সাম্য ও অধিকার ভিত্তিক ছাত্র রাজনীতির উন্মেষ এবং রাষ্ট্র পুনর্গঠনের অঙ্গীকার নিয়ে ২০২৩ সালের ১৬ই জুন আত্মপ্রকাশ করেছে ‘বাংলাদেশ ছাত্রপক্ষ’। জুলাই অভ্যুত্থানে এই সংগঠনের নেতাকর্মীদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। সম্প্রতি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সাথে কথা বলেন ছাত্রপক্ষের কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব আশরাফুল ইসলাম নির্ঝর। আশরাফুল ইসলাম মনে করেন, নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় মাতৃ-সংগঠনের ‘লাঠিয়াল’ হিসেবে কাজের ভূমিকা থেকে বের হয়ে এসে শিক্ষার্থীবান্ধব কাজ করতে হবে বিদ্যমান ছাত্রসংগঠনগুলোর। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক তাওসিফুল ইসলাম-
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বাংলাদেশে এতগুলো ছাত্রসংগঠন থাকতে আপনারা নতুন আরেকটি ছাত্রসংগঠন করার প্রয়োজন মনে করলেন কেন?
আশরাফুল ইসলাম নির্ঝর: বাংলাদেশে অনেকগুলো ছাত্রসংগঠন রয়েছে ঠিকই, কিন্তু শিক্ষার্থীদের মুখপাত্র হিসেবে কোন সংগঠন এখনো নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। বরং তাদের অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর হওয়ার বদলে মাতৃ-ভাতৃ সংগঠনের এজেন্ডা বাস্তবায়ন ও শিক্ষার্থীদের দলদাস বানাতে চায়। এই বাস্তবতায় আমরা উপলব্ধি করেছি যে শিক্ষার্থীদের মুখপাত্র হিসেবে নতুন একটি ছাত্রসংগঠ প্রয়োজন। জাতীয় রাজনীতি থেকে শিক্ষার্থীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সমস্যা সমাধান, শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার এবং শিক্ষার্থীদেরকে নাগরিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করে আগামীর নেতৃত্ব তৈরি হলো আমাদের মুখ্য কাজ।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ২০২৪ এর অভ্যুত্থানের পর ছাত্ররাজনীতির সংস্কারের দাবি উঠেছে। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বললেও কারো বিস্তর রোডম্যাপ নেই। আপনারা কীভাবে আগাচ্ছেন?
আশরাফুল ইসলাম নির্ঝর: বাংলাদেশ ছাত্রপক্ষ তার ঘোষণাপত্রে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের বা সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়ে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছি। আমরা বর্তমানে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সাথে ধারাবাহিক বৈঠক করছি গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে তারা কেমন ছাত্ররাজনীতি চায়। সকলের সাথে মতবিনিময় শেষে আমরা একটি নতুন প্রজন্মের ছাত্ররাজনীতির রোডম্যাপ জাতির সামনে তুলে ধরবো।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানে ছাত্রপক্ষ কী কী উদ্যােগ নিয়েছে?
আশরাফুল ইসলাম নির্ঝর: বাংলাদেশ ছাত্রপক্ষ ছয়টি দফার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। সবগুলোই শিক্ষার্থীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও তাদের সমস্যা সমাধান বিষয়ক। শিক্ষার্থীদের অধিকারের বিষয়ে সচেতন করে গড়ে তুলতে ক্যাম্পাসগুলোতে বাংলাদেশ ছাত্রপক্ষ লিফলেট বিতরণ, পাঠচক্রসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চালাচ্ছে। এছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সাথে মতবিনিময় করে সমস্যাগুলো খুঁজে বের করে সেগুলো নিয়ে ছাত্রপক্ষ সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। উদাহরণ হিসেবে - বলতে গেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সর্বত্র ইন্টারনেট সেবা ও শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে জ্ঞানার্জন সহজতর করবে, এই উদ্যােগকে সামনে রেখে ছাত্রপক্ষ মধুর ক্যান্টিনে বিনামূল্যে ওয়াইফাই সেবা চালু করে। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সম্পূর্ণ ক্যাম্পাসকে বিনামূল্যে ইন্টারনেট সেবার আওতায় আনবেন বলে আশ্বাস দেয়। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে সুপেয় পানির ফিল্টার না থাকায় শিক্ষার্থী ও সাধারণ মুসল্লিরা নিরাপদ পানি পান করতে পারছিল না। ছাত্রপক্ষ বিষয়টি বিবেচনা করে তিনটি ইলেকট্রিক সুপেয় পানির ফিল্টার প্রতিস্থাপন করে বিষয়টি প্রশাসনের দৃষ্টিতে আনে। এভাবেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যােগ নিয়ে প্রশাসনকে চোখে আঙুল দিয়ে শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো তুলে ধরে কাজ করে চলেছে ছাত্রপক্ষ'র সদস্যরা।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বিভিন্ন মিডিয়ায় বাংলাদেশ ছাত্রপক্ষকে এবি (আমার বাংলাদেশ) পার্টির ছাত্রসংগঠন হিসেবে বলা হয়ে থাকে, কিন্তু আপনারা নিজেদেরকে স্বাধীন স্বতন্ত্র ছাত্রসংগঠন বলেন। বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করবেন?
আশরাফুল ইসলাম নির্ঝর: ঘোষণাপত্রে আমরা উল্লেখ করেছি ছাত্রপক্ষ স্বাধীন স্বতন্ত্র ছাত্রসংগঠন। তবে আমাদের একটি উপদেষ্টা পরিষদ রয়েছে। উনারা সমাজে সমাদৃত ও জাতীয় রাজনীতিতে এবি পার্টির সাথে সম্পৃক্ত। তাই হয়ত মিডিয়াগুলো ধারণাপ্রসূত এই কথা বলে। কিন্তু ছাত্রপক্ষ কোন জাতীয় রাজনৈতিক দলের অঙ্গ/সহযোগী/ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন নয়। তবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত ও নীতিগত বৈশিষ্ট্যের কারণে এবি পার্টির সাথে আমাদের পথচলা। এবি পার্টি যদি তার পথ থেকে সরে যায়, তাহলে ছাত্রপক্ষ স্বীয় ঘোষণাপত্রের আলোকেই পরিচালিত হবে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সকল ছাত্রসংগঠনের সংযুক্তি এবং সম্মতিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠে। ৫ আগস্টের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে বেশ কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। আপনাদের সাথে তাদের সম্পর্ক এখন কেমন?
আশরাফুল ইসলাম নির্ঝর: দেখুন, জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সকল দল এবং মতের সাথে আমাদের সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। তবে বর্তমানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্লাটফর্মটি যেহেতু সরকারি ছাত্র সংগঠনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে সেহেতু তাদেরকে জবাবদিহিতায় আওতায় রাখাটা কর্তব্য। পাশাপাশি যেহেতু বিপ্লবের দায়-দেনাও তাদের উপর বর্তায় সেহেতু তাদেরকে সমালোচনা করে সঠিক পথে রাখার চেষ্টা করছি। তারা বর্তমানে খুঁজে খুঁজে যেসব কর্মসূচি ও নীতিমালা বের করছে সেগুলো আমরা আমাদের ঘোষণাপত্রে বহু পূর্বেই বলে এসেছি। তবে তারা তাদের রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করে অন্যান্য ছাত্রসংগঠনগুলোর সাথে বৃহত্তর ঐক্য গড়তে পারতো। তাদের সাথে নৈতিকভাবে আমাদের কোনো দ্বন্দ্ব নেই।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ছাত্ররাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনে আপনাদের নতুন কোনো প্রস্তাবনা আছে?
আশরাফুল ইসলাম নির্ঝর: প্রথমত, ছাত্ররাজনীতিতেও পূর্বের সংস্কৃতি বদলানো সময়ের দাবি। ছাত্রসংগঠনগুলোর কাজ শিক্ষার্থী কেন্দ্রীক হওয়া বাঞ্ছনীয়। সরকার বা মূল দলের লাঠিয়াল হিসেবে ছাত্রসংগঠনগুলোর যে দুর্নাম শিক্ষার্থীদের মাঝে রয়েছে, সেটা থেকে বের হয়ে এসে শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধান এবং শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার ক্যাম্পাসের শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিতকরণে ছাত্র সংগঠনগুলোর ভূমিকা রাখা উচিত।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ছাত্ররাজনীতিতে বিভিন্ন দলে নেতৃবৃন্দের বয়স নিয়ে অনেকবার প্রশ্ন উঠেছে। আপনার মতে কত বছর পর্যন্ত ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত থাকা সমীচীন বলে মনে করেন?
আশরাফুল ইসলাম নির্ঝর: হ্যাঁ, এই প্রশ্নটি একেবারে অমূলক নয়। আমার মতে ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার সাথে সাথেই নেতৃত্ব হস্তান্তর করা উচিত। নেতৃত্ব ধরে রাখার ফলে তরুণরা সুযোগ কম পায়। এতে করে নতুন নেতৃত্ব তৈরি হবে। বাংলাদেশ ছাত্রপক্ষ'র কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বা বিভিন্ন কমিটির নেতৃবৃন্দের দিকে তাকালে দেখবেন, সবাই ২০১৯-২০, ২০২০-২১, ২০২২-২৩ সেশনের শিক্ষার্থী। আমরাও যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি করে ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পূর্বেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কাউন্সিলের মাধ্যমে তরুণদের কাছে নেতৃত্ব হস্তান্তর করে যাব। ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পর একদিনও কেউ ছাত্রপক্ষ'র নেতৃত্ব ধরে রাখতে পারবে না। সকল ছাত্রসংগঠনের ক্ষেত্রেও এটা হওয়া উচিত।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: সারাদেশের স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে আপনাদের ভাবনা কী? নির্বাচন হলে অংশগ্রহণের জন্য আপনাদের প্রস্তুতি কতটুকু?
আশরাফুল ইসলাম নির্ঝর: বাংলাদেশ ছাত্রপক্ষ'র ঘোষণাপত্রে ছয়টি দফা উল্লেখ্য করা হয়েছে। তন্মধ্যে অন্যতম একটি হলো ক্যাম্পাসে ছাত্রসংসদ ভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি চালু করতে হবে। এতে করে দলীয় আধিপত্যবাদী রাজনীতির অবসান ও ক্যাম্পাসে মুক্ত গণতান্ত্রিক চর্চার পথ উন্মুক্ত হবে। তবে হল সংসদে দলীয় প্রার্থী দেয়া যাবেনা, কেন্দ্রীয় সংসদ এবং হল সংসদ নির্বাচন পৃথক দুই দিনে হতে পারে।বয়সসীমা পরিবর্তন সহ বেশকিছু দাবি আমরা ইতিমধ্যে জানিয়েছি। প্রস্তুতির কথা যদি বলেন তবে বলব, ছাত্রপক্ষ'র প্রধানতম লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের সমস্যা নিয়ে কাজ করা সেহেতু অবশ্যই প্রস্তুতি নিচ্ছি আমরা।শিক্ষার্থীদের নিরাপদ ক্যাম্পাস উপহার দিতে ছাত্রপক্ষ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: সম্প্রতি আপনারা বেশ কয়েকটি ছাত্রসংগঠনের সাথে মতবিনিময় সভা করেছেন। কোন কোন ব্যাপারে আপনারা ঐকমত্যে পৌঁছেছেন?
আশরাফুল ইসলাম নির্ঝর: এই বৈঠক এখনও চলমান। অন্যান্য সাংগঠনিক ব্যাস্ততায় এখনও সবগুলো ছাত্রসংগঠনের সাথে বসা হয়নি। খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যেই সভাগুলো শেষ করে গণমাধ্যমে আমরা ঐক্যমত্যের বিষয়টি তুলে ধরব।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ৫ আগস্ট পরবর্তীতে দেশ এখনো পূর্ণভাবে স্থির অবস্থায় আসেনি। সে প্রেক্ষিতে ছাত্রসমাজের কাছে আপনার ম্যাসেজ আছে কোনো?
আশরাফুল ইসলাম নির্ঝর: শিক্ষার্থীদের কাছে আমি যে বার্তাটি দিতে চাই সেটি হলো, ৫ই আগস্টে যে অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে সেটি কোন বিপ্লব নয়। বিপ্লব একটি চলমান প্রক্রিয়া। সুতরাং নিজেদের মধ্যে ক্রেডিট ভাগাভাগি নিয়ে বিভেদ তৈরি না করে বিপ্লব সফল করতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে যেতে হবে। অন্যথায় এদেশে আবারো খুনিদের পুনর্জাগরণ ঘটবে এবং শিক্ষার্থীদের রক্ত বৃথা যাবে, বিপ্লবীদের ফাঁসির দড়ি প্রস্তুত হবে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনাকে ধন্যবাদ।
আশরাফুল ইসলাম নির্ঝর: দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকেও ধন্যবাদ।