
মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান শান্তি ও নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট। মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলের পরিস্থিতি, করিডর নিয়ে তর্কবিতর্ক এবং ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া ও রাফসান গালিব
প্রথম আলো: মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জন্য মানবিক করিডর নিয়ে তর্কবিতর্ক চলছিল। এরই মধ্যে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, এ ধরনের কিছু দেওয়া হচ্ছে না। তবে একই সঙ্গে তিনি বাংলাদেশ থেকে রাখাইন রাজ্যে ত্রাণসহায়তা পাঠানো নিয়ে জাতিসংঘের অনুরোধের কথা বলেছেন। এই দুটির মধ্যে খুব পার্থক্য আছে কি? নাকি বিষয়টি একই?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: আসলে মানবিক করিডর বলি বা ত্রাণ পাঠানো বলি—বিষয়টি একই। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এ ক্ষেত্রে কথার মারপ্যাঁচের আশ্রয় নিয়েছেন। ত্রাণ নিয়ে পৌঁছে দেওয়া মানেই করিডর। সাম্প্রতিক সময়ে ‘করিডর’ শব্দটি যেহেতু নেতিবাচক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, তাই তিনি তা বাদ দিয়েছেন। এর পরিবর্তে তিনি রাখাইন রাজ্যে ত্রাণ পাঠানোর কথা বলেছেন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হয়তো ভেবেছেন যে বাংলাদেশের মানুষ কিছু বুঝবে না, কিন্তু জনগণকে বোকা ভাবা ঠিক নয়। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, করিডর বা ত্রাণ পাঠানো—এই দুটির কার্যক্রম একই। শুধু নামের পরিবর্তন। করিডর আমাদের জন্য যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, ত্রাণ পাঠানোর ঝুঁকিও একই।
প্রথম আলো: জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার কথায় বোঝা যায়, রাখাইন রাজ্যের জন্য করিডর বা ত্রাণ পাঠানোর বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা ও তৎপরতা চলেছে। কাদের সঙ্গে, কোন পর্যায়ে বা কত দিন ধরে এ আলোচনা চলেছে বলে আপনার মনে হয়?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: এই পুরো প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের স্বচ্ছতা নেই। এই ইস্যুতে আমরা সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মুখে ভিন্ন ভিন্ন কথা শুনেছি। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এক ধরনের কথা বলেছেন, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এক ধরনের কথা বলেছেন, আবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের মুখে অন্য কথা শুনেছি। বিদেশি কোনো রাষ্ট্র বা জাতিসংঘ—কার সঙ্গে এবং কোন পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে, তা পরিষ্কার নয়। তবে এমন একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য যেসব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা প্রয়োজন ছিল, তা যে হয়নি, সেটা পরিষ্কার। সংসদ থাকলে সেখানে আলোচনা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার পড়ত। যেহেতু সংসদ নেই, তাই উচিত ছিল বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা এবং তাদের মতামত নেওয়া। কিন্তু তা হয়নি, কোনো স্বচ্ছতার বিষয় এ ক্ষেত্রে দেখা যায়নি।
প্রথম আলো: এদিকে আমরা দেখছি সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার–উজ–জামান করিডরের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানের বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন। তিনি বলেছেন, করিডর বিষয়ে নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকেই সিদ্ধান্ত আসা উচিত। তার মানে কি এই ইস্যুতে সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে আলোচনা বা তাদের মতামতকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: আমার মনে হয় যে সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা বা তাদের মতামত নেওয়া হয়নি। আগেই বলেছি যে স্বচ্ছতা বা অংশীদের সঙ্গে আলোচনা করে কিছু করা হয়নি। মিয়ানমারের একটি রাজ্যে ত্রাণ পাঠানোর বিষয়টির বড় নিরাপত্তাঝুঁকি রয়েছে। এখানে যেহেতু নিরাপত্তা ইস্যু রয়েছে, তাই সশস্ত্র বাহিনীর অবস্থান, মতামত ও সম্মতির বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ত্রাণ পাঠানোর প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকে পড়লে আমাদের বড় বিপদের মধ্যে পড়তে হতে পারে। আমরা জানি না যে রাখাইন রাজ্যে ত্রাণ পাঠানোর ব্যাপারে মিয়ানমারের সম্মতি আছে কি না। মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে এবং একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে মিয়ানমারকে আমরা স্বীকৃতি দিই। এখন রাখাইনে ত্রাণ পাঠানোর বিষয়টিতে যদি তাদের সম্মতি না থাকে, তবে মিয়ানমার তার জাতীয় নিরাপত্তা ও ভূখণ্ডগত অখণ্ডতার স্বার্থে তা প্রতিহত করতে পারে। তখন জানমালের ক্ষতি হতে পারে। সেই নিরাপত্তা তখন কে দেবে? এর দায়িত্বই–বা কে নেবে?
আর ত্রাণ পাঠানো হলেও যাদের জন্য তা পাঠানো হচ্ছে, তাদের কাছেই যে পৌঁছাবে, তারও নিশ্চয়তা নেই। বিভিন্ন অভিজ্ঞতা বলে, এ ধরনের ক্ষেত্রে ত্রাণ সাধারণত ওই অঞ্চল নিয়ন্ত্রণকারী বিচ্ছিন্নতাবাদী বা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় এবং নিজেদের স্বার্থে তা ব্যবহার করে। ত্রাণ তখন যুদ্ধের সরঞ্জামে পরিণত হয়।
প্রথম আলো: মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ত্রাণ পাঠানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত কি চূড়ান্ত হয়ে গেছে, নাকি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া এখনো বাকি রয়েছে? জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার বক্তব্যে কিন্তু বিষয়টি স্পষ্ট নয়।
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: নিরাপত্তা উপদেষ্টার বক্তব্যে মনে হয়েছে রাখাইনে ত্রাণ পাঠানোর ব্যাপারে সরকার যেন নীতিগতভাবে প্রস্তুত। কিন্তু মাঠপর্যায়ে তা কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, তা পরিষ্কার নয়। যেহেতু সেনাপ্রধান এ বিষয়ে একমত নন, তাই ওই অঞ্চলের নিরাপত্তার দিকটি কীভাবে রক্ষা করা হবে, সেই প্রশ্নও উঠবে। ওই অঞ্চল একটি স্পর্শকাতর এলাকা, দেশের রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর মধ্যে যদি যথাযথ সমন্বয় করা না যায়, তবে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়বে।
প্রথম আলো: মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ঐতিহাসিক, বলা যায় মিয়ানমার চীননিয়ন্ত্রিত একটি দেশ। এখন বাংলাদেশ যদি মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত আরাকান আর্মি–নিয়ন্ত্রিত রাখাইন রাজ্যে ত্রাণ পাঠাতে চায়, তাহলে চীনের মনোভাব বোঝা কি জরুরি নয়? রাখাইনে ত্রাণ পাঠানোর ইস্যুতে চীনের অবস্থান কী হবে বলে মনে করেন?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: রাখাইনে ত্রাণ পাঠানোর উদ্যোগকে চীন ভালোভাবে নেবে না। বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত সম্প্রতি বিআইআইএসএসের (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ) এক সেমিনারে স্পষ্টভাবেই এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছেন। বাংলাদেশের এই উদ্যোগকে চীন কৌশলগতভাবে তার স্বার্থবিরোধী বিবেচনা করলে বিভিন্নভাবে তার বিরোধিতা করবে এবং ঠেকানোর চেষ্টা করবে।
প্রথম আলো: মিয়ানমার পরিস্থিতি বাংলাদেশের নিরাপত্তা ক্ষেত্রে কী ঝুঁকি তৈরি করছে? বাংলাদেশের করণীয় কী?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: রাখাইনে চলমান অভ্যন্তরীণ সংঘাত আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি। এমন সংঘাতের প্রভাব আশপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে যাওয়ার একটি প্রবণতা থাকে। এরই মধ্যে সেটি ঘটেছেও। আমরা দেখেছি, সেখান থেকে মিয়ানমারের সেনারা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছিলেন। বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের ভেতরে আরাকান আর্মির অবস্থানের বিষয়টিও আলোচনায় এসেছে। মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের ২৭০ কিলোমিটারের সীমান্ত আছে এবং সেই সীমান্তে স্থিতিশীলতা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, সীমান্ত নিরাপত্তা কীভাবে রক্ষা করা হবে? কারণ, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে, কিন্তু তারা রাষ্ট্রীয় বাহিনী নয়। ফলে সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টিতে জটিলতা তৈরি হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে সীমান্তে বাড়তি নজরদারি ও তদারকির প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। সীমান্ত এলাকায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হলে মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান, মানব পাচারের মতো ঘটনা বেড়ে যায়। এ কারণে সীমান্তে পাহারা আরও জোরদার করতে হবে।
প্রথম আলো: ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ফলাফল কী দাঁড়াল?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের কোনো সামরিক ফলাফল বলা সম্ভব নয়। সামরিক ফলাফল আসার আগেই যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়েছে। তবে এ সংঘাতের কারণে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপর যে হুমকি এসেছে, সেটি আমাদের বুঝতে হবে। দুই দেশের এ সংঘাতে প্রতীয়মান হয়, এ অঞ্চলের স্থিতিশীল পরিস্থিতি নাজুক পর্যায়ে আছে। আর এ ধরনের পরিস্থিতি সরাসরি প্রভাব ফেলে অর্থনীতি ও বাণিজ্যের ওপরও। এ দুটি দেশের আছে পারমাণবিক সক্ষমতা এবং পৃথিবীর বড় দুটি সশস্ত্র বাহিনী। ফলে এ দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ লাগলে এটি শুধু আঞ্চলিক পর্যায়ে সীমিত থাকবে না, আন্তর্জাতিকভাবেও এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়তে পারে।
প্রথম আলো: এই যুদ্ধ থেকে আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি বা আমাদের করণীয় কী?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: এখন দুটি দেশই যেহেতু আমাদের প্রতিবেশী, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য সব ধরনের কৌশলগত দিকগুলো নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার ভেতরে পারস্পরিক সহযোগিতার যে ক্ষেত্রগুলো ছিল, সেগুলো একেবারেই কাজ করছে না। সার্কের কার্যক্রম কীভাবে আবার গতিশীল করা যায়, সেটি সবাইকে ভাবতে হবে। এই প্রথমবারের মতো এ অঞ্চলে পানিকে যুদ্ধের একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ১৯৬০ সালে দুই দেশের মধ্যে হওয়া সিন্ধু চুক্তি প্রথমবারের মতো ভেঙে পড়ল। পাকিস্তান থেকে আমরা শুনলাম, ভারত যদি চুক্তি অনুযায়ী পানি সরবরাহ না করে, এটি হবে তাদের জন্য রেডলাইন। একইভাবে ভারতের দিক থেকেও বলা হলো, ভারতের সঙ্গে যদি কেউ বৈরিতা করে, তাহলে তাদের পানির নিশ্চয়তা দেওয়া যাবে না। ফলে নিম্নবাহী পানির সব দেশের জন্য এ সংঘাত একটি বড় ধরনের সংকেত, এ ব্যাপারে আমাদের সজাগ থাকতে হবে।
প্রথম আলো: ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে বিরোধের মাত্রা বাড়িয়েই চলেছে। এর পরিণতি কী? ভারত এ থেকে কী অর্জন করতে চাইছে?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: এটা স্পষ্ট যে তারা বাংলাদেশের ওপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে। যে কারণে বাণিজ্যের ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা আমরা দেখছি। বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় নাগরিকদের পুশ ইন করাও শুরু করেছে। বাংলাদেশে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান ও পরবর্তী সময় নানা ঘটনা ভারত ইতিবাচকভাবে এখনো গ্রহণ করতে পারছে না। আসলে বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতি তারা এখনো সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে পারছে না। যে কারণে তারা বিভিন্নভাবে আমাদের বিরোধিতা করছে। বিরোধিতার ফলাফল হিসেবে ভারতের পক্ষ থেকে এ ধরনের পদক্ষেপগুলো দেখা যাচ্ছে। তবে আমি বলতে চাই, প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার দিকেই আমাদের গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। ভারতেরও উচিত আমাদের সঙ্গে কার্যকর সুসম্পর্কের দিকে মনোযোগী হওয়া। আমদানি-রপ্তানি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ভিসাপ্রক্রিয়া, মানুষে মানুষে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়া—এসব কোনোটিই দুই দেশের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। এখানে বৈরিতা নয়, প্রতিবেশীসুলভ আত্মমর্যাদামূলক সম্পর্কই গড়তে হবে দুই দেশকেই।