শফিকুল আলম। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব। ২০ বছর ধরে সাংবাদিকতা করেছেন। এর মধ্যে ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির ব্যুরো চিফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ১৩ বছর। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সরকারের কার্যক্রম প্রতিদিন তিনি তুলে ধরেন। আমার দেশ-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি সংস্কার প্রক্রিয়া, নির্বাচন, গণহত্যার বিচারসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমার দেশ-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক জাহেদ চৌধুরী ও মাল্টিমিডিয়া বিভাগের প্রধান তামান্না মিনহাজ
আমার দেশ : আপনি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে প্রায় পাঁচ মাস ধরে কাজ করছেন। এ সময় সরকারের জন্য কোন বিষয়গুলো বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে এসেছে?
শফিকুল আলম : এ সরকারের প্রথম সাফল্য হচ্ছে দেশে স্থিতিশীলতা এসেছে। বিপ্লবোত্তর যেকোনো দেশে যদি আপনি দেখেন—হানাহানি লেগে থাকে, ক্যু হয়, কাউন্টার ক্যু হয়। সবাই সবার কথা বলে। সবাই চায় তার চিন্তাভাবনা বা দৃষ্টিভঙ্গি আরোপ করতে। সেই জায়গায় প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বের সরকার দেশকে খুব স্থিতিশীল জায়গায় নিয়ে এসেছে।
প্রধান উপদেষ্টা চারটা গুরুত্বপূর্ণ সফর করেছেন। বিশ্বনেতারা এসে তাকে সমর্থন জানাচ্ছেন। তাকে বলছেন, যে জায়গায় বাংলাদেশ গিয়েছিল, সেখান থেকে একটা স্ট্যাবল পজিশনে বাংলাদেশ এসেছে।
এ সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর বুঝেছে কী পরিমাণ চুরি হয়েছে। কী পরিমাণ ভঙ্গুর অর্থনীতি রেখে গেছে। ইনস্টিটিউশনগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। ইনস্টিটিউশন থাকলে চুরি কিছুটা হলেও কমে। কিন্তু এত দিন সবকিছু এক ব্যক্তির ওপর ছিল। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, এটা একটা চোরতন্ত্র ছিল। নিকৃষ্টতম একটা চোরতন্ত্র ছিল। সেই জায়গা থেকে ইকোনমিক রিকভারি হয়েছে।
আমার দেশ : অর্থনীতি আসলে কতটা গতিশীল হয়েছে?
শফিকুল আলম : আমাদের অর্থনীতির প্রাণ হচ্ছে দুটি—রপ্তানি ও রেমিট্যান্স। প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রচুর টাকা পাঠাচ্ছেন। এ নিয়ে আমাদের যথেষ্ট কাজ করতে হয়েছে। ফলে রেমিট্যান্স প্রতি মাসেই বাড়ছে। দ্বিতীয়ত, রপ্তানি। রপ্তানির সামগ্রিক চিত্র দেখবেন, সেপ্টেম্বরে প্রায় ৭ শতাংশ, অক্টোবরে ১৬ শতাংশ, নভেম্বরে ২২ শতাংশের মতো এবং ডিসেম্বরে ১৮ শতাংশের মতো বেড়েছে। এই যে গ্রোথ, এর অর্থ হচ্ছে ইকোনমি একটা স্ট্যাবল অবস্থানে এসেছে। হাসিনা রিজার্ভ যেখানে রেখে গেছেন, আমাদের সময়ে যদি পরিস্থিতি একই থাকত, তাহলে রিজার্ভ হতো দুই বিলিয়ন ডলার। রিজার্ভ আগের জায়গায় রয়ে গেছে। পাশাপাশি আমরা আউটস্ট্যান্ডিং পেমেন্টগুলো করতে পেরেছি। বাংলাদেশের কোন সরকার এ রকম একটা আউটস্ট্যান্ডিং সাপোর্ট পেয়েছে? এটা অবিশ্বাস্য।
আমার দেশ : আপনি প্রধান উপদেষ্টার বিদেশ সফর নিয়ে বলছিলেন…
শফিকুল আলম : হ্যাঁ, জো বাইডেন নিজে এসে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেছেন। ডাভোসে প্রথমেই জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজ নিজে তার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট চেয়েছেন, কথা বলেছেন। বিশ্বের বড় বড় নেতা তার সঙ্গে দেখা করেছেন। এতে আমরা অভাবনীয় সমর্থন পেয়েছি। গত জুলাই-আগস্টে যে ভয়াবহ রকমের খুন হলো, হাসিনার পুরো আমলে যে অন্যায়, অবিচার ও অপরাধ হয়েছে, তা জবাবদিহির মধ্যে নিয়ে আসার জন্য চেষ্টা আমরা করেছি।
আমার দেশ : কীভাবে জবাবদিহি আনা হচ্ছে?
শফিকুল আলম : গুমের জন্য ইনকোয়ারি কমিশন হয়েছে। গুমের ভয়াবহ গল্পগুলো আপনারা দেখছেন। বাচ্চাকে দুধ খেতে দেওয়া হয়নি। আগে আমরা ভাবতাম গুম বুঝি কয়েক শ লোক হয়েছে, এখন দেখা যাচ্ছে হাজার হাজার হয়েছে। জুলাই-আগস্টে কিলিং নিয়ে আমরা জাতিসংঘকে বলেছি, তোমরা ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং করো। আমরা এখানে কোনো প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করব না। আমরা নিরপেক্ষ একটা রিপোর্ট চাইছি। এই মাসের শেষে বা আগামী মাসে রিপোর্ট পাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া যারা গুম খুনে জড়িত ছিল তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
আমার দেশ : শেখ হাসিনাসহ প্রধান অপরাধীরা তো পালিয়ে গেছেন?
শফিকুল আলম : হাসিনাকে আমরা ফেরত চেয়েছি। যতক্ষণ না তিনি ফিরে আসেন আমরা আন্তর্জাতিক চাপ বজায় রাখব। খুন তো একটা-দুটো নয়! আপনি তো জুলাই-আগস্ট দেখেছেন; শাপলা দেখেন, মাওলানা সাঈদীর রায়ের পরে যে কিলিংটা হয়েছে, বহু এক্সট্রা-জুডিশিয়াল কিলিং হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের প্রায় ৬০ লাখ লোকের বিরুদ্ধে ভুয়া মামলা করা হয়েছে। এরা জীবন্ত মৃত হয়ে গিয়েছিল। তাদের জীবন তছনছ হয়ে গেছে। তাদের ছেলেমেয়েরা সরকারি চাকরি পেত না। দিনের পর দিন আদালতে হাজিরা দিতে যেতে হতো। তাদের অনেক ছেলে ঢাকায় এসে উবার চালায়, পাঠাও চালায়। অমানবিক পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল। অবশ্যই এগুলোর বিচার হতে হবে।
আমার দেশ : অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে—এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য জানতে চাই।
শফিকুল আলম : আমরা নতুন পররাষ্ট্রনীতি দিয়েছি। আমরা সার্কের পুনরুজ্জীবন চেয়েছি, আসিয়ানের সদস্য হতে চাইছি। আমরা পৃথিবীর অষ্টম জনবহুল দেশ। আমাদের যে বিশেষ গুরুত্ব আছে, বিশ্বকে আমরা জানাচ্ছি। আসিয়ানের সদস্য হওয়ার অর্থ হচ্ছে, আমাদের অর্থনীতির অবারিত দ্বারা খুলে যাওয়া, আমাদের বাণিজ্য বৃদ্ধি পাওয়া। এই বিষয়গুলো কিন্তু মানুষের চোখে পড়বে না। মানুষ হয়তো রাস্তায় কিছু বিক্ষোভ দেখছে। কিন্তু সরকার ছয় মাসের মধ্যে অবিশ্বাস্য অনেক কাজ করেছে।
আমার দেশ : প্রফেসর ইউনূস সর্বশেষ বিদেশ সফরে ৫০টির মতো বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠক থেকে বাংলাদেশের কী অর্জন? পাচার করা অর্থ কতটা ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন?
শফিকুল আলম : আমরা ইউরোপজুড়ে অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছি। আমরা আসিয়ান লিডারদের কাছে সমর্থন পেয়েছি। বিজনেস লিডাররা এসে বলছেন, বাংলাদেশে তারা বিনিয়োগ করতে চাইছেন। তারা চট্টগ্রাম পোর্ট ম্যানেজ করতে চান। বিদেশি কোম্পানি যদি পোর্টগুলো ম্যানেজ করে, তাহলে পোর্টের দক্ষতা বাড়ে। সবার কাছ থেকে অভূতপূর্ব সমর্থন আমরা পেয়েছি।
আমার দেশ : সরকার চালাতে গিয়ে তো অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে?
শফিকুল আলম : আমাদের আমলাতন্ত্রের দক্ষতা বলে কিছু রেখে যায়নি হাসিনা সরকার। একটা সরকার কাজ করে আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে। গত ১৫-১৬ বছর যারা দলের অনুগত ছিল, তাদের শুধু রাখা হয়েছিল।
আমার দেশ : এ ছাড়া আর কী সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন?
শফিকুল আলম : পুলিশ যদি আরো দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে পারত, তাহলে আমরা আরো ভালো ফল পেতাম। অপরাধের যে পরিসংখ্যান দেখছি, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন যা আছে, গত বছরের এই সময়ে এমনই ছিল। অনেক এলাকায় বন্যা হয়েছে। ফলে পণ্যের দাম বেড়েছে। দাম বেড়ে গেলে তো হঠাৎ করে তা আর নামানো যায় না। মূল্যস্ফীতি এখন উচ্চ। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি এটাকে নিচে নামানোর জন্য।
আমার দেশ : পোশাক সেক্টর উত্তাল, প্রতিদিন অনেক কারখানা বন্ধ হচ্ছে।
শফিকুল আলম : এটা একটা প্রপাগান্ডা। আপনি দেখবেন, গ্রোথ কেমন। অদক্ষ কারখানা যেগুলোর মালিক ব্যাংক থেকে ঋণের নামে টাকা চুরি করে নিয়েছে, সেগুলোয় সমস্যা তৈরি করা হয়েছে। এসব ফ্যাক্টরিটা রাখাই হয়েছিল লোন চুরির জন্য। এ ধরনের কিছু ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়েছে। এতে সামগ্রিক অর্থনীতিতে কোনো প্রভাব পড়েনি। এগুলো পুরোপুরি প্রপাগান্ডা।
আমার দেশ : কিন্তু এগুলোকে কেন্দ্র করে নৈরাজ্য তৈরি হচ্ছে।
শফিকুল আলম : সালমান এফ রহমানের ফ্যাক্টরিতে হচ্ছে। তিনি ফ্যাক্টরিকে সামনে রেখে হাজার হাজার কোটি টাকা লোন নিয়েছেন। লোন নিয়ে শ্রমিকদের দেননি। তার ছেলে প্রিন্স চার্লসের চ্যারিটিতে দান করেন। লন্ডনে বহু সম্পদ কিনেছেন। একটা বাড়ি কিনে শেখ রেহেনাকে থাকতে দিয়েছেন। এখন তার কারখানায় শ্রমিকদের কর্মচ্যুতি হয়েছে। আমরা তো তিন মাস বেতন দিয়েছি। এভাবে তো অনন্তকাল চলতে পারে না।
আমার দেশ : গণঅভ্যুত্থানের যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা যখন দল গঠন করার উদ্যোগ নিয়েছেন, তখন বিএনপির পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছে। আবার তারা বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে যে মন্তব্যগুলো করছেন, এগুলো আপত্তিজনক। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দুপক্ষই গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডার। দুপক্ষের এই মুখোমুখি অবস্থান সরকারকে কি নাজুক অবস্থায় ফেলছে?
শফিকুল আলম : মোটেও না। আমরা মনে করি, বাংলাদেশে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ ফিরে এসেছে। এটা ভালো। একটা জায়গায় কিন্তু সবাই এক। স্বৈরাচারের ব্যাপারে ছাত্র ও রাজনৈতিক দল সবাই এক।
আমার দেশ : তাহলে বিরোধটা কোথায়?
শফিকুল আলম : আপনি যদি একটা পার্টি করেন, আমি যদি পার্টি করি, তাহলে মতপার্থক্য তো থাকবেই। আমরা মনে করি, বিএনপি ও ছাত্ররা সবাই অংশীজন। আমরা সবার কাছ থেকে অকুণ্ঠ সমর্থন পাচ্ছি।
আমার দেশ : নির্বাচনের বিষয়ে বিএনপিকে কি একটু অসহিষ্ণু মনে হচ্ছে?
শফিকুল আলম : বিএনপি তার কথা বলছে। ছাত্ররা তার কথা বলছে।
আমার দেশ : আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের একটা চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে?
শফিকুল আলম : কেউ কি আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন চেয়েছে, দেখেছেন? আমি মনে করি, আওয়ামী লীগের ব্যাপারে জাতীয় সংহতির ক্ষেত্রে সবাই এক। আপনি দেখেছেন, চট্টগ্রামে যখন সাইফুল ইসলাম মারা গেলেন, তখন সব দল এক কাতারে দাঁড়িয়েছে। স্বৈরাচার, যাদের হাতে রক্ত, তাদের ব্যাপারে বাংলাদেশের সব দল এক আছে।
আমার দেশ : গত কয়েক দিনে আমরা দেখলাম, প্রফেসর ইউনূস পদত্যাগ করেছেন বলে প্রচারণা চলছে। তার পদত্যাগপত্রও ছাপিয়ে দেওয়া হলো।
শফিকুল আলম : যারা পালিয়ে গেছেন, তারা এই পালানোর গল্প বলেছেন। যারা পালিয়ে ভারত আছেন, বিলিয়ন ডলার নিয়ে গেছেন। তারা এখন অনলাইনে ফেক নিউজ ছড়িয়ে মজা পাচ্ছেন।
আমার দেশ : প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি হিসেবে আপনি যতটা সরব, যে সুরে কথা বলেন, অনেক উপদেষ্টাকেই এভাবে কথা বলতে দেখি না কেন?
শফিকুল আলম : সবাই তো মিডিয়ায় আসবেন না। তারা তাদের কাজগুলো ঠিকমতো করছেন।
আমার দেশ : আপনি প্রধান উপদেষ্টার পলিটিক্যাল সেক্রেটারির রোল প্লে করছেন?
শফিকুল আলম : এ সরকার তো একটা বিপ্লবের সরকার। এটা একটা বিপ্লবী চেতনার সরকার।
আমার দেশ : উপদেষ্টারা আপনার সুরে কথা বলতে পারছেন না কেন? তাদের সীমাবদ্ধতা কোথায়?
শফিকুল আলম : তারা তাদের কাজগুলো কি করছেন না? খুব ভালোভাবে করছেন।
আমার দেশ : সবাই করছেন, এটা বলা মনে হয় যায় না।
শফিকুল আলম : আমি এ বিষয়ে একমত নই। আপনি যাকে মনে করছেন, তিনি কাজ করছেন না, তার সঙ্গে একজন রিপোর্টার যুক্ত করে দিন। দেখেন কী কাজ করছে। ভঙ্গুর একটা অর্থনীতি, ভঙ্গুর একটা ব্যুরোক্রেসি; কিছুই নেই। সেগুলো নিয়েও যে তারা এতদূর এগিয়েছেন, দেশকে স্ট্যাবল করেছেন। সরকারের প্রত্যেকে ভালো কাজ করছেন।
আমার দেশ : জাতীয় সরকারের বিষয়ে বিএনপি রাজি হয়নি বলে দাবি ছাত্রদের। এখন বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চাইছে। বিএনপি জাতীয় সরকারের প্রস্তাবে রাজি না হয়ে ভুল করেছে কি না-এ প্রসঙ্গগুলো সামনে এসেছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
শফিকুল আলম : আমার মনে পড়ে না জাতীয় সরকারের বিষয়ে কখনো জোরালো কোনো কিছু শুনেছি। আমি এ পর্যন্ত শুনিনি। সবাই এ সরকারকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছেন।
আমার দেশ : তথ্য উপদেষ্টা বলেছেন, আমরা বিএনপিকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম—আপনারাও সরকারে আসেন। স্টেকহোল্ডার যারা তাদের সবাইকে নিয়ে সরকার গঠন করি। তখন বিএনপি সরকারে যোগ দিতে রাজি হয়নি। এখন সরকারের সমালোচনা করছে।
শফিকুল আলম : এই স্টেটম্যান্ট আমার দেখতে হবে। আমরা কি সব পলিটিক্যাল পার্টির সরকার নই? সবার সমর্থনই তো আমরা পেয়েছি। আমরা আমাদের কাজ তো করছি।
আমার দেশ : স্বৈরাচারের সহযোগীদের আপনারা পালিয়ে যেতে দিলেন কেন?
শফিকুল আলম : ৫ আগস্ট ১টার দিকে শেখ হাসিনা পালালেন। পালানোর পর ৮ তারিখ ৮টা পর্যন্ত কোনো সরকার ছিল না। এরপর আরো এক সপ্তাহ পুলিশ ছিল না। এ সময় যারা বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার করেছে, তারা কি বসে থাকবে? তারা তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে পালিয়ে গেছে। অনেকে বলে, তিন মাস থাকার পর চলে গেছে। আমাকে প্রমাণ দেখান।
আমার দেশ : ৬০০ লোককে আশ্রয় দিলেন। ক্যান্টনমেন্ট থেকে তাদের চলে যেতে সুযোগ দিলেন। এ বিষয়ে সমালোচনা রয়েছে।
শফিকুল আলম : এ বিষয়ে আর্মির স্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে। আমি এ বিষয়ে কিছু বলব না।
আমার দেশ : ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাধীনতার পর থেকে নাজুক অবস্থায় আছে।
শফিকুল আলম : আমরা মনে করি, ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খুব ভালো আছে। বাণিজ্যের চিত্র দেখেন। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য তো কমেনি।
আমার দেশ : ভারতের রাজনীতিবিদরা বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
শফিকুল আলম : রাজনৈতিক নেতাদের ভুল বোঝানো হয়েছে। তাদের বলা হয়েছে, সংখ্যালঘুরা বড় ধরনের আক্রমণের শিকার হয়েছে। আমরা নাগরিকের মানবাধিকার রক্ষার জন্য বদ্ধপরিকর। প্রফেসর ইউনূস বলেছেন, আমরা ভারতের সঙ্গে ন্যায্যতা, সমতা ও মর্যাদার ভিত্তিতে সম্পর্ক চাই। আমরা চাই, ভারত আমাদের মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখুক। আমরা চাই, ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরো দৃঢ় হোক।
আমার দেশ : ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্পষ্ট ভাষায় উদ্বেগ জানিয়েছেন।
শফিকুল আলম : আমরা একটা ওপেন ডোর পলিসি করেছি। আমরা ভারতের সব মিডিয়াকে ইনভাইট করছি। আমরা বলছি, আপনাদের ওখানে প্রচুর মিসইনফরমেশন, ডিজইনফরমেশন, ফেক নিউজ ছড়ানো হচ্ছে। আমরা তাদের বলেছি, তোমাদের জন্য আমাদের দরজা ওপেন। পারলে এখানে ব্যুরো অফিস করো। দেখো আমাদের এখানে কী হচ্ছে।
আমার দেশ : এতে কি কোনো সাড়া পেয়েছেন?
শফিকুল আলম : কিছু কিছু পাচ্ছি। অনেকে আসছেন। কিছু মিডিয়া ছিল যারা ভয়ংকর মিথ্যা নিউজ দিত। তারা দু-একজন আসার পর এটা বন্ধ হয়ে গেছে।
আমার দেশ : চারটা কমিশন রিপোর্ট দিয়েছে, আর দুটো কমিশন রিপোর্ট দেবে। সংস্কার কীভাবে করতে চাইছেন, ফেব্রুয়ারিতে এ বিষয়ে পলিটিক্যাল পার্টির সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে কি?
শফিকুল আলম : চারটা রিপোর্ট দিয়েছে। আমাদের কাজ হবে রিপোর্টগুলো নিয়ে সংলাপ করা।
আমার দেশ : প্রধান উপদেষ্টা যে চার্টার করার কথা বলেছেন, সংস্কারের ওপর ভিত্তি করে…
শফিকুল আলম : এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটা ঐকমত্য হবে। তিনি কনসেনসাস বিল্ডিং কমিশন করেছেন। এরপর রাজনৈতিক দলগুলো দেখবে কোন সংস্কার এখন করার মতো, আর কোন সংস্কার পরে করতে হবে। সবাই এ নিয়ে ঐকমত্যে আসবে। এরপর তারা একটা চার্টারে এগুলো লিখে ফেলবে। আমরা এগুলো করতে চাই। এটার নাম হবে জুলাই চার্টার। এর অধীনে সংস্কার করে আমরা ইলেকশন দিয়ে দেব। রাজনৈতিক দলগুলো কী চাইছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। কিছু রিফর্ম যদি হয়, তাহলে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হবে। আরেকটু রিফর্ম করতে গেলে আরো ছয় মাস লাগবে।
আমার দেশ : আমরা কি এটা ধরে নিতে পারি, এই বছরের মধ্যে নির্বাচন হবে?
শফিকুল আলম : প্রফেসর ইউনূস দুটি তারিখ দিয়েছেন। এটা রাজনৈতিক দলগুলোর সিদ্ধান্তের বিষয়। এখন পর্যন্ত সংলাপ হয়নি। সংলাপ হোক, ঐকমত্যে হোক, তারপর বোঝা যাবে।
আমার দেশ : বর্তমানে মিডিয়ার যে ভূমিকা তাতে কি আপনারা সন্তুষ্ট?
শফিকুল আলম : আমরা চাই সবাই মন খুলে লিখুক। সবাই যদি আমরা প্রশংসা শুরু করি, তাহলে আমার ভুলগুলো খুঁজে পাব কীভাবে?
আমার দেশ : শেখ হাসিনা কি বাংলাদেশে আবার ফিরে আসবেন?
শফিকুল আলম : এত হত্যাকাণ্ড! তার তো অপরাধের শেষ নেই। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। শাপলায় কী নির্মম ঘটনা হয়েছে! মাওলানা সাঈদীর রায়ের দিন কী নির্মমভাবে রাইফেলের গুলি করে মারা হয়েছে। তিনটা নির্বাচনে তিনি মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছেন। প্রায় তিন হাজার লোক এক্সট্রা-জুডিশিয়ালি মার্ডার হয়েছে। সাড়ে ৩ হাজার গুম হয়েছে। ৬০ লাখ লোকের বিরুদ্ধে ভুয়া মামলা দিয়েছেন। একটা দেশের ১০ শতাংশ যুবককে তিনি ক্রিমিনাল বানিয়ে ফেলেন।
আমার দেশ : তার বিচার কি আপনারা করে যেতে পারবেন?
শফিকুল আলম : আমরা তো শুরু করেছি। বাংলাদেশের মানুষের মর্যাদার প্রশ্ন এখানে। যদি আমাদের মর্যাদা থাকে, আমরা তার বিচার করব। তার বিচার হবে।
আমার দেশ : আপনারা আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের কাছ থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়েছেন। তার জবাব কী পেয়েছেন?
শফিকুল আলম : আনুষ্ঠানিকভাবে ফেরত পেতে হলে কিছু লিগ্যাল প্রক্রিয়া আছে। আমরা আশাবাদী তাকে ফেরাতে পারব। আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। একটা ঢেউ গিয়ে পড়েছে ব্রিটেনে। কার চাকরি গেল দেখেছেন না? মানুষ তো দেখছে কী ধরনের একটা ভয়ানক চোরতন্ত্র জারি করেছেন।
আমার দেশ : পুতুলের বিষয়ে আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী?
শফিকুল আলম : আমরা চিঠি দিয়েছি। এটা ইন্টারন্যাশনাল বডি। এখানে লিগ্যালি এগোতে। তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তা তাদের জানিয়েছি। আমরা স্পষ্ট জানিয়েছি, তার বিরুদ্ধে যেহেতু এসব অভিযোগ—আমরা তার মাধ্যমে কোনো কাজ করব না, আমরা সরাসরি হেড অফিসের সঙ্গে কাজ করব। তারা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।