ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের (সোয়াস) অর্থনীতির অধ্যাপক মুশতাক খান। সোয়াস—অ্যান্টিকরাপশন এভিডেন্স (এসিই) রিসার্চ কনসোর্টিয়ামের নির্বাহী পরিচালক হিসেবেও কাজ করছেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশা, রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা, ভূরাজনীতি—এসব নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ওয়ালিউর রহমান
প্রথম আলো: দেশে একটা গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে, অনেকে একে বিপ্লব বলছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার নিয়ে কথা হচ্ছে। রাষ্ট্র সংস্কার, রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এ দেশে একধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা চলেছে। যেসব দাবি উঠছে, সেগুলোকে কতটা বাস্তবসম্মত মনে হচ্ছে?
মুশতাক খান: জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে যা হয়েছে, তা একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন। যে রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থার পতন হলো, তা একধরনের স্বৈরাচারী, কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা ছিল। এর ভিত্তিই ছিল বিরোধী সব সংগঠন, সেটা ব্যাংকই হোক, কোম্পানি বা রাজনৈতিক দল হোক—এগুলো ভেঙে ফেলা, দুর্বল করা এবং ভেতর থেকে চূর্ণ করে দেওয়া। আর জনগণের মধ্যে একটা ভয় ছড়িয়ে দেওয়া যে আমার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে গায়েব হয়ে যাবে। ছাত্রদের আন্দোলন যখন গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হলো, এটা উৎখাত হলো। এই সাফল্যের কারণ এর কোনো সংগঠিত ভিত্তি ছিল না। আওয়ামী লীগ চেষ্টা করেছিল গোলাগুলি করে ভয়টাকে পুনরুৎপাদিত করতে, কিন্তু তারা ব্যর্থ হলো।
যে শক্তি সরকারব্যবস্থাকে চূর্ণ করল, সেটি অসংগঠিত রাস্তার শক্তি। এরা কিন্তু আজীবন রাস্তায় থাকতে পারবে না। এখন আমাদের অর্জনগুলো বাস্তবমুখী করতে হলে নিয়মকানুনের মধ্যে আসতে হবে। পাশাপাশি সেই নিয়মগুলোকে কার্যকর ও সমর্থন করার মতো সংগঠন তৈরি করতে হবে। আমাদের ভালো নিয়মকানুন আছে। কিন্তু যারা ক্ষমতাশালী সংগঠন বা সংস্থা, তারা যদি এই নিয়মকানুন মানতে না চায় এবং তাদের ঠেকানোর মতো যদি কোনো পাল্টা সংগঠন না থাকে, তাহলে আইন যা–ই থাকুক, তা কার্যকর হবে না। আমাদের সেই পাল্টা শক্তি নেই। আওয়ামী লীগ সব পাল্টা শক্তি ভেঙে দিয়েছিল। সমাজে যেসব দাবি উঠছে বা যেসব অর্জন আমাদের হয়েছে, তা টেকসই করার জন্য এখন দরকার পলিটিক্যাল সেটেলমেন্ট।
প্রথম আলো: এই রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কীভাবে কাজ করবে? আমাদের দেশে বিভিন্ন শক্তি আছে, স্বার্থ আছে। রাজনীতির ভিন্নতা আছে। সে ক্ষেত্রে এই রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কীভাবে হতে পারে?
মুশতাক খান: আমি যেভাবে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত দেখি, তা হচ্ছে সমাজের মধ্যে বিভিন্ন সংগঠিত শক্তি ও নিয়মকানুন। এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় বা সামঞ্জস্য থাকতে হবে। রাজনৈতিক বন্দোবস্তের বিশ্লেষণ আমি ১৯৮০–এর দশকে প্রবর্তন করি। একটা দেশে কোন আইন কার্যকর হবে এবং সমাজে কী ধরনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে, তা বোঝার জন্য সমান্তরালভাবে দেখতে হবে দেশটিতে সংগঠিত সংগঠনগুলো কারা। আমরা বাংলায় সব কটিকে প্রতিষ্ঠান বলি। আমাদের ইনস্টিটিউশন ও অর্গানাইজেশনকে আলাদাভাবে দেখতে হবে। রুলস অব দ্য গেম হলো ইনস্টিটিউশন। অন্যদিকে অর্গানাইজেশন হচ্ছে সংস্থা—রাজনৈতিক দল, ইউনিভার্সিটি, কোম্পানি কিংবা একটা ব্যাংক। নিয়মকানুন এসব সংস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু যারা বা যে সংস্থা ক্ষমতাসীন, তারা নিয়ম মানতে চায় না। যারা ক্ষমতাবান, তারা পুলিশ কিনে নেবে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা কিনে নেবে, নির্বাচন কমিশন কিনে নেবে। কিনতে না পারলে ভয় দেখাবে। আপনাকে যা করতে হবে, সমান্তরাল কিছু সংগঠন তৈরি করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলছি, কেবল একটা কোম্পানি পণ্য আমদানি করবে, এমন নয়। একসঙ্গে যদি ৫০টি কোম্পানি পণ্য আমদানি করে, তাহলে একজন আইন না মানলে অন্যরা প্রতিবাদ করবে।
গত ১৫ বছরের আওয়ামী দুঃশাসন আমাদের সব সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান ভেঙে ফেলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়, ট্রেড ইউনিয়ন, কোম্পানি, ব্যাংক—কিছুই অবশিষ্ট নেই। সুতরাং আপনি এখন যত সুন্দর আইনই করেন না কেন, তা কাজ করবে না। তবে হতাশ হলে চলবে না। আমাদের একদিকে নিয়ন্ত্রণ জোরদার করতে হবে, অন্যদিকে সংগঠনও তৈরি করতে হবে। তবে খুব দ্রুত সবকিছু কাজ করবে না। কোনো কোনো সংগঠন দ্রুত তৈরি করা যাবে, কোনো কোনোটি তৈরি করতে পাঁচ-ছয় বছর লেগে যাবে। রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রায়োগিক দিক এটাই। কালকেই যদি আমরা নরওয়ের মতো দেশ হতে চাই, তাহলে সব ধসে যাবে। তখন পুরোনো শক্তি বলবে, দেখো ওরা পারে না, আমরাই পারি। পলিটিক্যাল সেটেলমেন্ট হলো ক্ষমতার বিন্যাসের সঙ্গে আইনের সামঞ্জস্য। রাজনৈতিক বন্দোবস্ত মানে এই না যে সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে একটা রুমে আলোচনা করলাম যে কোনো বিষয়ে আমরা সবাই একমত।
প্রথম আলো: রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের সংবিধান নতুন করে লেখার দাবি উঠছে। বর্তমান সংবিধানের বেশ কিছু বিধিবিধান স্বৈরতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্রের জন্ম দেয়, এমন অভিযোগ আছে। সব ত্রুটিবিচ্যুতি দূর করে একটি নিখুঁত সংবিধান লেখার দাবি করছেন অনেকে। আমাদের সমাজ এর জন্য কতটা প্রস্তুত?
মুশতাক খান: আমাদের সংবিধান যে ত্রুটিপূর্ণ, তা নিয়ে বাংলাদেশের কোনো মানুষই সম্ভবত দ্বিমত করবে না। এখন আমি একটা সুন্দর সংবিধান লিখলাম। কিন্তু আমার সাংগঠনিক শক্তি নেই এটাকে কার্যকর করার। কিছু করার আগে আপনাকে এদিকে নজর দিতে হবে। নাগরিক সংগঠন, ব্যবসায়ী সংগঠন, রাজনৈতিক দল, ছাত্রসংগঠন—এসব সংগঠন যদি নিয়মের ব্যত্যয় করে, তাহলে একই রকম সংগঠন সেগুলোকে সংযত করতে পারবে কি না। সেটি নিশ্চিত করতে না পারলে কিন্তু আইনের কোনো মূল্য নেই।
প্রথম আলো: তাহলে কি সংবিধান পরিবর্তন করেই তা নিশ্চিত করতে হবে, নাকি নাগরিক শক্তি গড়ে তোলার দিকে আগে নজর দিতে হবে?
মুশতাক খান: এটা সমান্তরালভাবে করতে হবে। আমি নেপালের উদাহরণ দিই। গণ-আন্দোলনের পর সেখানে আদর্শিক ভিত্তিতে তৈরি নতুন সংবিধান গ্রহণ করা হলো। কাগজে-কলমে এটি বেশ ভালো ছিল। কেন্দ্রীয়, প্রাদেশিক ও স্থানীয় সরকারের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু পরে দেখা গেল, এই তিন স্তরে শক্তিগুলো যেভাবে সংগঠিত হয়েছে, তাতে তাদের মধ্যে সমন্বয় করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এখন তারা বলছে, এই সংবিধান আবার পরিবর্তন করতে হবে। থাইল্যান্ডে নতুন সংবিধান হয়েছে, কিন্তু আবার পরিবর্তন করতে হবে। সংবিধানে বাস্তব অবস্থাকে প্রতিফলিত করতে হবে। আগে আইন লিখে পরে বলবেন যে সমাজকে সেভাবে সাজাতে হবে, সেটা হয় না। আগে দেখতে হবে সমাজ কীভাবে সংগঠিত হচ্ছে, পরে সংবিধানকে তার সঙ্গে মেলাতে হবে। বর্তমান সংবিধানে কিছু বিষয় আছে, যা এটাকে অকার্যকর করে দেয়।
আমাদের এখানে কিছু ক্ষমতাশালী সংগঠন আছে, যারা আইন না মানলে তার কোনো ক্ষতি হয় না। একটা রাজনৈতিক দল টাকা ওঠাচ্ছে চোরাকারবারি, আদম ব্যবসায়ী কিংবা এস আলমের মতো টাকা পাচারকারী—এদের কাছ থেকে। ব্রিটেনে রাজনৈতিক দলগুলোকে কোম্পানি বা ট্রেড ইউনিয়ন যে টাকা দেয়, তা আসে আইনি উৎস থেকে। তারা চায় না এসব রাজনৈতিক দল এমন কাজ করুক, যা তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে সবাই আইন ভাঙতে চায়। কিন্তু কোনো কোম্পানি আইন না মানলে তাদের সঙ্গে কেউ কন্ট্রাক্টে বা চুক্তিতে যাবে না। পুরো ব্যবস্থাটাই কন্ট্রাক্টে চলে। এ দেশে দলেরও ক্ষতি হয় না, এস আলমেরও ক্ষতি হয় না। এরা শুধু ক্ষতির মুখে পড়ে এসব অভ্যুত্থানের সময়। এদের দৈনন্দিন কাজে বাধা আনতে হবে, কারণ অভ্যুত্থান প্রতিদিন হবে না। আমরা এখন যা-ই সংস্কার করি, সেটা ক্ষমতার সঙ্গে মিলিয়ে করতে হবে।
প্রথম আলো: আপনি সংস্কারের কথা বললেন। সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে এখন নানা রকমের সংস্কারের দাবি উঠছে। কখনো কখনো তা পরস্পরবিরোধীও মনে হয়। কিন্তু একটি অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে এসব সংস্কারের দাবি কতটা পূরণ করা সম্ভব হবে?
মুশতাক খান: ক্ষমতার যে উৎস, তা অসংগঠিত হতে পারে। কিন্তু তাঁরা রাস্তায় আছেন, একটি সত্যিকার শক্তি। এর ভিত্তিতে স্বল্পমেয়াদি কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার এখনই সম্ভব। দু–একটা উদাহরণ দিই। এখনই সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব পরিবর্তন করা সম্ভব। এটা না করতে পারলে আপনি আটকে যাবেন। দ্বিতীয়ত, যেসব লোক টাকা চুরি করে বিদেশে নিয়ে গেছেন—গভর্নর ও অর্থ উপদেষ্টা সে বিষয়ে কথাও বলেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এখনই সম্ভব। তাঁদের সব সম্পদ জব্দ করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক আইন ব্যবহার করতে হবে। আমি দুর্নীতিবিরোধী কাজে জড়িত, আমি জানি অনেক সংস্থা আছে, যাদের সহায়তা চাইলে তারা দৌড়ে চলে আসবে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা ইউরোপে বিভিন্ন রকম আইন আছে, সে কারণে ভিন্ন ভিন্নভাবে নথিপত্র তৈরি করতে হবে। আমরা যেসব বীভৎস চুক্তি করেছি বিদ্যুৎ কিংবা অন্যান্য খাতে, ১০ টাকার জিনিসের জন্য আমরা ইতিমধ্যে ১০০ টাকা দিয়ে দিয়েছি, এগুলো প্রকাশ করতে হবে। আদানির সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে, সে সম্পর্কে ভারতের লোকজনই বলছে, এটা অবিশ্বাস্য চুক্তি। অস্ট্রেলিয়া থেকে কয়লা নিয়ে যাচ্ছে ঝাড়খন্ডে, যেখানে কয়লা আছে। আগের সরকার গোপন চুক্তির মাধ্যমে নিজের লোকদের মাধ্যমে টাকা লুট করেছে এবং আইন পাস করছে যে এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। এই আইন এখনই বাতিল করা যায়, কারণ এটা বেআইনি। ক্ষমতার উৎস ভোট হতে পারে, আবার রাস্তা থেকেও আসতে পারে।
প্রথম আলো: পরাশক্তিগুলোর কাছ থেকে বাংলাদেশ বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে, যার একটি কারণ এর ভৌগোলিক অবস্থান বলে মনে করা হয়। সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের যে ভৌগোলিক অবস্থান, তার একটি ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব আছে। এই গুরুত্ব এখানে সরকার গঠনে কী ধরনের প্রভাব রাখে?
মুশতাক খান: কোন কোন দেশে কর্তৃত্ববাদী একনায়কতন্ত্র গড়ে ওঠে, তা বিবেচনায় নিলে দেখবেন এদের মধ্যে অনেক দেশে সরকারগুলো বড় অঙ্কের অর্থ সংগ্রহ করতে পারে। হয় তাদের তেল আছে বা কয়লা আছে বা গ্যাস আছে। আমাদের তা নেই, কিন্তু এখানে স্বৈরতন্ত্র আছে। গভীরে গেলে দেখা যায়, আমাদের একটি বিশাল সম্পদের সূত্র আছে। সেটা হলো ভৌগোলিক অবস্থান। বাংলাদেশ এমনই একটি কৌশলগত অবস্থানে যে অন্তত তিনটি দেশ এখানে প্রতিযোগিতা করছে—ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। যেহেতু তাদের স্বার্থ বিশাল, তারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করতে রাজি আছে। আওয়ামী লীগ সরকার তো বটেই, তার আগের সরকারগুলোও গোপন চুক্তি ও সমঝোতা করে ব্যক্তির পক্ষে অনেক সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে, যা জনসাধারণ জানেও না। সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীরা বলে যে আমি ভারতের প্রার্থী। এর মানে ভারত বিশাল বিনিয়োগ করেছে একটি গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় রাখার জন্য। এটাকে মোকাবিলা না করলে পরে যারা ক্ষমতায় আসবে, তারা চীন হোক, আমেরিকা হোক কিংবা ভারত হোক, তাদের সঙ্গে নিজেদের স্বার্থের জন্য গোপন সমঝোতা করবে। সে কারণে এখন দাবি তুলতে হবে, বাংলাদেশের সব বৈদেশিক চুক্তি স্বচ্ছ ও প্রকাশ্য হতে হবে। আপনি ভারতে দেখেন, যে-ই ক্ষমতায় আসুক তাদের পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন হয় না। কারণ, তা জনসম্মতির ওপর ভিত্তি করে হয়। আমি যদি সবার সম্মতির ভিত্তিতে বৈদেশিক চুক্তি করি, তাহলে ওই সব দেশও মনে করবে না যে বিশেষ একটি দলকে ক্ষমতায় রাখতেই হবে, না হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
প্রথম আলো: আমরা বাংলাদেশের ভূ-অর্থনীতির দিকে তাকাই। আমাদের রপ্তানিবাজার পশ্চিমে, কিন্তু বেশির ভাগ পণ্য আসে চীন আর ভারত থেকে। এই দুই দেশের ওপর নির্ভরশীলতা বেশ বেড়েছে। এখানে কি কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখেন?
মুশতাক খান: চীন বা ভারত যদি আমাদের সস্তায় জিনিস দেয়, আমি কিনব। আমি এসব দেশ থেকে পণ্য কিনছি, সেটা সমস্যা নয়। সমস্যা হচ্ছে গোপন কোনো চুক্তি বা ব্যবস্থা হচ্ছে কি না। আমি যদি খাওয়ার তেল ইন্দোনেশিয়া থেকে সস্তায় কিনতে পারি, সেখান থেকেই কিনব। আমি বিশেষ কোনো দেশের ওপর নির্ভরশীল হব না। প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি হুন্ডি, চোরাচালান, ইয়াবা, সোনার ব্যবসা—এগুলো বন্ধ করতে হবে। এগুলো ভারতের সঙ্গেই বেশি হচ্ছে।
প্রথম আলো: মসৃণ কোনো পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দেশে নতুন সরকার আসেনি। দীর্ঘদিন ধরেই এখানে অর্থনীতিতে সংকট চলছে। খরচের চাপে সাধারণ মানুষ কষ্টে আছে। কতটা জটিল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এই সরকারকে সামাল দিতে হবে?
মুশতাক খান: সাংঘাতিক জটিল পরিস্থিতি। বিশেষ করে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বড় অনিয়ম হয়েছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের একটা বড় পুঁজি আছে। সেটা হলো, তাদের সততা সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন নেই। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতো সংস্থায় পাশ্চাত্য দেশের প্রভাব আছে। সুতরাং অর্থনীতি ঠিক করার জন্য এসব সংস্থা থেকে সমর্থন পাওয়া যাবে বলেই আমার বিশ্বাস। এ সময়ে আমরা প্রয়োজনীয় সংস্কারকাজগুলো করতে পারি। আমরা যদি চুরি হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনতে পারি এবং এই টাকা দিয়ে ব্যাংকগুলোর পুঁজির ঘাটতি মেটাতে পারি, তাহলে ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থা ফিরে আসবে। প্রবাসীদের আমরা যদি হুন্ডিতে না পাঠিয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে বলি, আমি নিশ্চিত তাঁরা তা করবেন।
প্রথম আলো: বিশেষ ব্যবস্থায় বাঁচিয়ে রাখা না হলে বেশ কিছু ব্যাংক হয়তো এরই মধ্যে বন্ধই হয়ে যেত। সবচেয়ে বেশি খারাপ ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি। ব্যাংক খাত ঠিক করতে কী করতে হবে?
মুশতাক খান: এক–দুজন ব্যবসায়ীকে এতগুলো ব্যাংকের মালিকানা দেওয়া হয়েছে, এটা সম্পূর্ণ বেআইনি। সীমাহীনভাবে এঁদের ঋণ নিতে দেওয়া হয়েছে জামানত ছাড়া। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমাদের নতুন আইন করার দরকার নেই। যে আইন আছে, তা কার্যকর করতে হবে। এর মাধ্যমে ৯০ শতাংশ সমস্যা দূর করা যাবে। মূলকথা হলো, যে টাকা পাচার হয়েছে, তা ফিরিয়ে আনতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়ায় পার্ক চুং হি যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন তিনি সব ব্যবসায়ীকে এক জায়গায় আটকে রেখে বলেছিলেন সব অর্থ বিদেশ থেকে নিয়ে আসতে। দুই সপ্তাহের মধ্যে অনেক টাকা ফেরত চলে এল।
প্রথম আলো: তাহলে আপনি বলছেন পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনা একটা অগ্রাধিকারমূলক কাজ হবে এই সরকারের জন্য?
মুশতাক খান: প্রক্রিয়াটা শুরু করতে হবে। ব্যাংক তো আস্থার ওপরে চলে। ইসলামী ব্যাংক ধসে পড়েনি কেন? কারণ, হাজার হাজার মানুষ ধর্মের কারণে ওই ব্যাংকে আমানত রেখেছে। এটা যে লুটেরাদের কবলে পড়েছে, তা তারা পাত্তা দেয়নি। এখন এই লুটেরাদের কাছ থেকে টাকা ফেরত নিতে হবে। আমরা দেখেছি, শেল কোম্পানি করে টাকা নেওয়া হচ্ছে। এটা ঠেকানো যায়নি। কারণ, সমাজে সেই শক্তি নেই। এই শক্তি তৈরি করতে হবে। যেহেতু আগের রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ভেঙে গেছে, সেই সুযোগে আপনি এখন এই চোরগুলোকে ধরতে পারেন। এটা এখনই করা যায়।
মূল বিষয় হলো যে কাজগুলো করা সম্ভব, সে কাজগুলো দ্রুত করা উচিত। যেগুলো মধ্যমেয়াদি, সরকার সময় উল্লেখ করে সেগুলো করুক। আর যেগুলো পাঁচ বছর লাগবে, সেগুলোও শুরু করুক। আমরা যদি এলোমেলোভাবে অনেক কিছু করতে চাই যা করা সম্ভব না, আমরা হয়তো সুযোগটা হারাব। এটা ক্ষমাহীন হবে।
প্রথম আলো: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মুশতাক খান: আপনাদের ধন্যবাদ।
প্রথম আলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন