ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগে বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের কাতারে রয়েছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার আশপাশে রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হলে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, তুরস্কের মতো বাংলাদেশেও ফাটল আছে। আমাদের এখানে ভূ-অভ্যন্তরে ভূমিকম্পের শক্তি সঞ্চার হচ্ছে। তাই আমরা বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে আছি।
ভূ-তত্ত্ববিদরা বলছেন, ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের পর নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে প্রয়োজনীয় খোলা জায়গা নেই ঢাকা শহরে। ঘনবসতির ঢাকা শহরটির ঝুঁকি কমাতে এ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকল্প ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও তার বেশিরভাগই আলোর মুখ দেখেনি। তা ছাড়া ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) মেনে চলার নির্দেশনা থাকলেও রাজধানীর বেশিরভাগ ভবন মালিকই তা মানছেন না। এ বিষয়ে আইন হওয়ার প্রায় ১৫ বছর পরও এটি ঠিকমতো বাস্তবায়ন না হওয়ায় রাজধানীতে বাড়ছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন এবং ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য এবং ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ একেএম মাকসুদ কামাল সময়ের আলোকে বলেন, তুরস্কের মতো বাংলাদেশেও ফাটল আছে। আমাদের এখানে ভূ-অভ্যন্তরে ভূমিকম্পের শক্তি সঞ্চার হচ্ছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই ১২টি ভ‚মিকম্প ফাটল আছে। এসব জায়গায় ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। ঢাকার অদূরে মধুপুর ফাটল খুব বিপজ্জনক। এ ছাড়া ডাউকি ও মিয়ানমারের আরাকান ফাটল দীর্ঘ দিন ধরে ভূমিকম্পের জন্য বড় শক্তি সঞ্চার করছে।
তিনি বলেন, সাধারণত প্রতি ১০০-১৫০ বছর পরপর ফাটল থেকে বড় আকারের ভূমিকম্প হয়। ১৮২২ এবং ১৯১৮ সালে বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্প হয়েছে। তাই আমরা আরেকটি বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কার মধ্যে আছি।
তিনি বলেন, ঢাকায় ভূমিকম্প হলে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। কারণ আমাদের এখানের মাটি দুর্বল এবং ভবনগুলো বিল্ডিং কোড মেনে ভ‚মিকম্প সহনীয়ভাবে নির্মাণ করা হয়নি।
অধ্যাপক মাকসুদ কামাল জানান, ২০০৯ সালে তার নেতৃত্বে সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির (সিডিএমপি) আওতায় ঢাকা শহরের ভবনগুলো নিয়ে জরিপ করা হয়েছিল। তাতে দেখা যায় যে, যদি ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয় তাহলে ৩ লাখ ২৬ হাজার ভবনের মধ্যে ৭২ হাজার ভবন তাৎক্ষণিকভাবে ধসে পড়বে। একেবারে অক্ষত থাকবে কমসংখ্যক ভবন। এ ছাড়া গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইনে বিস্ফোরণ ঘটে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে এখন সেই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর মধ্যে অনেক ভবন ভেঙে ফেলা হয়েছে আবার নতুন ভবনও তৈরি হয়েছে। তাই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সঠিক পরিসংখ্যান তাদের কাছে নেই।
অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বলেন, ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি নেওয়ার পাশাপাশি বিল্ডিং কোড মেনে ভবন তৈরি করার বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। একই সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সম্পর্কেও সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল হাসান সময়ের আলোকে বলেন, বড় ধরনের ভূমিকম্প যেকোনো সময় হতে পারে আবার ১০০ বছর পরেও হতে পারে। ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ ডেল্টা ডি পজিশনের মধ্যে আছে। আমাদের ওপরে প্রায় ২২-২৪ কিলোমিটার সেন্টিগ্রেড পলি আছে যা আমাদের রক্ষা করে। ফলে আমরা ৩-৪ মাত্রার ভূমিকম্প মাঝেমধ্যে অনুভব করি। দেশে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে অনেক ভবন ধসে যেতে পারে এই নিয়ে আমাদের বিতর্ক আছে বলেও জানান তিনি।
অধ্যাপক কামরুল হাসান বলেন, ভ‚মিকম্পে আমাদের অনেক ঝুঁকি আছে যার সবকিছুই আমাদের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির আওতায় (সিডিএমপি) ম্যাপিং করা আছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট এই তিনটি শহরে ম্যাপিং করা হয়। কারণ এসব শহরের ভবনগুলো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের দায়িত্ব এখন পলিসি মেকারদের। তারা যদি সেভাবে উদ্যোগ না নেয়, তাহলে তো আমাদের কিছু করার নেই।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. খায়রুল বসর সময়ের আলোকে বলেন, ভ‚মিকম্প কখন হবে তা পূর্বাভাস পাওয়া যায় না। এটা নিয়ে চিরকালই একটা আতঙ্ক থাকবে। যে মাত্রায় তুরস্ক-সিরিয়ায় ভূমিকম্প হয়েছে সেই মাত্রায় বাংলাদেশেও হতে পারে। ৭ দশমিক ৮ মাত্রায় বাংলাদেশে হলে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যাবে। কারণ আমাদের মাটির ধরন ও বিল্ডিংগুলো বেশিরভাগই নিয়ম মেনে করা হয়নি। সব মিলিয়ে আমরা বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে আছি। বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ফজলে রেজা সুমন বলেন, বিল্ডিং কোড না মানায় ঢাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ভূমিকম্পে দুর্যোগের ঝুঁকি। ভবন তৈরির ক্ষেত্রে নকশা তৈরি থেকে নির্মাণ পর্যন্ত যেসব প্রকৌশলী জড়িত থাকবেন, তাদের প্রত্যেকের করণীয় সম্পর্কে বিল্ডিং কোডে বিস্তারিত বলা আছে। রাজধানীতে এত অল্প জায়গায় প্রচুর বহুতল ভবন ভ‚মিকম্পের ক্ষেত্রে ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ।
তিনি বলেন, সরকারের উচিত ভ‚মিকম্প অসহনশীল ভবনগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সংস্কার বা ধ্বংস করার বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা।