
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ ইশফাক ইলাহী চৌধুরী, এনডিসি, পিএসসি ৩৫ বছর বিমানবাহিনীর কর্মজীবন শেষে ২০০৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি স্টাফ কলেজ ও ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজেও দীর্ঘদিন প্রশিক্ষক ছিলেন। ১৯৬৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান এয়ারফোর্সে কমিশন্ড অফিসার হিসেবে যোগ দেওয়ার পর তিনি ১৯৭৫ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি ডিফেন্স স্টাডিজে স্নাতকোত্তর এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজে এমফিল ডিগ্রি অর্জন করেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক মাহফুজুর রহমান মানিক।
সমকাল: পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে কয়েক সপ্তাহের উত্তেজনা ও পাল্টাপাল্টি হামলার পর দুই দেশ অস্ত্রবিরতিতে রয়েছে। এই সংঘাত কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: এবার ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যা হলো, একে আমি যুদ্ধ বলব না। বলব সশস্ত্র সংঘাত। দুটো রাষ্ট্রের মধ্যকার এই সংঘাত আরও বৃহদাকারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল। এবারের সংঘাতের মূলে ছিল ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা। এটা ঠিক যে, কাশ্মীরের সন্ত্রাসবাদের সমস্যা বহু বছর ধরে চলে আসছিল, যদিও কয়েক বছর সেখানে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে এসেছিল। প্রতিবছর অধিক হারে দেশি-বিদেশি পর্যটক কাশ্মীরে ভিড় করছিল। এ অবস্থায় ২২ এপ্রিলের হামলার পর ভারত সরকার জয়শ-ই মুহম্মদ, লস্কর-ই-তৈয়বাসহ বিভিন্ন সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ভারত ৭ মে ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরু করে। অন্যদিকে পাকিস্তান পাল্টা হিসেবে ৮ মে থেকে ‘বুনিয়ান উন মারসুস’ অভিযান চালিয়েছে, যার লক্ষ্য ছিল ভারতের বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটি।
সমকাল: দুই দেশের বিপরীতমুখী অভিযানে ক্ষয়ক্ষতি কেমন হলো?
ইশফাক ইলাহী: এবার লক্ষণীয় বিষয় হলো, ভারতীয় বিমান যেমন পাকিস্তানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেনি, তেমনি পাকিস্তানি বিমানও ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেনি। তবে পাল্টাপাল্টি হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন যুদ্ধবিরতির কথা বলেছেন, তখন দুই পক্ষই তাতে রাজি হয়েছে। ভারত অবশ্য একে বলছে অস্ত্রবিরতি; যুদ্ধবিরতি নয়।
সমকাল: উভয় দেশই যুদ্ধ জয়ের দাবি করছে? বাস্তবতা কী?
ইশফাক ইলাহী: যুদ্ধের প্রকৃত সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা জানতে আরেকটু সময় লাগবে। তবে ভারত কয়েকটি বিমান বিধ্বস্তের কথা স্বীকার করেছে। তবে এও বলেছে, তাদের কোনো পাইলট হতাহত হননি। ভারত দাবি করেছে, তারাও কয়েকটি পাকিস্তানি বিমান ধ্বংস করেছে। তবে কোনো পক্ষই বিমান ধ্বংসের সঠিক প্রমাণ এখনও হাজির করতে পারেনি।
সমকাল: আগের সংঘাতগুলো থেকে ভিন্নতা কতখানি?
ইশফাক ইলাহী: এ সংঘাত এর আগে সংঘটিত যে কোনো ভারত-পাকিস্তান সংঘাত থেকে ভিন্নতর ছিল। উভয় দেশ ব্যাপকভাবে ড্রোন ও দূরপাল্লার সুপারসনিক মিসাইল ব্যবহার করেছে। আক্রমণ ও প্রতিআক্রমণে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে উভয় পক্ষে সামরিক স্থাপনাগুলোর সীমিত ক্ষতি হলেও, ব্যাপক লোকক্ষয় হয়নি। উভয় পক্ষ উপগ্রহভিত্তিক নেভিগেশন সিস্টেম, বিমানবাহী যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালন কেন্দ্র, সেই সঙ্গে আকাশ যুদ্ধের পুরো সিস্টেমকে একই সূত্রে গেঁথে ফেলার যে নৈপুণ্য দেখিয়েছে, তা উভয় বিমানবাহিনীরই উন্নত প্রশিক্ষণের প্রতিফলন।
সমকাল: দুই পক্ষই কি সংঘাত সীমিত রাখতে চেয়েছে?
ইশফাক ইলাহী: সংঘাত শুরুর পর থেকেই উভয় পক্ষের সামরিক কর্তৃপক্ষের মধ্যে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ কার্যকর ছিল। সুতরাং সংঘাত যেন মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়, সে ব্যাপারে উভয় পক্ষ সচেষ্ট ছিল। চার দিনের সংঘাতে যে অভিযানটি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তা হচ্ছে, পাকিস্তানের সারগোদা বিমানঘাঁটির সন্নিকটে কিরানা পাহাড়ে অবস্থিত একটি ভূগর্ভস্থ অস্ত্রভান্ডার। মনে করা হয়, এই পাহাড়ের গভীরে পাকিস্তানের আণবিক অস্ত্রের একটি ভান্ডার গড়ে তোলা হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে একটি চিত্র ছড়িয়ে পড়ে যে, কিরানা পাহাড়ের অস্ত্রভান্ডারের গুহামুখে একাধিক আক্রমণ হয়েছে। এর ফলে স্থানীয়ভাবে ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। যদিও পাকিস্তান ও ভারতের উভয় পক্ষই আক্রমণ বা কোনো প্রকার ক্ষয়ক্ষতির কথা স্বীকার করেনি। কিন্তু ধারণা করা হয়, এই আক্রমণই পশ্চিমা শক্তিদের, বিশেষ করে মার্কিনিদের ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে উদ্বুদ্ধ করে।
সমকাল: যুদ্ধবিমান ধ্বংস হলে পাইলটের কি মৃত্যু ঘটে কিংবা গ্রেপ্তার হন?
ইশফাক ইলাহী: যুদ্ধবিমান ধ্বংস হলে পাইলটের মৃত্যু কিংবা গ্রেপ্তার নাও হতে পারে। কারণ বিমান থেকে নিরাপদে বেরিয়ে আসার সুযোগ আছে। তবে পৃথিবীতে এমন কোনো বিমান বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই, যাকে ধ্বংস করা যায় না। সাধারণত যুদ্ধে যে ডিফেন্সে থাকে তথা প্রতিরোধ করে, তার ক্ষয়ক্ষতি কম হয়। আর যে আক্রমণ করে, তার ক্ষতি বেশি হয়। ৭-৮ মে’র আকাশ যুদ্ধে যেহেতু ভারতীয় বিমানবাহিনী আক্রমণাত্মক ভূমিকায় ছিল, তাই তাদের কিছু বিমান হারানোর আশঙ্কা বেশি।
সমকাল: উভয় দেশ পরস্পরের জন্য আকাশপথ বন্ধ করে দিয়েছিল। এর ব্যাখ্যা কী?
ইশফাক ইলাহী: আকাশপথ বন্ধের আগে আরও কিছু ঘটনা ঘটেছে। যেমন পেহেলগামের ঘটনার পর নরেন্দ্র মোদি সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত ঘোষণা করেন। ১৯৬০ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় এই পানিচুক্তি হয়। চুক্তি অনুসারে, পাঞ্জাবের সিন্ধু নদসহ মোট ছয়টি নদীর পূর্বের তিনটি নদী ভারত ব্যবহার করবে আর বাকি তিনটি পাকিস্তান ব্যবহার করবে। ১৯৬০ সালের পর থেকেই এমনটা চলে আসছে। মাঝে কয়েকটি যুদ্ধ হলেও এ চুক্তির ব্যত্যয় ঘটেনি। এবার এসে ভারত সরকার সেই চুক্তি স্থগিত করেছে। পাকিস্তান জবাবে বলেছে, এমন আচরণ ‘অ্যাক্ট অব ওয়ার’, অর্থাৎ এটা যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। তারপরও ভারত চুক্তি স্থগিত করে রেখেছে। তা ছাড়া পরস্পরের মধ্যে ব্যবসা বন্ধ হয়েছে। এর পর পাকিস্তান ভারতের জন্য তার আকাশপথ বন্ধ করে দেয়। ভারতও তার অনুসরণ করে। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত উভয় দেশ একে অপরের জন্য আকাশপথ বন্ধ করে রেখেছে।
সমকাল: ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুরোধের সঙ্গে সঙ্গে উভয় পক্ষ যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার কারণ কী?
ইশফাক ইলাহী: ভারত-পাকিস্তানের উত্তেজনার মধ্যে প্রথম কয়েক দিন ট্রাম্প প্রশাসন চুপ ছিল। ভারত-পাকিস্তানের সংঘাত কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে, সে ব্যাপারে সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসনের বুঝতে বাকি ছিল। এ ছাড়া ট্রাম্প হয়তো ইউক্রেন, মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। যা হোক, পাকিস্তান সবসময় বলে আসছে- ‘আমার অস্তিত্বের সংকট হলে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করব।’ অন্যদিকে ভারতের ঘোষণা, তাদের বিরুদ্ধে কেউ পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করলে তারাও এর ব্যবহার করবে। অর্থাৎ ‘নো ফার্স্ট ইউজ পলিসি’। সারগোদার কাছে পাকিস্তানের একটি পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত আছে। তার কাছে আক্রমণ হয়েছিল। পারমাণবিক অস্ত্রের মজুতে হামলা করলে পাকিস্তান যুদ্ধে এ অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে; এ আশঙ্কা থেকেই যুক্তরাষ্ট্র হয়তো দ্রুত হস্তক্ষেপ করে। ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন দেখছেন, উভয় তরফেই অভিযান পরিচালিত হয়েছে, তখন আর বাড়তে না দেওয়ার জন্যই যুদ্ধবিরতির অনুরোধ করেছেন এবং উভয় দেশই তা মেনে নিয়েছে।
সমকাল: ভারত-পাকিস্তানের উত্তেজনার প্রভাব প্রতিবেশী হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার ওপর কেমন দেখছেন?
ইশফাক ইলাহী: ভারত-পাকিস্তানের সংকট যদি নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং এখানে যদি পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার না হয়, তবে তাতে অন্য প্রতিবেশীদের বিচলিত হওয়ার তেমন কারণ নেই। তবে এসব কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির ওপর একটা প্রভাব পড়ে। পাকিস্তান এমনিতেই অর্থনীতির গভীর খাদে নিমজ্জিত। ভারতের অর্থনীতি অতটা খারাপ না হলেও যুদ্ধ ব্যয়ের ফলে তার প্রবৃদ্ধি কমতে পারে। তাদের অর্থনৈতিক সংকট প্রতিবেশীকেও প্রভাবিত করবে; এটাই স্বাভাবিক। তবে দক্ষিণ এশিয়ার সংকটের মূলে আমরা দেখছি, এক কাশ্মীর সমস্যা; অন্যটি সন্ত্রাসবাদ। এগুলোর কিন্তু সমাধান হয়নি। ভারত বলছে, পরবর্তী সময়ে কোনো সন্ত্রাসী হামলা হলে তারা সন্ত্রাসের মূল ঘাঁটিতে আক্রমণ করবে। তার মানে, সংঘাত আবার বেড়ে যেতে পারে। পাকিস্তান বারবার দাবি করছে, তাদের অভ্যন্তরে যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হচ্ছে, তাতে ভারতের হাত আছে। যেমন বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি এখন পাকিস্তানকে যথেষ্ট ব্যস্ত রাখছে। চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরের আওতায় বেলুচিস্তান হয়ে ৮৭০ কিলোমিটার পথ নির্মাণের কাজ চলমান। বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি আক্রমণ করে ইতোমধ্যে অনেক চীনা নাগরিককে হত্যা করেছে। সম্প্রতি সশস্ত্র এই গ্রুপ একটি ট্রেন হাইজ্যাক করে। পাকিস্তান বলছে, এতে ভারতের হাত আছে। এদিকে যে তালেবানকে পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিল, সেই তালেবানই এখন পাকিস্তানের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একে তো তাহরিকে তালেবান পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে কাবুলের তালেবান সরকার ভারতের সঙ্গে বহুপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
সমকাল: বাংলাদেশে এর প্রভাব কতখানি?
ইশফাক ইলাহী: সন্ত্রাসবাদ এককভাবে কোনো দেশের জন্য তো বটেই, সারাবিশ্বের জন্যও উদ্বেগের কারণ। বাংলাদেশের জন্যও উদ্বেগজনক। পাক-ভারত উত্তেজনা বাড়লে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলো এর সুযোগ নেয়; সেই গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব বাংলাদেশেও রয়েছে। ফলে পাক-ভারত যুদ্ধের অর্থনৈতিক প্রভাবের পাশাপাশি নিরাপত্তা প্রভাবও বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক। পাক-ভারত সংঘাতের নিরাপত্তাজনিত প্রভাব বাংলাদেশ এড়াতে পারে না।
সমকাল: দক্ষিণ এশিয়ার বিষয় হিসেবেই যদি আমরা বলি, রোহিঙ্গা সংকটে সরাসরি ভুক্তভোগী বাংলাদেশ। পাক-ভারত উত্তেজনার সঙ্গে বিষয়টি সম্পর্কিত কিনা, বিশেষ করে এর মধ্যে আবার মানবিক করিডোরের আলাপ হচ্ছে।
ইশফাক ইলাহী: রোহিঙ্গা সংকটের সঙ্গে যদিও ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্টতা নেই, তবে এটি দক্ষিণ এশিয়ার জন্য নিশ্চয় মাথাব্যথার কারণ। শিগগরিই এ সংকট সমাধানের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এখানে মানবিক করিডোরের কোনো যৌক্তিকতা আমি দেখছি না। এটি আরও সংকট তৈরি করতে পারে। তা ছাড়া রোহিঙ্গারা এখনও দেশে ঢুকছে। এমনকি বাংলাদেশে ঢুকতে না পেরে যেসব রোহিঙ্গা ভারতে ঢুকছে, তাদের বাংলাদেশে পুশইন করছে বিএসএফ। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এখন আগের পর্যায়ে নেই। পুশইন সংকট দুই দেশের সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলছে। ব্যবসা ক্ষেত্রে ভারত সম্প্রতি বাংলাদেশের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তা আরও উদ্বেগের বিষয়।
সমকাল: ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় দক্ষিণ এশিয়া ছাড়িয়ে চীনের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ নয় কি?
ইশফাক ইলাহী: চীনের ভূমিকা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরের কাজটি বেইজিংয়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা পাকিস্তান হয়ে গোয়াদর বন্দর ব্যবহার করতে পারলে মধ্যপ্রাচ্য তথা পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে চীনের যোগাযোগের নতুন রুট সংযোজিত হবে। চীনের সঙ্গে আবার ভারতের একটি বড় সীমান্ত আছে, যা ম্যাকমোহন লাইন নামে পরিচিত। এই সীমান্তের পুরোটাই বিরোধপূর্ণ। ম্যাকমোহন লাইনের দুটো বড় অংশ পশ্চিমে কাশ্মীরের লাদাখ ও পূর্বে অরুণাচল প্রদেশ। কাশ্মীরের লাদাখের একটা বড় অংশ ১৯৬২ সাল থেকে চীনের দখলে। সেটা নিয়ে ভারতের সঙ্গে তাদের সম্প্রতি সংঘাত হয়েছে। যদি ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা আরও বাড়ত কিংবা ভবিষ্যতে বড় ধরনের কোনো সংঘাত হলে চীন যদি জড়িয়ে পড়ে এবং অরুণাচলে সংঘাত বিস্তৃত হয়, তবে তা বাংলাদেশের জন্য বড় সমস্যার কারণ হতে পারে।
সমকাল: এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলবেন কি?
ইশফাক ইলাহী: ঘরের পাশে যুদ্ধ বেধে গেলে বৈদেশিক নীতি ব্যাপক চাপের মুখে পড়বে। যেমন কিছুদিন আগে সংবাদপত্রে এসেছে, বাংলাদেশে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি জাপান ভালোভাবে দেখছে না। ইন্দোপ্যাসিফিক যে বলয় গড়ে উঠছে, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, ফিলিপাইন আছে। সেখানে বাংলাদেশও এর অংশীদার হওয়ার ব্যাপারে পশ্চিমাদের আগ্রহ আছে। তাদের উদ্দেশ্য এই এলাকায় চীনকে টেক্কা দেওয়া। এর সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক আছে। আমরা যখন চীনের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছি তখন জাপানসহ পশ্চিমারা এটি ভালোভাবে দেখছে না। মনে রাখতে হবে, জাপান বাংলাদেশে অনেক বড় বিনিয়োগকারী। বাংলাদেশে জাপান ইকোনমিক জোন গড়ে উঠছে। সে জন্য এসব বিরোধে আমাদের বুঝেশুনে কৌশল নিতে হবে এবং ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সবার সঙ্গেই সম্পর্ক রাখতে হবে। কোনোদিকে ঝুঁকে পড়লে আবার অন্যদের থেকে চাপ আসতে পারে।
সমকাল: পাক-ভারত উত্তেজনা দিয়েই শেষ করি। তাদের বিরোধের ইতিবাচক সমাধান কি দেখতে পাচ্ছেন?
ইশফাক ইলাহী: ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার কাশ্মীর সমস্যার শিগগিরই সমাধান হবে কিনা, এটা বলা মুশকিল। আর সমাধান না হলেও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান তো হতে পারে। সন্ত্রাসবাদ যদি ভারতের জন্য সমস্যা হয়ে থাকে, অনুরূপ এটি পাকিস্তানের জন্যও সংকটের কারণ। এ জন্য শান্তিপূর্ণ আলোচনাই সমাধানের পথে নিয়ে আসতে পারে। দেখুন, ভারত ও চীনের মধ্যেও ১৯৪৭ সাল থেকে সীমান্ত বিরোধ চলে আসছে। উনিশ শতক থেকেই ব্রিটিশদের ম্যাকমোহন লাইন চীনারা মেনে নেয়নি। এর পর তাদের মধ্যে ছোট-বড় যুদ্ধ হয়েছে বটে, কিন্তু দুই দেশের মধ্যকার ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ নেই। ভারত-চীনের মধ্যে বাণিজ্য একশ বিলিয়ন ডলারের ওপরে। আমাদের সঙ্গে চীনের কিংবা পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য সে তুলনায় খুবই সামান্য। বাণিজ্যিক সম্পর্ক যত বাড়বে, সংঘাতের আশঙ্কা ততই কমবে। সেদিকেই মনে হয় নজর দিতে হবে।
সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
ইশফাক ইলাহী: সমকালকেও ধন্যবাদ।