
জুলাই আন্দোলনের এক বছর। নতুন বাংলাদেশে ঘটনা প্রবাহের অন্ত নেই। অন্তহীন প্রবহমান ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। প্রতিটি পদক্ষেপের হিসাব রাখছে বাংলাদেশ। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, পাওয়া-না পাওয়ার হিসাব কষছেন আন্দোলনে সম্পৃক্তরা। জুলাইয়ের অভূতপূর্ব পরিবর্তনে আমরা কি পেলাম বা কি পাইনি- এ নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। দেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ এই পট পরিবর্তনের সাক্ষী এবং যোদ্ধা অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান। তাত্ত্বিক, বিশ্লেষক, চিন্তক, অনলবর্ষী বক্তা ড. সলিমুল্লাহ খানের মুখোমুখি হয়েছিল ‘জনতার চোখ’। ফিরে দেখা রক্তাক্ত জুলাই নিয়ে দীর্ঘ আলাপচারিতায় তিনি বলেন, “পুরনো চ্যানেলে প্রবাহিত হচ্ছে ক্ষমতা। বড় আকারের মৌলিক পরিবর্তনের আশা করা যাবে না। জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার না হলে পুরোপুরি ব্যর্থ হবে বিপ্লব। ইতিহাসের বিচারে শেখ হাসিনার অপরাধের দায় আওয়ামী লীগের প্রত্যেকটা কর্মীকে নিতে হবে।” সর্বোপরি তিনি বললেন, “বিপ্লব আপস করেছে। আওয়ামী লীগের নৈতিক পরাজয় হয়েছে, দৈহিক পরাজয় হয়নি।”
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ইতিহাস ও দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খানের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। তিনি বলেন, “সংস্কার প্রক্রিয়া অনেকটা ধীরগতিতে শুরু হয়েছে। সার্চ কমিটি গঠনটাকেই শুরু হওয়া বলছি না। আসল কাজের কাজ এক বছরে কিছুই হয়নি। বিপ্লবের পরের মুহূর্তে এক বছর অনেক সময়। এক বছর আগে ছাত্ররা অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছিলেন। অনেকে বলেন, এটা কোটা আন্দোলন। এটা অনেকটা লক্ষণ দেখা, কারণ না দেখা। কোটা ছিল একটা লক্ষণ। মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পার হয়ে যাবার পরেও যখন মুক্তিযোদ্ধা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তাদের নাতি-পুতি বা আরও নিচের পুরুষের লোকজনদের কাজে লাগাতে চেয়েছিল হাসিনা সরকার।”
তিনি প্রশ্ন রাখেন, বৈষম্যের গোড়া কোথায়? ১৯৭২ সালে যে সংবিধান আমরা গ্রহণ করেছিলাম তাতেই। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের যে ঘোষণাপত্র ১০ই এপ্রিল দেয়া হয়েছিল, সেটাই প্রথম সরকারি ঘোষণাপত্র। এটাকে আমি প্রকৃত ঘোষণাপত্র বলতে চাই। জিয়াউর রহমানেরটাও নয়। শেখ মুজিবের নামে প্রচারিত মিথ্যা দলিলটাও নয়। জিয়াউর রহমান যেটা করেছেন সেটা হলো কনটিনজেন্সি (বিকল্প ব্যবস্থা) ম্যানেজমেন্ট। যুদ্ধের জন্য তো একটা ঘোষণা লাগে, জিয়াউর রহমান দায়িত্ব পালন করেছেন। ১০ই এপ্রিল প্রথম বলা হয়েছে, আমরা একটি নতুন রাষ্ট্র গঠন করতে যাচ্ছি। এর মূল ভিত্তি হবে তিনটি শব্দ- সাম্য মানে বৈষম্য থেকে মুক্তি, মানবিক মর্যাদা মানে পাকিস্তান আমলে যে মানবিক মর্যাদা বা সমতা অস্বীকার করা হয়েছিল সেটা ফিরিয়ে আনা এবং সামাজিক সুবিচার। আমার প্রশ্ন ১৯৭১ সালের ঘোষণাপত্র ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রিয়ম্বল (ভূমিকা) আকারে যোগ হলো না কেন? পরে পরিশিষ্ট আকারে দেয়া হলো। এখানেই তো বৈষম্যের গোড়া।
জুলাই সনদের বিষয়ে বলেন, জুলাই সনদ আমরা রক্ত দিয়ে লিখেছি। তার ভাষাটা অনুবাদ করার বিষয়। ঘটনাটাই আসল ঘোষণাপত্র- ‘আমরা শেখ হাসিনাকে বিদায় দিয়েছি, আমরা শহীদ হয়েছি।’ ৩৬ দিনে- জাতিসংঘের হিসাবে ১৪০০’র বেশি লোক নিহত, ২০ হাজারের বেশি আহত হয়েছে। মানুষ ট্রমাটাইজড হয়েছে। এটাই ঘোষণাপত্র। এর আগে কতো লোক গুম-খুন হয়েছে। শেখ হাসিনা দেশটাকে আইয়ামে জাহেলিয়াত যুগে নিয়ে গিয়েছিল। আমরা দুটো ঘোষণা দিয়েছি। ‘প্রথমত এদেশে একটা আইয়ামে জাহেলিয়াত কায়েম হয়েছিল, দ্বিতীয়ত আমরা তা মেনে নেইনি।’
সংস্কার কমিশন গঠনের কথা বললে আমার ১৯৯০ সালের কথা মনে পড়ে। জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে যে অভ্যুত্থান সম্পন্ন হয়েছিল সেটার নাম লোকেই দিয়েছিল ‘নাগরিক অভ্যুত্থান।’ এবারেরটার নাম ‘গণ-অভ্যুত্থান’। নাগরিক অভ্যুত্থানের সময় কয়েকটা টাস্কফোর্স গঠিত হয়েছিল। সে সময় অধ্যাপক রেহমান সোবহান, অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ প্রভৃতি মণীষী বস্তাপচা রিপোর্ট লিখেছিলেন। ওগুলোর খবর কি কেউ জানেন? এগুলোর বাস্তবায়ন হয়নি। এখনকার সংস্কার কমিশনের ত্রুটি হচ্ছে তারা ত্রুটি অনুসন্ধান করছেন না। হাসিনার আমলে তিনবার নির্বাচন হয়নি। সুুতরাং হাসিনা অবৈধভাবে ক্ষমতায় ছিলেন। এরকম সরকারকে হটাতে সামরিক অভ্যুত্থান হয়। সেটাও আমাদের এখানে করা প্রায় নিষিদ্ধ। জনগণ গ্রহণ করবে না। বাকি পথ হচ্ছে গণ-অভ্যুত্থান। জনগণ তার সার্বভৌমত্ব নিজেই দাবি করে। সেটাই ঘটেছে। এটাই জুলাই সনদ।
ড. সলিমুল্লাহ খান বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, এর আগে ছিল গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি, গণঅধিকার পরিষদ ইত্যাদি। এই ধরনের বিচ্ছিন্ন আন্দোলন হয়েছে। গতবছর জুলাই আন্দোলনের মাঝামাঝি সময়ে বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছিলেন, ছাত্রদের আন্দোলনের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা এটাকে নৈতিক সমর্থন দিচ্ছি মাত্র। ছাত্রদের আন্দোলনে সাধারণ মানুষ যে নৈতিক সমর্থন দিয়েছেন সেটা ছাত্রদের ওপর আস্থার জন্য নয়। হাসিনার বিরুদ্ধে মানুষের যে ঘৃণা আর ক্ষোভ তার কারণেই মানুষ রাজপথে দাঁড়িয়েছে। মানুষ বলছিল- হাসিনার বিরুদ্ধে একটা কলাগাছকে দাঁড় করালেও কলাগাছকেই ভোট দেবো। ছাত্ররাই ছিল প্রকৃতপক্ষে কলাগাছ। তাদের গুণ হচ্ছে সাহসিকতা ও দূরদর্শিতা। সেটাও বেশি নয়। তারা শেষ কথাটা বলছে গত বছরের আগস্টের এক কি দুই তারিখে। কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন, ৯ দফা দাবি। এরপর কমতে কমতে একদফা। হাসিনা বিদায় নেয়ার পর আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
তিনি বলেন, বর্তমানে ফিরে আসি। বর্তমান সরকার যে অব্যবস্থিত চিত্ত বা আনডিসাইটেড মাইন্ড তার প্রমাণ হচ্ছে ৮ই আগস্টকে তারা নতুন বাংলাদেশ দিবস ঘোষণা করেছিলেন। শ্রদ্ধা রেখে বলছি, এ থেকে বোঝা যায় রাজনীতি সম্পর্কে ড. ইউনূসের কোনো ধারণাই নেই। যদি থাকতো তিনি একথা বলতেন না। পরে বুঝতে পেরেছেন, ভাগ্য ভালো যে তাকে বোঝানোর মতো পাশে কিছু লোক আছে। শেখ মুজিবের পাশে সিপিবি ছিল। এখন ড. ইউনূসের পাশে কারা আছে জানি না। তিনি যদি এই সিদ্ধান্তে অটল থাকতেন এটা আত্মঘাতী হতো। আসল ঘটনা ঘটেছে ৫ই আগস্ট। তিনি তার নিজের আরোহণ দিবসকে নতুন বাংলাদেশ দিবস বলে ঠিক করেন নাই। প্রত্যাহার করেছেন এটা বুদ্ধিমানের কাজ।
সংস্কার কমিশন প্রসঙ্গে সলিমুল্লাহ খান বলেন, এগুলোর তুলনা করা যায় টাস্কফোর্সের সঙ্গে। বাংলাদেশের অবনতির আরেকটা কারণ হলো- তারা বাংলা ভাষায় কিছু বলতে পারেন না। যত গর্জে তত বর্ষে না। কিন্তু যেটুকু বর্ষণ হয়েছিল সেটাও ছিল ভুল চিন্তা। প্রথমে শুরু হলো প্রধানমন্ত্রী পদ্ধতি নিয়ে। যেটাকে ক্যাবিনেট সিস্টেম বলে। বাহাত্তরে শেখ মুজিব প্রেসিডেন্সিয়াল ফর্মে গেলেন, ’৭৫ সালে জিয়াউর রহমানও প্রেসিডেন্ট পদ্ধতিতে থেকে গেলেন। সেই সুখকে কেউ উৎখাত করেননি। জেনারেল জিয়াউর রহমান, এরশাদ কেউ করেননি। সকলেই মনে করলেন প্রেসিডেন্সিয়াল ফর্মই হচ্ছে আমাদের দেশে গণতন্ত্রহীনতার একমাত্র কারণ।
১৯৯০ সালের অভ্যুত্থানের ফলাফল হলো, চারটা জোট লিয়াজোঁ কমিটির মাধ্যমে আন্দোলন করলেন। এরপর বললেন, আমরা সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে যাবো। সেটার পরিণতি আরও খারাপ হলো। ’৯১ সালে নতুন যাত্রা শুরু হলো- নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। এটা যে একটা ভুয়া কথা তা হাসিনা প্রমাণ করেছেন। এখন নতুন আলোচনা চলছে আমরা কি প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতিতে ফেরত যাবো? নাকি প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য করবো? এগুলো লক্ষণ দেখে বিচার করা, কারণে যেতে না পারা। দারিদ্র্য কীভাবে দূর করা যাবে, এটা নিয়ে অনেক কথা। কিন্তু দারিদ্র্য কি কারণে হচ্ছে, তা নিয়ে আলোচনা হয় না। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, বাংলাদেশ সরকার কেউই এ নিয়ে আলোচনায় রাজি নয়।
২
একটা গল্প রয়েছে- ঘরে সূঁচ হারিয়েছে সে তা রাস্তায় গিয়ে খুঁজছে। কারণ রাস্তায় আলো আছে। যেখানে সূঁচটা হারিয়েছে সেখানে সে খোঁজে না। তাদের দশাও তাই। সংসদে একটা উচ্চকক্ষ যোগ করতে হবে। এটাই কি প্রধান কারণ দেশের ক্ষতির? দেশে গণতন্ত্র না থাকার প্রধান কারণ কি জিজ্ঞাসা করতে তারা রাজি নন। নতুন ধনদৌলত সঞ্চয়ের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শিল্প গ্রুপগুলো কীভাবে এত ধন সঞ্চয় করলো? কীভাবে গড়ে উঠলো? এরা দেশের গণতন্ত্রকে কীভাবে প্রভাবিত করছে? কোন পার্টিকে চাঁদা দিচ্ছে? কোনো সংস্কার কমিশনে তার উল্লেখ নেই। উল্লেখ আছে, আমরা কি প্রধানমন্ত্রী শাসিত থাকবো, ৭০ ধারা থাকবে কি থাকবে না ইত্যাদি। এগুলোকে আমি খারাপ বলছি না। এগুলো সব অর্ধসত্য। তাদের বোধদয় হয়েছে সংসদে এককক্ষ থাকার কারণে বুঝি একনায়কতন্ত্রের সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু এই এককক্ষেরই নির্বাচন হয়নি।
তিনি বলেন, পৃথিবীর অর্ধেক দেশ আছে যাদের সংসদ এককক্ষবিশিষ্ট। যেসব দেশ ফেডারেল গোত্রের যেমন ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য তারা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। কোনো দেশ রাজাপ্রধান, কোনো দেশ প্রেসিডেন্ট প্রধান। লক্ষণটা কি? তারা বলছেন, এককক্ষ থাকার কারণে গণতন্ত্র ব্যাহত হচ্ছে। হতে পারে একদলীয় ব্যক্তি যখন সংসদের প্রধান, প্রধানমন্ত্রী এবং পার্টি প্রধান হন তখন তা হতে পারে। এটা রোধ করার অনেক পথ আছে। দ্বিকক্ষের বিরোধী আমি নই। কিন্তু এটা আমাদের প্রধান সমস্যা না। প্রধান সমস্যা হচ্ছে- স্থানীয় শাসন বলতে কিছু নেই। যেমন ঢাকা একটা বড় শহর যার মেয়রকে বলা যেতে পারে মন্ত্রীর থেকেও শক্তিশালী। চট্টগ্রাম কি ছোট শহর? তাহলে তাকে মন্ত্রী পদমর্যাদা কেন দেয়া হবে না। বলা হয় অমুক খারাপ লোক, সন্ত্রাসী। তাহলে আপনি খারাপ লোককে মেয়র নির্বাচিত করেছেন কেন? এটাকেই বলে স্বৈরাচার।
স্বৈরাচার নিয়ে একটা বিখ্যাত সংজ্ঞা আছে। ফ্যাসিবাদ সেটা নয় যে, সে কতো লোককে হত্যা করেছে। ফ্যাসিবাদ সে কোন পদ্ধতিতে হত্যা করেছে তার মাপে মাপতে হয়। বিনা বিচারে হত্যা, গুম, টর্চার করে হত্যা, ধরে নিয়ে ভারতের ওপারে পার করে দেয়া ইত্যাদি। অনেকেই বলে থাকেন, বাংলাদেশের শেখ হাসিনার শাসনকে ফ্যাসিবাদ বলা জাস্টিফাইড কিনা? আমি বলবো শতভাগ জাস্টিফাইড। সামরিক শাসক আসলে সংবিধান বাতিল করে। শেখ হাসিনা করলো সংবিধানের ভেতর থেকে খেয়ে ঝাঁঝরা। একটা উদাহরণ দেই, সংবিধানে লেখা আছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। কিন্তু দেশের উচ্চতম আদালতে বাংলা চলে না। ডেইলি স্টার ইংরেজি মিডিয়াম পাস করা শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দেয়। তারা চায় ইংরেজি মিডিয়ামে, বৃটিশ সিলেবাসে পড়ুক। এটা দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে অনাস্থা জানানো। তারা তো এসএসসি, এইচএসসি পাস করাদের সংবর্ধনা দিচ্ছেন না। তারা এ লেবেল, ও লেবেলকে দিচ্ছেন।
৩
অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, হাসিনার আমলে কীভাবে সংবিধানকে ফোকলা করে দেয়া হয়েছে এটা আমরা হাসিনার আমলেই বহুবার বলেছি। অনেকেই বলতেন, ধরে নিয়ে যাবে। ধরলে ধরবে, ধরা তো সম্মানের বিষয়। ফ্যাসিবাদের আরেকটা ধরন হচ্ছে ধরবে কিনা তার গ্যারান্টি নেই। হয়তো দেখা যাবে লাশ পড়ে আছে তুরাগের চরে। ফ্যাসিবাদ হচ্ছে, ভয়ে রাখা, ভয়ে থাকা। ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তির জন্য আমরা কি করতে পারি? প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়া মোটেও সমাধান নয়। প্রধানমন্ত্রীর পদ্ধতির ভেতরে কি কি সমস্যা ছিল সেগুলো খুঁজে বের করা। অনেকেই আবার সমালোচনা করেন, ড. আলী রীয়াজ তো বিদেশ থেকে আসছেন। এসব কথা অন্যায্য। বলা উচিত ওনার যুক্তির ত্রুটিটা থাকলে কোথায় আছে? সবাইকে নিয়ে ঐকমত্য করার প্রশ্নটা কোথায়? বলা হচ্ছে কোনো ব্যক্তি একইসঙ্গে দলের প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না? এগুলোকে আমি তুচ্ছ কথা মনে করি। কারণ, ছদ্মবেশেও শাসন করা যায়। যেমন ইয়াজউদ্দীন, মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনকে প্রেসিডেন্ট করে দোর্দণ্ড প্রতাপে দেশ চালানো যায়।
পাকিস্তানে উপরের কক্ষ, নিচের কক্ষ আছে। কিন্তু সেখানেও নানান রকম পরিবর্তন হয়। আমেরিকার এক আমলা নাকি তারেক আলীকে বলেছিলেন, পারভেজ মোশাররফ আমাদের এখানে আসতেন, নানা বিষয়ে একমত হতেন, পাকিস্তানে গিয়ে ঠিক তার উল্টোটা করতেন। বলতেন, প্রতিশ্রুতি রাজনৈতিক কারণে পালন করতে পারছি না। আর আসিফ জারদারি বলার আগেই বাস্তবায়ন করতেন। ঐকমত্য কমিশন লক্ষণ নিয়ে টানাটানি করছে, আসল কারণ বের করতে পারছে না।
অবৈধ ক্ষমতার উৎসে হাত দিতে হবে। উৎসটা হচ্ছে, দেশের পুঁজির আদিম সঞ্চয়ন প্রক্রিয়াটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পুঁজি ধর্মঘট যখন চলে, তখন পুঁজি প্রত্যাহার করে বিনিয়োগ বন্ধ করে রাখে। এখন যেমন বিনিয়োগ কমে গেছে। বিদেশিরা আসছে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, অতিরিক্ত ভারতের উপর নির্ভরশীলতা, বিদেশি বাজারের উপরে নির্ভরশীলতা। যেভাবে আমরা অর্থনীতি গড়ে তুলেছি, যেটাকে নিওলিবারেলিজম বলে। মানে রপ্তানি করা আয়ের উপর ভিত্তি করেই মাত্র অন্যান্য জিনিস আমদানি করতে পারবেন। দেশীয় বাজার বলতে এদেশে শতকরা ৫০ ভাগও কিছু গড়ে ওঠেনি। এরকম দুর্বল অর্থনীতি নিয়ে কোনো স্বকীয় রাজনৈতিক তত্ত্ব তৈরি করা যায় না।
তিনি বলেন, ছয়টা সংস্কার কমিশন অনেক কথা বলেছে। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন রিপোর্টের বিষয়ে বলেন, সেখানে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা আছে। কিন্তু সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে কোনো কথা নেই। শুধু সরকার আর সংবাদপত্রের কো-রিলেশন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসেছে রক্তাক্ত গণ-অভ্যুত্থানের ফলাফলস্বরূপ। এই সরকার গণ-অভ্যুত্থানের পুরোপুরি প্রতিনিধিত্ব করে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এই সরকারের অধিকাংশ লোকই গণ- অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। এখানে আরও অনেক লোক আছে। তাদের নেয়া হয়েছে বিশেষজ্ঞ আকারে। তারা যা করছেন তারা অক্ষমতার প্রকাশ। যারা সরকারে এসেছেন সবাই অভিজ্ঞ নন। সব দায়দায়িত্ব প্রধান উপদেষ্টাকে নিতে হবে। প্রথমদিকে, তিনি ক্ষমতা নেবেন কিনা তা নিয়েও চিন্তা করেছেন। এরপর শপথ নিয়ে নিজের বিরুদ্ধে রুজু মামলাগুলো প্রত্যাহার করেছেন। তার সব কাজকে আমি খারাপ বলবো না। তার ম্যান্ডেট গণ-অভ্যুত্থান। গণ-অভ্যুত্থানের যারা সাক্ষাৎ নেতা, যেমন নাহিদ ইসলাম- তারা ড. ইউনূসের কথা বলেছেন। অন্যরা মেনে নিয়েছেন। আমরা নৈরাজ্য থেকে মুক্তি পেয়েছি। এখন যেটা চলছে সেটা মবোক্রেসি। মব হচ্ছে কারণ জনগণ ঐক্যবদ্ধ নয়। এক দল আরেক দলের বিরুদ্ধে মারামারি করে। এখন আওয়ামী লীগ গৃহযুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে।
বিভিন্ন দেশের মবের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, রুশবিপ্লবী লেনিনকে কিন্তু গুলি করেছিল মবেরই একজন লোক। এই মব নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না কারণ অব্যবস্থিত চিত্ততা বা আনডিসাইটেড মাইন্ডের জন্য। সব বিপ্লব তার প্রতিপক্ষ তৈরি করে। অবাক লাগে নবনীতা চৌধুরীর মতো সাংবাদিক কেন দেশ ছেড়ে পালালেন? তাদের বিদেশে পালিয়ে গিয়ে কেন প্রোপাগান্ডা করতে হচ্ছে? গণহারে মামলা হচ্ছে এই সরকারের ত্রুটি। এগুলো সরকার স্বীকারও করেছে। শেখ হাসিনা যেসব টেনডেন্সি দমন করেছিলেন সেগুলোর এখন বিস্ফোরণ হচ্ছে। শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই জঙ্গি বলা শুরু করেছিলেন। তাদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টির চেষ্টা করেছিলেন। কওমী জননী উপাধি নিয়েছিলেন তিনি। শেষ মুহূর্তে জামায়াত নিষিদ্ধ করেছিলেন। জামায়াতের বহু নেতাকে যুদ্ধাপরাধী হওয়ার কারণে শাস্তি দিয়েছেন। এসব কারণে একদম বন্ধ আবহাওয়া তৈরি হয়েছিল। দেশে যেহেতু গণতন্ত্র ছিল না এজন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারগুলো যে নিরপেক্ষ তা তিনি প্রমাণ করতে পারেননি। বেশ কিছু স্ক্যান্ডাল তৈরি হয়েছিল, একজন বিচারপতিকে সরিয়েও দিতে হয়েছিল। বিপ্লবের ভ্যাকুয়ামটা হচ্ছে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের। কারণ তাদের দেশব্যাপী কোনো সংগঠনই ছিল না। যার কারণে সম্ভাবনা ছিল নৈরাজ্য তৈরি হওয়ার অথবা সামরিক শাসন জারি করার। সামরিক বাহিনী সম্পূর্ণ কলঙ্কমুক্ত ছিল না। অন্তত তাদের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা ছিলেন। ডিজিএফআই কলঙ্কিত হয়েছিল গুম, খুন, আয়নাঘরের সঙ্গে জড়িত হয়ে। তাদের পায়ের তলায় মাটি ছিল না। জনরোষ সামরিক বাহিনীকেও ভাসিয়ে নিয়ে যায়- এটা তার প্রমাণ। এই শূন্যতা পূরণের জন্য তারা কতোগুলো শক্তির উপর নির্ভর করেছে।
সংগঠিত শক্তি হচ্ছে বিএনপি ও জামায়াত। বিএনপি বড় দল, কিন্তু জামায়াত অধিক সংগঠিত। এই কারণে নানারকমের মব তৈরি হচ্ছে। এর পাশাপাশি কিছু ইসলামিক শক্তি রয়েছে, তারা সক্রিয় হয়েছে। পিপল আর মব এক জিনিস নয়। পিপলের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে অনেক মব হয়েছে। এখন সুবিধাবাদী একটা গোষ্ঠী শাপলা বনাম শাহবাগ- এরকম কিছু কৃত্রিম বিভাজন তৈরি করছে। আমার মনে হয়, এগুলো ধোপে টিকবে না। যেগুলোকে মব বলা হয়েছে। তাদের আমি বলবো বুদবুদ। তবে এগুলো লক্ষণ হিসেবে ভালো না। দেশে নানাধরনের যে শক্তি আছে তাদের মোকাবিলা করতে হবে রাজনৈতিক পদ্ধতিতে।
৪
ছাত্র নেতাদের বিষয়ে বলেন, তাদের বয়স কম হতে পারে কিন্তু তাদের রাজনৈতিক সাহসের প্রশংসা না করলে অন্যায় করা হবে। রাজনীতি হচ্ছে শেষ বিচারে ক্ষমতার জন্য লড়াই। আমি একদিন বলেছিলাম, উপদেষ্টা পরিষদে ছাত্রদের শতকরা ৫০টা আসন নেয়া উচিত। কিন্তু তাদের মাত্র দুটা বা তিনটা আসন দিয়েছে। পুরনো সরকারের যে প্রেসিডেন্ট তাকে রাখার যৌক্তিকতা কি? সংসদ বিলুপ্ত হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে গেছেন। ওই সরকার বিলুপ্ত হয়েছে। সংসদ বিলুপ্ত হলে ওই সংসদের স্পিকার আর থাকে না। দেশ চলছে প্রেসিডেন্টের অর্ডিন্যান্সে অথচ সেই প্রেসিডেন্টেরই কোনো বৈধতা নেই। সুতরাং দেশ একটা নৈরাজ্যের মতো চলছে। আমরা ধারাবাহিকতায় চলছি। ১৯৯০ সালে বলতো, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় চলতে হবে। বর্তমান বিপ্লবের অসম্পূর্ণতাটা এখানেই। বিপ্লবটাকে আর বিপ্লব বলা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, এটাকে আমি প্রতিবিপ্লব বলবো না। আমি বলবো, বিপ্লব আপস করেছে। দুই বা তিনজন ছাত্রকে স্থান দেয়া হয়েছিল সরকারে। তারা একজনও না থাকতেন; যেটাকে বলা হয় প্রেশার গ্রুপ সেটা হতেন তাহলেও তাদের সনদ বাস্তবায়িত হতো। বিপ্লব যে হয়নি তার প্রমাণ তথাকথিত জুলাই সনদ চূড়ান্ত হতে অনেক বেশি সময় লেগেছে।
একাত্তরে আওয়ামী লীগ সরকারের কোনো প্রস্তুতি ছিল না স্বাধীনতার জন্য। ইন্দিরা গান্ধীর অনুমতি নিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে হয়েছে। ১৯৭১-এর ২৫শে মার্চ থেকে ১০ই এপ্রিল পর্যন্ত এত সময় লাগলো? এটাতেই প্রমাণ, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের জন্য দল হিসেবে প্রস্তুত ছিল না। ব্যক্তি হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ থাকতে পারেন। অনেকে বলবেন, তিনি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কেন দেখা করলেন? দেখা করা ছাড়া উপায় কি? আওয়ামী লীগের সময় ছিল। ’২৪ বিপ্লবীদের সময় ছিল না। তাদের যখন ধরে নিয়ে যেয়ে পেটানো হলো: তারা আন্দোলন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাদের রাজনৈতিক সংগঠন না থাকলেও গোটা দেশ তাদের নেতৃত্বের অপেক্ষায় ছিল। জিয়াউর রহমান যেভাবে ’৭১ সালে নেতা হয়েছেন শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে। তাজউদ্দীনও বলেছিলেন, জিয়াউর রহমানের বক্তব্য শুনে তিনি উজ্জীবিত হয়েছেন। যিনি পরবর্তীতে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হবেন, যার অধীনে তিনি সেক্টর কমান্ডার হবেন তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু ওই বিপ্লবের মুহূর্তে সেক্টর কমান্ডার নেতৃত্ব দিয়েছেন। এখানেও তাই। এই বিপ্লবের প্রকৃত নেতা নাহিদ ইসলাম। ক্ষমতায় নাহিদ ইসলামের প্রধান উপদেষ্টা হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বাস্তবতা এই: তিনি ইউনূসকে ডেকেছেন। বলেছেন, আমি পারবো না। নাহিদের চেয়ে সামান্য বেশি বয়স ছিল ফিদেল ক্যাস্ট্রোর। ক্যাস্ট্রোর হাতে বন্দুকও ছিল। ফিদেল ক্যাস্ট্রো প্রথমে আরেকজনকে প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করেছিলেন। এই আন্দোলনের কাঠামোগত দুর্বলতা হলো, জনগণ যাদের নেতা মেনে হাসিনাকে পরাজিত করেছে তারা নিজেরাই নেতৃত্ব নিতে সাহস করেননি। তারা আরেকজনকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে এসেছেন। তাদের সঙ্গে বোঝাপড়া আছে। এক বছর পর মনে হচ্ছে ক্ষমতা আবারো পুরনো নহরে, পুরনো চ্যানেলে প্রবাহিত হচ্ছে। বড় আকারে মৌলিক পরিবর্তন আশা করা যাবে না। আহা! যে অন্যায় হাসিনা করেছে এই অন্যায় ’৭১ সালে পাকিস্তান আর্মিরাও করেনি।
৫
গত বছরের ৩১শে জুলাই ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বক্তব্যে আইয়ুব খানের উন্নয়ন দর্শন ও শেখ হাসিনার উন্নয়ন দর্শন আমি বর্ণনা করেছিলাম। কিন্তু আইয়ুব খান এত লোক খুন করেনি। শুধু ৩৬ দিনের কথা বলছি না, রাজত্বকালে যত খুন করেছে, যত জঙ্গি নাটক করেছে- তা আইয়ুব খানকে করতে হয়নি। শেখ হাসিনাসহ যারা হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী তাদের বিচার না করলে বিপ্লব ব্যর্থ হবে। কিন্তু তাদের বিচার হলে বিপ্লব অর্ধেক সফল হবে। বাকিটা বাস্তবায়ন করার জন্য জনগণের মূল আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে হবে। মূল আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে- জনগণ তাদের অধিকার ফেরত চায়। যে সরকারই হোক সরকার তাদের অধিকার বদলাতে পারবে না। মাইনোরিটিদের অধিকার বদলাতে পারবে না। মেজোরিটির শাসনকে গণতন্ত্র বলা হয়। কিন্তু মেজোরিটির জোরে মাইনোরিটির অধিকার লঙ্ঘন করা যাবে না। ভারতে এখন হিন্দুত্ববাদ চলছে। আমি মৌলভীদের সম্মানের সঙ্গে বলি আপনারা ভারতে যদি সেক্যুলারিজম চান তো বাংলাদেশে চান না কেন? বাংলাদেশে যেহেতু মুসলিম মাইনোরিটি না তাই সেক্যুলারিজম চান না। বাংলাদেশ উপমহাদেশে তখনই নেতৃত্ব দিতে পারবে যখন মাইনোরিটি, মেজোরিটি ভাগ থাকবে না। হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টান বলে যাতে কাউকে নির্যাতন করা না হয়। এমনকি কাদিয়ানি বলেও যাতে নির্যাতন করা না হয়। আমাদের দরকার নাগরিক অধিকার।
ড. সলিমুল্লাহ খান বলেন, শেখ হাসিনার আরেকটা ফ্যাসিবাদী চরিত্রের নজির হচ্ছে রাষ্ট্রভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় উন্নীত না করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা বলা। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন হয়েছিল। শহীদ দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করে বোঝানো হয়েছে এটা একটা বিশাল অর্জন। কোনো লেখককে যদি বলা হয়- মহিলা লেখক। তা ওই লেখকের ডিমোশন। এটাও একটা ফ্যাসিবাদের প্রকাশ।
গণতন্ত্র চাইলে সবাইকে ভোটাধিকার দিতে হবে। ভোটের দিন মারামারি না হয়, কেউ যাতে কারও ভোট কেড়ে নিতে না পারে। এককক্ষ হোক, দ্বিকক্ষ হোক সেটা বড় কথা নয়। প্রত্যেকটা স্থানীয় প্রশাসনের কাছে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিতে হবে। আমার একটা প্রস্তাব আছে- পিআর নয় প্রয়োজন স্থানীয় প্রতিনিধি পদ্ধতি। বাংলাদেশের ৬৪ জেলা আছে। প্রত্যেক জেলা থেকে ২ জন করে সদস্য নেয়া হবে। ১২৮ জন সদস্য নিয়ে একটা জাতীয় পরিষদ হবে। ঢাকায় জনসংখ্যা বেশি, তার সংসদীয় আসন সংখ্যা যাই হোক উচ্চকক্ষে সদস্য দুইজন হবে। কুড়িগ্রাম থেকেও দুইজন হবে। তাহলে উন্নয়নের বৈষম্যে লাগাম টানা হবে। উচ্চকক্ষ যা হবে সেটা হবে সরাসরি ভোটে। এখন এনজিওতন্ত্র বেশে দানা বাঁধছে মেরিটের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষ গঠন করা নিয়ে। এটা সাংঘাতিক ফ্যাসিবাদে যাবার পথ। বিনাভোটে বা তথাকথিত পিআর পদ্ধতিতে ভোটে উচ্চকক্ষে নির্বাচনের চক্রান্তটা অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল, গণতন্ত্রহীন। উচ্চকক্ষ গঠিত হলে সেটা হতে হবে জেলা অনুসারে। প্রতি জেলা থেকে ২ এর জায়গায় ৩ হতে পারে। একসঙ্গে সকল কক্ষের নির্বাচন করা যাবে না। আলাদা আলাদা সময়ে নির্বাচন হতে হবে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য এটা ভালো পথ হতে পারে। উচ্চকক্ষের বিষয়টি এনজিওগুলো দীর্ঘদিন ধরে প্রমোট করছে। এটা সুকৌশলে আলী রীয়াজের ঐকমত্য কমিশনও চালানোর চেষ্টা করছেন।
তিনি বলেন, ভারত এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো প্রভেদ দেই। ওবায়দুল কাদের সেনাপ্রধানকে মীর জাফরের সঙ্গে তুলনা করে ফেলেছেন। আওয়ামী লীগের বড় পরাজয় হচ্ছে নৈতিক পরাজয়, হয়তো দৈহিক পরাজয় হয়নি। এসবি’র রিপোর্ট বলছে, দেশে একটা গৃহযুদ্ধ হতে যাচ্ছে। এসবি’র এক পরিচিত লোক আমাকে বলেছিলেন, শেখ হাসিনার আমলেও আন্দোলন হতে যাচ্ছে বলে তিনি রিপোর্ট দেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করেনি। আওয়ামী লীগ ভারতের পার্টি এবং সেটা বিজেপি-কংগ্রেস একসঙ্গেই প্রমাণিত হয়েছে। বিএনপিও এক্সপোসড হয়েছে। বিএনপি যে একটা প্রো-ইন্ডিয়ান পার্টি সেটাও প্রমাণিত পেয়েছে। শুধু সালাহউদ্দিন নয়, পুরো বিএনপি চাইছে যাকে প্রয়োজন তাকে তোষণ করে ক্ষমতায় যাওয়া। আওয়ামী লীগ এখন রটাচ্ছে এই আন্দোলনটা আমেরিকা ঘটিয়েছে। যেটা ডাহা মিথ্যা কথা। প্রকৃতি শূন্যতা সহ্য করে না। বাংলাদেশে এখন নতুন আন্তর্জাতিক খেলা চলবে এর মধ্যে আমেরিকা আছে, চীন আছে, ভারত তো আছেই। রাশিয়া দূরে হলেও ইনভলব। আওয়ামী লীগের গায়ের কাপড় খুলে গেছে। দলটা পুরোপুরি ভারতনির্ভর। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছিল মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে। ’৫৫ সালে মুসলিম শব্দটি পরিত্যাগ করেছিল তারা। আওয়ামী লীগকে প্রথম হত্যা করে কে? শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি এটার নাম বাকশাল দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা নামটা বদলাননি। কিন্তু চরিত্র একই ছিল।
ইতিহাসের বিচারে শেখ হাসিনার অপরাধের দায় আওয়ামী লীগের প্রত্যেকটা কর্মীকে নিতে হবে। তাকে কেন্দ্র করে কীসব স্লোগান দেয়া হয়েছে! আওয়ামী লীগাররা হাততালি দিয়েছে। প্রত্যেককে ইতিহাসের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কথা বলছি না। অন্যদিকে বিএনপি ১৬ বছর আন্দোলন করেছে। অনেক নির্যাতন, অনেক হত্যাকাণ্ড হয়েছে। কিন্তু তারা আখেরে ধরে রাখতে চাইছেন পুরনো সংবিধান। যেটাতে তাদের নেতাকে প্রধানমন্ত্রী ও দলনেতা রাখতে চায়। যদিও সেটাতে তারা ছাড় দিচ্ছেন- পরে যে তারা সরে যাবেন না- এটার গ্যারান্টি কি?
তিনি বলেন, জুলাই সনদের মানে হচ্ছে ‘লেজিটেমেসি অব জুলাই রেভ্যুলুশন’। জুলাই সনদ না হলে এদের হাসিনা এসে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারবে। সুতরাং ইট শুড বি লিগ্যালাইজড। শুধু অর্ডিনেন্সের মাধ্যমে নয়, সর্বদলীয়ভাবে হলে ভালো। এটা এরকম হবে যে শেখ হাসিনাকে উৎখাত করা ছিল জাতির পক্ষে কর্তব্য। যারা অংশ নিয়েছে তারা নায়ক। কিন্তু একদল এটা নিয়ে পড়ে আছে। ’২৪ কি দ্বিতীয় স্বাধীনতা? ’২৪ কি ’৭১ বিরোধী? হ্যাঁ, এখানে জামায়াতের একটা টেনডেন্সি আছে; ’৭১কে অস্বীকার করার। জামায়াতের বিচার হয়েছে কেন? তারা একটা সামরিক শক্তি গঠন করেছিলেন আল বদর নামে। নেজামে ইসলাম ও যারা এখন কওমীপন্থি হয়েছেন তারা গঠন করেছিলেন আল শামস। রাজাকার, আল বদর, আল শামস এই পার্টিগুলো যারা করেছেন তাদের বিচার হয়েছে। আমার মনে হয় জামায়াতের পক্ষ থেকে মনে করা হচ্ছে ’৭১ বিষয়ে তারা এমবিগুয়াস। জামায়াতের একটা তরুণ সমাজ আছে। যারা মনে করে আমার বাংলাদেশ নামকরণের মধ্যেই একটা অনুশোচনা আছে। কিন্তু তারা কি কারণে ক্ষমা চেয়েছেন সেটা পরিষ্কার না। জামায়াতের ’৭১ বিষয়টি নিয়ে স্পষ্টকরণ করা উচিত। তাতে নতুন যাত্রা হতে পারে।
দক্ষিণপন্থা যোগের বিষয়ে তিনি বলেন, শেখ হাসিনাবিরোধী আন্দোলনে মূলত মধ্যমপন্থার লোকেরা বেশি ছিল। তাতে বামেরও কিছু হিস্যা ছিল। বামেদের রাজনীতি হচ্ছে না। তারা হয় নিষ্ক্রিয় কিংবা শেখ হাসিনার সহযোগীতে পরিণত হয়েছিলেন। যেমন, সিপিবি, বাসদ। তাদের রাজনীতিতে আমরা হতাশ। বামের রাজনীতি বলতে গণসংহতি আন্দোলন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, নাগরিক ঐক্য এনারা মধ্য বামপন্থি। বিএনপিতে ডান-বাম দুটোই আছে। বিএনপিকে মধ্যপন্থি ধরতে পারেন। ডানে আছে জামায়াত। তাদেরও ডানে আছে ইসলামী ব্যানার বহনকারী দল। আগে তারা কথা বলতে পারেনি। তাদের শেখ হাসিনার আমলে দমন করা হয়েছে। যেহেতু তারা বিপ্লবে অংশ নিয়েছেন সরাসরি কিংবা পরোক্ষ সেহেতু তাদের কথা আপনাকে শুনতেই হবে। তাদের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ করলে লাভ হবে পরাজিত ফ্যাসিস্টদের। বাংলাদেশকে একটা স্থিতিশীল করতে চাইলে আমরা গৃহযুদ্ধ চাই না। তবে আমরা ভারত বা পাকিস্তান কারও অধীনস্থতা মেনে নিতে প্রস্তুত নই। ভারতকে মনে রাখতে হবে তার পেছনে চীন লেগে আছে। বাংলাদেশের সঙ্গেও লড়াই করবে, চীনের সঙ্গেও লড়াই করবে এটা ভারতের জন্য সহজ নয়। ভারত যখন ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশের পানি বন্ধ করেছে; ভেবেছে এটা তার অধিকার। আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হলেও ভারত পানি দেয়নি। কিন্তু চীন যখন বাঁধ দিয়েছে তখন মাথাব্যথা হয়েছে। এখন ভারত বাংলাদেশকে টানতে চাইছে। চীন বাঁধ দেয়াতে ভারত-বাংলাদেশ দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটা শক্তের ভক্ত নরমের যম।
তিনি বলেন, নারীদের স্বাধীনতা নিয়ে বিরোধিতা নতুন নয়। এটা পাকিস্তান আমলেও ছিল। যখন পরাধীন ছিলাম তখন পরাধীনতার বিরুদ্ধে আমরা সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছি। পাকিস্তান আমলে ইয়াহিয়া খান নির্বাচনের সময় কয়েকটা আইনগত কাঠামো গঠন করেছিলেন। ইয়াহিয়া খান একটা বিপ্লবই করেছিলেন। এক মাথা এক ভোট। চার মাসের মধ্যে সংবিধান রচনা করতে হবে। এমন কোনো আইন করা যাবে না কোরআন-সুন্নাহর বিরোধী হবে। পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্র হবে। এগুলো শেখ মুজিব মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু ’৭০ নির্বাচনে এগুলোর কথা আর কেউ বলে না। মানে ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে। ইসলামী প্রজাতন্ত্র করার পক্ষে তো তিনি ছিলেন না। তবু মেনেছিলেন কারণ না মানলে তো আর নির্বাচনে যেতে পারবে না। মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘ভোটের বাক্সে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ ভাসানীপন্থিরা স্বাধীনতার স্লোগান দিলেও শেখ মুজিব দিতে পারেননি। বাংলাদেশ বহু জাতির দেশ। আমরা বলছি সকল জাতির অধিকার রাখতে হবে। ঠিক তেমনি সকল ভাষার অধিকার রাখতে হবে। চাকমা, গারো, মারমা, সাঁওতাল সবার অধিকার-ভাষা রাখতে হবে। নারীরা কিন্তু সংখ্যাগুরুদের অংশ।
প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্র আনতে চাইলে শিক্ষায় পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় বাংলা ভাষা চালু করতে হবে। সকল ধর্ম বাংলা ভাষায় শেখাতে হবে। কেন বাংলাদেশের কিন্ডারগার্টেন বা স্কুলগুলো ইংরেজি মাধ্যমে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অন্য বিষয়। বর্তমান সরকার শিক্ষা নিয়ে কোনো কমিশনই গঠন করলো না। ভবিষ্যতে হবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। বাংলাদেশে কয়েকশ’ বিলিয়নিয়ার হয়েছে। দেশকে নিয়ন্ত্রণ করছে তারাই। তারা মিডিয়া, করপোরেট, আন্তর্জাতিক পুঁজি নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে ইংরেজি মাধ্যম চালু রাখা। শিক্ষা ব্যবস্থায় যে ব্যয় করছে সরকার তা লজ্জাজনক। মাত্র ২ শতাংশ। এটা ১০ শতাংশে না গেলে ব্যাপক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করতে পারবে না। আমাদের দেশে ৩৫ রকমের প্রাথমিক শিক্ষা রয়েছে। যেকোনো রকমের প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করলেই সে নিজ উদ্যোগে বই পড়বে। সুশিক্ষিত ব্যক্তি মানেই স্বশিক্ষিত। স্কুলে কয়েকদিন থাকা মানে জেলখানায় থাকা তো। জেলখানায় থাকার একটা উপকারও আছে। জীবনে শৃঙ্খলা চলে আসে।
তিনি বলেন, সব থেকে বড় সংস্কার করা উচিত ছিল সবার জন্য বিনা পয়সায় উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ার সুযোগ করে দেয়া। এটা হবে সরকারি ব্যবস্থাপনায়। পরিচালনা হতে পারে বেসরকারি। যারা অর্থের অভাবে পড়তে পারে না তাদের পরিপূর্ণ বৃত্তি দেয়া উচিত। দেশে ‘এ’, ‘ও’ লেবেল নিষিদ্ধ করা উচিত। ইংরেজি মিডিয়াম উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা উচিত। মাদ্রাসা ছাত্ররা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসছে। পশ্চিমবঙ্গের মাদ্রাসায় হিন্দুরাও পড়তে পারে। ওখানে মাদ্রাসা হাইস্কুলের মতো। আরবি, ফারসি বিষয় আছে। পড়লে পড়বেন না পড়লে নেই। আমাদের দেশে ইংরেজি পড়ানো বাধ্যতামূলক। ২০০ নম্বরের ইংরেজি না পাস করে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করতে পারছে না। কিন্তু গণিত কেন ইংরেজিতে পড়াচ্ছেন? ইংরেজি মিডিয়ামে কেন ভারতের বই পড়াচ্ছেন? নারীদের অধিকার আসবে তখনই যখন গণতন্ত্রের বিজয় হবে। নারীদের নিয়ে যে আলোচনা এগুলো মূল সমস্যা, গণতন্ত্রের সমস্যা লুকানোর জন্য মুখরোচক আলোচনা। মেয়েদের ভাগ্য মেয়েদেরই নির্ধারণ করার অধিকার দিতে হবে।
শেষ কথায় এই চিন্তাবিদ বলেন, ইতিহাসে যত বিপ্লব দেখেছি কোনো বিপ্লব সম্পূর্ণ ব্যর্থ বা সম্পূর্ণ সফল হয়নি। বিভিন্ন বিপ্লবের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, বাংলাদেশে এমন কোনো পরিপক্ব ধনিক শ্রেণি তৈরি হয়নি যারা জনগণের উপর কর্তৃত্ব করতে পারেন নৈতিক অধিকারে। তারা এজন্য একটা পরিবারের উপর নির্ভর করেন। আমার বাবা দেশটা স্বাধীন করে দিয়েছে। তার মানে ক্ষমতায় এসেছেন বাবার অধিকারে, নিজের অধিকারে না। একইভাবে বিএনপিও তাই। এটাই বিপ্লবের ব্যর্থতা।
আমরা ’৭১-এ আংশিক সফল হয়েছি। একটা দেশ পেয়েছি, একটা পাসপোর্ট পেয়েছি। কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। ছদ্মবেশী রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেছি। পরিবারতন্ত্র দক্ষিণ এশিয়ায় আছে। আমি বিপ্লব নিয়ে রঙিন স্বপ্ন দেখি না। ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকার যেন থাকে। ফ্যাসিবাদ যাতে না ফিরে আসে।
’৭২-এর সংবিধান পরিবর্তন করা ছাড়া কোনো পথ নেই। অবাক কাণ্ড। বর্তমান সরকার এই সংবিধান বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জুলাই বিপ্লব আংশিক সফল হয়েছে। কারণ আমরা ’৭২ এর সংবিধান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারছি। ’৭১-এর এপ্রিল সনদের আলোকে ’২৪-এর জুলাই সনদ বহাল হতে হবে। ইতিহাস এটাকে প্রগতি বলে। আমি অবশ্য প্রগতিতে বিশ্বাস করি না। আমি বলি, ইতিহাসে গতি আছে, প্রগতি নেই। আর বিপ্লব কখনো ব্যর্থ হয় না। অন্য বিপ্লবের পথ প্রশস্ত করে।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কাজল ঘোষ ও পিয়াস সরকার