনাম মহাজোট। আসন বণ্টনে আওয়ামী লীগ যথেষ্ট উদারতার পরিচয় দিয়ে শরিকদের দাবি অনুযায়ী অনেক আসন ছেড়ে দেয়। পক্ষান্তরে বিএনপি শরিকদের আসন ছেড়ে দেয়ার ক্ষেত্রে কৃপণতার পরিচয় দেয়।
কামারুজ্জামান আরও লিখেছেন, তাছাড়া প্রার্থী মনোয়নে বিএনপি’র যে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত ছিল, তা হয়নি। ক্ষমতায় থাকার কারণে যেসব মন্ত্রী বা এমপির বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগ ছিল, তাদের মনোনয়ন না দিয়ে সেসব আসনে নতুন মুখের ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত নেয়া রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির পরিচায়ক হতো; কিন্তু তা করা হয়নি। অথচ আওয়ামী লীগ কিন্তু এ ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ককতার পরিচয় দিয়েছিল।
প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে। কিন্তু বিএনপি’র নির্বাচনী অভিযানে ফখরুদ্দীন-মইন ইউ আহমেদের সমালোচনাই প্রাধান্য পায়। ফলে আওয়ামী লীগের জন্য সুবিধা হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এলে যে গণতন্ত্রের সংকট হবে এ বিষয়টি আড়ালে চলে যায়। আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট চরিত্র জনগণের দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। একদলীয় শাসন, বাকশাল, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিশেষ দেশের প্রতি আনুগত্য, সংবাদপত্র দলন, জনগণের অধিকার হরণ-এসব বিষয়ে প্রচারাভিযানে জোর দেয়ার পরিবর্তে ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নানা ব্যর্থতা এবং সেনাপ্রধান তথা সেনাবাহিনীর ভূমিকার সমালোচনা প্রাধান্য পায়। এই প্রচারাভিযানের ফলে মইন ইউ আহমেদরা সশস্ত্র বাহিনীকে বুঝাতে সক্ষম হয় যে, বিএনপি ক্ষমতায় এলে জরুরি আইন জারি এবং দুই বছর অবৈধ ক্ষমতায় থাকার জন্য তাদের বিচার হবে। ফলে নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই তারা নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করার সিদ্ধান্ত নেয়। নির্বাচনী প্রচার কৌশলের এই মারাত্মক ভুলের কারণে বিপুল জনমত বিএনপি’র পক্ষে থাকা সত্ত্বেও সেনাপ্রশাসন নির্বাচনকে প্রভাবিত করে এবং তাদের নীলনকশা বাস্তবায়ন করে।