জুলাই জাতীয় সনদ, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আসিফ হাওলাদার।
আপনারা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেননি। আগামী ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে কি এনসিপি সনদে স্বাক্ষর করবে?
আখতার হোসেন: যদি ঐকমত্য কমিশন তার মেয়াদকালের মধ্যেই জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ প্রস্তুত করে এবং আমরা যেভাবে চেয়েছি, যেসব দাবি জানিয়েছি, তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে বিষয়টি সমাপ্ত করতে পারে, তাহলে আমরা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করব।
গত এক বছরে সংস্কারসহ বিভিন্ন বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে এনসিপির একধরনের অবস্থানগত মিল দেখা গেছে। কিন্তু সম্প্রতি আপনার দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এক ফেসবুক পোস্টে জামায়াতের কড়া সমালোচনা করলেন। জামায়াতের পক্ষ থেকেও প্রতিবাদ করা হলো। জামায়াতের সঙ্গে আপনাদের সম্পর্কের এই অবনতির কারণ কী?
আখতার হোসেন: সংস্কার বাস্তবায়নের আলাপের সময়ে জামায়াত যখন নিম্নকক্ষে পিআরের দাবিকে প্রমিনেন্ট করে তুলেছে, এর মধ্য দিয়ে সংস্কার বাস্তবায়নের দাবিটা পেছনে পড়ে গেছে। এর যৌক্তিক সমালোচনাই নাহিদ ইসলাম করেছেন।
জামায়াতের সঙ্গে কি আপনাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক আছে?
আখতার হোসেন: বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদবিরোধী যতগুলো রাজনৈতিক পক্ষ রয়েছে, সবার সঙ্গেই আমাদের একটা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও আন্তরিকতার জায়গা রয়েছে। কিন্তু এর অর্থ এটা নয় যে আমরা কারও যৌক্তিক নয় এমন দাবিকেও সমর্থন করব।
বর্তমানে জুলাই সনদকে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক সংকটের জায়গা তৈরি হয়েছে, আমরা মনে করি জুলাই সনদকে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নই কেবল আমাদের এই সংকট থেকে মুক্তি দিতে পারে।
প্রথম আলো: এখন জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক দেখা যাচ্ছে। এটিকে ঘিরে অনেকে নতুন সংকটের সম্ভাবনা দেখেন?
আখতার হোসেন: যদি জুলাই সনদ বাস্তবায়নকে অনিশ্চিত রাখা হয়, তাহলে বাংলাদেশ দীর্ঘ মেয়াদে ফ্যাসিবাদী কাঠামো থেকে উত্তরণের সুযোগ হারিয়ে ফেলবে। সে ক্ষেত্রে বর্তমানে জুলাই সনদকে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক সংকটের জায়গা তৈরি হয়েছে, আমরা মনে করি জুলাই সনদকে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নই কেবল আমাদের এই সংকট থেকে মুক্তি দিতে পারে।
জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিয়ে অনেকগুলো দল একমত হয়েছে। বিএনপি শুরুতে একমত না থাকলেও পরে একমত হয়েছে। এখন বাস্তবায়নের সময়টাতে যদি লুকোচুরি হয়, জুলাই ঘোষণাপত্রের মতো করে এটাকে একটা একদলীয় সনদে পরিণত করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়, অবশ্যই সে বিষয়টা জাতির জন্য ভালো হবে না এবং আমাদের এই সংকট শিগগিরই উত্তরণের কোনো সুযোগ থাকবে না।
অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের কথা বলছে। আইনশৃঙ্খলার বর্তমান পরিস্থিতি বা দলগুলোর মধ্যে যে অনৈক্য দেখা যাচ্ছে, তাতে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন কতটা সম্ভব বলে মনে করেন?
আখতার হোসেন: ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে এনসিপিসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী সব পক্ষই আগ্রহী। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কোনো বিরোধিতার জায়গা দেখি না। যদি নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়, সে ক্ষেত্রেই একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করার মতো সক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত নির্বাচনের ব্যাপারে যতটা নিশ্চয়তার জায়গা রয়েছে, নির্বাচন কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে সেই জায়গাটার ক্ষেত্রে ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়।
নির্বাচনী জোট বা সমঝোতা নিয়ে আপনারা কী ভাবছেন?
আখতার হোসেন: নির্বাচনে জোটকেন্দ্রিক অংশগ্রহণের বিষয়ে আমরা এখনো সুনিশ্চিতভাবেই কোনো দলের সঙ্গে আলোচনা করিনি। আমরা নিজেদের সাংগঠনিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে, সাংগঠনিক কলেবর বৃদ্ধিতেই কাজ করছি। যদি জাতীয় স্বার্থে জোটের প্রয়োজন হয়, সে ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদবিরোধী যেকোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে রাজনৈতিক জোটের জন্য আমরা এখনো ওপেন রয়েছি।
তার মানে, বিএনপি ও জামায়াত—দুই দলের সঙ্গেই আপনাদের জোট হতে পারে...
আখতার হোসেন: যদি অবস্থানগত ঐক্য হয়, তাহলে যেকোনো দলের সঙ্গেই জোট বা সমঝোতার বিষয়ে আমরা এখনো ওপেন রয়েছি। যদিও এখনো কারও সঙ্গেই আমাদের সুনির্দিষ্ট করে জোটনির্ভর কোনো আলোচনা হয়নি। মধ্যমপন্থী আরও কিছু দলের সঙ্গে আমাদের আলাপ-আলোচনা চলমান রয়েছে। তবে জোটনির্ভর রাজনীতি বা নির্বাচনের ব্যাপারে আমরা এখনো সুনিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হইনি। আমরা সবার জন্য এখন পর্যন্ত ওপেন রয়েছি।
গণতন্ত্র মঞ্চের ছয়টি দলের সঙ্গে আপনারাসহ মোট ৯টি দলের একটি নির্বাচনী ঐক্যের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা ছিল। এর সম্ভাবনা কতটুকু?
আখতার হোসেন: নির্বাচনী জোটের ব্যাপারে আরও অনেকগুলো বিষয়কে বিবেচনায় নিতে হবে। জাতীয় স্বার্থ ও দেশের পরিস্থিতিগত বিষয়, মতাদর্শিক ও কর্মসূচিগত মিলের বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়েই সামনের নির্বাচনে আমরা জোটগতভাবে অংশগ্রহণ করব কি না, সে সিদ্ধান্ত নেব।
আগামী নির্বাচনে জিতে যারাই সরকার গঠন করুক, তাদের কাছে আপনাদের প্রত্যাশা কী?
আখতার হোসেন: সামনে যারাই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তারা যেন সঠিকভাবে জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়ন করে, সেই লক্ষ্যে আমরা আমাদের দাবিদাওয়া এবং কার্যক্রমগুলো সেভাবেই পরিচালনা করব। যে দলই ক্ষমতায় আসুক, তারা জুলাই অভ্যত্থানের আকাঙ্ক্ষার বাইরে গিয়ে যদি চিন্তা করেন, তাদের অবশ্যই ক্ষমতার বলয় থেকে ছিটকে পড়তে হবে। সেই কারণে হলেও যারাই ক্ষমতায় আসবেন, অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য তাদের সচেষ্ট থাকতে হবে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
আখতার হোসেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।