
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত ওভারক্যাপাসিটি ও কাঠামোগত অদক্ষতায় ভারাক্রান্ত, যা নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ সরবরাহে বাধা তৈরি করছে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. সাইফুর রহমান।
যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া টেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক সাইফুর রহমান। তিনি আমেরিকার পেশাজীবীদের সংগঠন আইইইই-এর আজীবন ফেলো। সংগঠনটির ২০২৩ কমিটির সভাপতি হিসেবে কপ-২৭ সম্মেলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি স্মার্ট গ্রিড, পারমাণবিক বিদ্যুৎ, হাইব্রিড বায়ু ও সৌরবিদ্যুৎসহ বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেছেন।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যার প্রেক্ষাপটে তার এক সাম্প্রতিক সফরকালে দ্য ডেইলি স্টার এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছে।
ডেইলি স্টার: দীর্ঘদিন বিদেশে থেকে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতকে কীভাবে দেখেন?
সাইফুর রহমান: ওপর থেকে দেখি, সামগ্রিকভাবে। আমি বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের বিভিন্ন দিক পর্যবেক্ষণ করেছি। খুব কাছ থেকে লক্ষ্য করি ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও জাপানের বিদ্যুৎখাতকে। এসব দেশে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকায় দেশগুলোর পরিস্থিতির সঙ্গে আমি বাংলাদেশের পরিস্থিতির সাথে তুলনা করতে পারি।
ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে থাইল্যান্ডের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা পিছিয়ে ছিল। কিন্তু এখন তারা আমাদের থেকে তিনগুণ এগিয়ে। এর মূল কারণ হলো, আমাদের দেশে যেসব ইঞ্জিনিয়ার আছেন, তারা তাদের প্রতিভা প্রকাশের সুযোগ পান না।
দীর্ঘদিন আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল ভিত্তি ছিল গ্যাস। ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল গ্যাসভিত্তিক। সাথে যুক্ত হয়েছে কয়লা, নতুন করে নিউক্লিয়ার পাওয়ার যুক্ত হতে যাচ্ছে। কিন্তু এখন গ্যাসের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। ছয়-সাত বছর আগেও আমাদের গ্যাসের কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে।
ডেইলি স্টার: আপনার চোখে দেশের বিদ্যুৎখাতের সমস্যা কী?
সাইফুর রহমান: এখানে ওভারক্যাপাসিটি বা রিজার্ভ ক্যাপাসিটি তো মোটামুটি ৮ থেকে ১০ শতাংশ থাকার কথা। কিন্তু এখানে তো বিদ্যুৎকেন্দ্র বানানো হয়েছে অনেক। কিন্তু ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশনে নজর না দেওয়ায় চাহিদা বাড়েনি।
আমাদের বিদ্যুৎ খাতের তিনটি প্রধান দিক—উৎপাদন, সঞ্চালন (ট্রান্সমিশন) এবং বিতরণ (ডিস্ট্রিবিউশন) নিয়ে যুগপৎভাবে ভাবতে হবে। আমাদের লোডশেডিংয়ের যে সমস্যা তার কারণ বেশিরভাগটা ডিস্ট্রিবিউশনের ক্ষেত্রে। এখানকার ভোল্টেজ খুব ওঠানামা করে। অনেক সময় গাছ পড়ে তার ছিঁড়ে যায়। লাইন কাটা পড়ে। এদিকে সরকার কখনো দৃষ্টিপাত করেনি।
ঢাকার কিছু এলাকায়, যেমন বনানী, বারিধারা ও গুলশানে ভূগর্ভস্থ বিদ্যুৎ লাইন স্থাপন করা হচ্ছে। ঝড়-বৃষ্টির সময় এই লাইন খারাপ হবে না। কিন্তু এই প্রক্রিয়া খুবই ব্যয়বহুল। ফলে বড় বড় শহরগুলোতে আন্ডারগ্রাউন্ড করা হলেও শহরের বাইরে বিশ্বজুড়েই ওভারগ্রাউন্ড।
ফলে আমাদের তিনটি খাতকেই যুগপৎভাবে চিন্তা করতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন শুধু বাড়ালেই হবে না, যদি সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থা উন্নত না করা হয়। কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সেটি যদি গ্রাহকদের কাছে পৌঁছানো না যায়, তাহলে এর কোনো মূল্য নেই। এই সবগুলো খাতেই আমাদের দক্ষ মানবসম্পদ বাড়াতে হবে।
ডেইলি স্টার: আমাদের ২০৫০ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিকল্পনা তো করা আছে। এই প্রক্রিয়ায় কোনো সমস্যা কি দেখেন?
সাইফুর রহমান: আমি যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের জ্বালানি পরিকল্পনা পর্যালোচনা করেছি। যুক্তরাষ্ট্র ২০৫০ সাল পর্যন্ত পরিকল্পনা করেছে, চীন ২০৬০ এবং ভারতের ২০৭০ সাল পর্যন্ত পরিকল্পনা আছে। কিন্তু আমাদের পরিকল্পনা স্বল্পমেয়াদে ভাগ-ভাগ করা নেই। স্বল্পমেয়াদী লক্ষ্যমাত্রাগুলো আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। আমাদের দরকার আগামী ২০৩০ সালে আমরা কী করব, ২০৩৫ সালে কী করব আর ২০৪০ সালে কী করব।
এর মধ্যে কখনো কয়লার দাম বাড়বে, কখনো অন্য ফুয়েলের দাম বাড়বে। ফলে সেগুলোর একটা বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা লাগবে। যদি দাম অনেক বেড়ে যায়, তাহলে কি লোড ম্যানেজমেন্ট করবে, নাকি ব্যাটারি স্টোরেজ বাড়াবে?
আমার পরামর্শ থাকবে বিদ্যুতের চাহিদা কমানোর পক্ষে। জ্বালানি এফিসিয়েন্সি বাড়িয়ে এটা করা যায়।
আর আমাদের মহাপরিকল্পনায় বেশ কিছু বিষয় আছে অবাস্তব। এখানে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেনের কথা বলা আছে। এটা খুবই ব্যয়বহুল। আমেরিকা পারছে না, আমরা কীভাবে পারব? আর হাইড্রোজেন হাব যেটার কথা বলা আছে, সেটা মার্কেট না থাকলে সম্ভব না। সৌদি আরব করছে, কারণ তাদের জাপান বলেছে যে তারা সৌদি থেকে হাইড্রোজেন নেবে।
আমাদের যদি বাইরে মার্কেট থাকে তাহলে করতে পারি। কিন্তু তা তো নেই। একইসঙ্গে আমাদের দেশের ভেতরেও এর চাহিদা নেই। আর আমদানি করা হাইড্রোজেন দিয়ে এটা করা খুবই ব্যয়বহুল। অন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের আউটপুট কার্বন ডাই অক্সাইড হলেও এটার আউটপুট কিন্তু পানি। চায়নাতে হাইড্রোজেন দিয়ে ট্রাক চালায়। আমরাও কি চালাবো? সেক্ষেত্রেও আমাদের নতুন ইঞ্জিন লাগবে। হাইড্রোজেন দিয়ে কি হবে, সেটা তো আগে ঠিক করতে হবে। কিন্তু মহাপরিকল্পনায় এটা নেই।
ডেইলি স্টার: এখানে নিজস্ব জ্বালানি তো স্বল্প। এই প্রেক্ষিতে তাহলে কোন দিকে যেতে হবে?
সাইফুর রহমান: আমার কাছে এর সমাধান আছে তিনটা। একটা হচ্ছে এফিসিয়েন্সি বাড়িয়ে বিদ্যুতের চাহিদা কমাও। আমাদের লাইটিং, এসি--- সবকিছুরই এফিসিয়েন্সি বাড়ানো সম্ভব। একই আউটপুট দেবে কিন্তু বিদ্যুতের ব্যবহার কমে যাবে।
আর হচ্ছে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ানো। এটা হয়তো রাতে থাকবে না, ব্যাটারি লাগবে। কিন্তু যত বেশি সম্ভব সোলার ব্যবহার করা যাবে তত ভালো। আর তৃতীয়ত, ক্রস বর্ডার পাওয়ার ট্রান্সফার। যেহেতু আমাদের রিসোর্স কম, আমরা বিদ্যুৎ আনতে পারি নেপাল, ভুটান, ভারত থেকে।
কিন্তু এরও কিছু অসুবিধা আছে। যদি কোনো কারণে তারা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়? এটা তো জমা করে রাখা যায় না। জাতিসংঘ পর্যায়ে এই প্রশ্ন উঠেছে। প্যারিসের ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি এটা নিয়ে কাজ করছে। ইউএন ট্রিটি (চুক্তি) থাকতে হবে যে যারা বিদ্যুৎ গ্রহণ করে, তাদের অনুমতি ছাড়া যারা বিদ্যুৎ দেবে, তারা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করতে পারবে না।
নেপাল থেকে শুরু হয়েছে, তাও ভারতের গ্রিড ব্যবহার করে। ভুটান থেকেও হতে পারে। ওখানে নতুন গ্রিডলাইন লাগবে। আরেকটা বিকল্প হতে পারে চীনের কুনমিং। ওদের অনেক হাইড্রো পটেনশিয়াল আছে। তারা ভিয়েতনামকে বিক্রি করে। একটা অফার ছিল কুনমিং-মিয়ানমার-বাংলাদেশ বিদ্যুৎ সরবরাহের। কিন্তু সেটা হয়নি।
আমরা বলছি আমাদের বিদ্যুতের চাহিদা হবে ৮৪ হাজার মেগাওয়াট। সেটা বললেই তো হবে না, এর সরবরাহও নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য সোলার, নিউক্লিয়ার আর আমদানি করা বিদ্যুৎ-ই ভরসা।
নিউক্লিয়ার একটু সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল। কিন্তু এখানে আরেকটা বিকল্প আছে—স্মল মডিউলার রিয়েক্টর (এসএমআর)। রূপপুরে যেটা হচ্ছে একটা মডিউলার ১,২০০ মেগাওয়াট করে দুইটা ২,৪০০ মেগাওয়াট। কিন্তু এসএমআর একটা হচ্ছে ৫০ থেকে ১২০ মেগাওয়াট। এটার ডিজাইন ভিন্ন। তাতে অনেক লেস রিস্ক অব এক্সিডেন্টস।
রূপপুর নদীর ধারে করতে হচ্ছে কারণ এতে অনেক পানি লাগবে। আর এসএমআর যেহেতু অত কুলিং লাগে না, এটা নদীর ধারে করতে হবে না। তাই এটা একটা ভালো বিকল্প হতে পারে। এটা এখন করছে চীন, আমেরিকা, আর্জেন্টিনা, রাশিয়া, কোরিয়া। এগুলোর কথা বলতে হবে, এখানে জয়েন্ট ভেঞ্চারে হতে পারে।
ডেইলি স্টার: রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
সাইফুর রহমান: রূপপুরের বিদ্যুৎ পরিবহনের জন্য আমাদের ২৩০ কেভি লাইন আছে, ১৩২ কেভি লাইনও আছে। কিন্তু ৪০০ কেভি লাইন এখনো রেডি হয়নি। পিজিসিবি বলছে, যেটা আছে তাতেই ১,২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সঞ্চালন সম্ভব। কিন্তু রাশিয়া বলছে সম্ভব না। আরেকটা দিক আছে, রূপপুরের বিদ্যুৎ কোথায় ব্যবহার করা হবে। এটার চাহিদা কোথায় আছে এখন এই মুহূর্তে? এটা কি ঢাকায় নিয়ে আসা হবে নাকি অন্য কোথাও।
এখন একটা লাইনকে যদি ওভাররিলাই কর, তাহলে লাইনটা ফেইলিওর হতে পারে যেকোনো সময়। তখন তো একটা খারাপ অবস্থায় পড়ে যাবে। আমরা এটাকে বলি এন মাইনাস ওয়ান প্ল্যানিং। আমাদের ধরেই নিতে হবে একটা লাইন যেকোনো সময় ট্রিপ করতে পারে। যদি হয়, সেটা কীভাবে ব্যাক-আপ দেওয়া হবে, এটাও কিন্তু হিসেবে রাখতে হয়।
আমরা আমেরিকাতে যেটা করি, জেনারেটর ফুল লোড করি না। টপ ৫ শতাংশ আমাদের অনলোড থাকে। ১০টা প্ল্যান্ট এমন ৫ শতাংশ করে রাখলেই ৫০ শতাংশ হয়ে গেল। এটা এদেশে হয় না। রূপপুরে ব্যাকআপ জেনারেশন হয়নি। রাশানরা বলেছে তোমাদের গ্যাস-ভিত্তিক ব্যাক আপ থাকতে হবে। আমাদের ওইরকম লাক্সারি নাই যে ১,২০০ মেগাওয়াট গ্যাস আমরা বসিয়ে রাখতে পারব।
এই কথাগুলো বলার লোক আমাদের এখানে নাই। দক্ষ জনশক্তির কথা এজন্যই বলছি। নীতিনির্ধারকদের তো বলতে হবে যে এই আমাদের বিকল্প আছে, এখন আমরা কী করব?
ডেইলি স্টার: কিন্তু রাশিয়া তো রূপপুর প্ল্যান্ট বানানোর পাশাপাশি দক্ষ জনশক্তির জন্যও ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করছে।
সাইফুর রহমান: হ্যাঁ, সেটা করছে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর জন্য। কিন্তু এ ধরনের পরিকল্পনা কারা করবে। এমন বিকল্পও হতে পারে যে, ভারত বা নেপালের সাথেও চুক্তি হতে পারে যে তারা ব্যাক-আপ প্রস্তুত রাখবে, আমরা টাকা দিয়ে দেব। এটা শর্ট টার্ম পরিকল্পনা।
ডেইলি স্টার: রূপপুরে কেমন বাড়তি খরচ হয়েছে বলে আপনার মনে হয়?
সাইফুর রহমান: আমেরিকায়ও এস্টিমেশন থেকে ডবল থেকে আড়াইগুণ বেশি খরচ হয়। ইকুইপমেন্ট খরচ অনেক সময় বেড়ে যায়। ধরুন একটা প্ল্যান্ট করতে ৬ বিলিয়ন ডলার এস্টিমেট করে কিন্তু যখন এটা বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করে দেখা যায় ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ হয়েছে। অনেক ইন্সপেকশন, টেস্টিং হয়, সময় লাগে। নিউক্লিয়ারের ক্ষেত্রে যেকোনো একটা স্ক্রু যদি ঢুকে তাহলেও সার্টিফিকেশন লাগে যে সেটা কোথায় তৈরি হয়েছে, কোয়ালিটি কী।
আমাদেরও তো প্রথমে বলা হয়েছিল ৬ বিলিয়ন খরচ হবে, কিন্তু এটা এখন ১২ বিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে। তাই কোনটা হতে পারে, কোনটা হবে, সেটা অনুমান করার জন্য দক্ষ জনশক্তির কথা বলছি। আমরা বলি ইফ সামথিং ক্যান হ্যাপেন, ইট উইল হ্যাপেন অ্যান্ড প্ল্যান অ্যাকর্ডিংলি।
ডেইলি স্টার: নিউক্লিয়ার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে বাংলাদেশের পরিকল্পনাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
সাইফুর রহমান: নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রেশারাইজড ওয়াটার রিএ্যাক্টার (পিডব্লিওআর) থাকে। যেখানে ইউরেনিয়ামযুক্ত ফুয়েল রড থাকে, যেটা রূপপুরে অলরেডি বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওটা ভাঙে, গরম হয় যা পানিকে গরম করে। গরম পানি থেকে স্টিম হয়, ওই স্টিম থেকে জেনারেটর চলে।
এই রডটা সময়ের সাথে সাথে কনসেনট্রেশন কমে যায়। যখন এটা ২ থেকে ৫ শতাংশে চলে আসে, তখন আর হিট বেশি হয় না। ফলে এটা ১৮ মাস পরপর পরিবর্তন করতে হয়। যেটা শেষ হয়ে যায়, সেটা তখনো গরম থাকে। আমেরিকাতে এগুলো সুইমিংপুলে রেখে দেওয়া হয় অন্তত ২ বছর ঠান্ডা হওয়ার জন্য। তারপর ট্রাকে করে কোথাও পাঠিয়ে দেয় জমা রাখার জন্য। এখন আমেরিকাতে এক স্টেটের অর্ধেক গরম রড অন্য স্টেট নিতে রাজি হচ্ছে না। পাওয়ার প্ল্যান্টেই উন্মুক্তভাবে পড়ে থাকছে।
বাংলাদেশ বলেছে রাশিয়া এগুলো নিয়ে যাবে। কিন্তু এগুলো গরম থাকা অবস্থায় কি করবে? আর নিয়ে যে যাবে, তারও তো খরচ আছে। আর এটা কয়লার মতো না যে যেকোনো জায়গা থেকে আনা সম্ভব। টিউবের সাইজ, কনসেন্ট্রেশন, ট্রান্সপোর্টেশনের ওপর নির্ভর করে এটা লিমিটেড। যারা বানিয়েছে তারাই শুধু দিতে পারে। দুনিয়ায় ৩-৪টা দেশ ফুয়েল রড বানাতে পারে। তার মানে তুমি যদি রাশিয়া থেকে না নাও, তাহলে অন্য মার্কেটে যে প্রাইস বেশি হবে তার চিন্তা করা হয়নি। আমাদের ওয়েস্টগুলোও যে নিয়ে যাবে, সেটা কত খরচ হবে, সেটাও কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে কথা হয়নি।
জাপানের গরম রডগুলো ঠান্ডা হলে ফ্রান্সে নিয়ে যাওয়া হয়। ওরা প্রসেস করে আবার নতুন ফুয়েল পাঠায়। এই যে নিয়ে যাচ্ছে জাহাজে করে, তার জন্য গার্ড দেয় ফ্রেঞ্চ নেভি টু মিনিমাইজ দ্য প্রলিফিরেশন রিস্ক। এটার জন্য তারা একটা বড় চার্জ নেয়। কিন্তু আমাদের এখানে এটা চিন্তাও করা হয়নি।
ডেইলি স্টার: বিশ্ব যখন কয়লা থেকে সরে আসছে, তখন আমরা বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করেছি। এটা কি পেছনের দিকে যাত্রা?
সাইফুর রহমান: আমি মনে করি এটা ঠিকই আছে। এটা আমাদের আউট অব নেসেসিটি ছিল। কারণ আমাদের পাওয়ার দিতে হবে তো। আমাদের হাইড্রো নাই, তেল নাই, গ্যাস কমে যাচ্ছে, ওই সেন্সে ঠিকই আছে। আরও নিউক্লিয়ার করতে পারি আমরা। সাউথে একটা করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সেটার জন্যও আমাদের আরও ১০ বছর লাগবে। তাহলে আমাদের ইন-বিটুইন প্ল্যান কী? আর আমরা যে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন করছি, সেটা বিশ্বের বড় বড় দেশগুলোর তুলনায় কিছুই না। আমাদের মোরাল রাইট আছে এটা করার।
এখন আমাদের ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বলেছে কোনো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে তারা পয়সা দেবে না। তাহলে এখন আমাদের বিকল্প চিন্তা করতে হবে। একটা ১০০ বিলিয়ন ডলারের ফান্ড আছে—লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড। দুবাই কপ ২০১৮ থেকে এটা নেওয়া হয়েছে। যারা কয়লা থেকে বের হতে পারছে না তাদের হেল্প করতে। মোর এফিসিয়েন্ট প্ল্যান্ট করতে অথবা কার্বন ক্যাপচার টেকনোলজি ব্যবহার করতে উৎসাহ দিতে এটা নেওয়া হয়। ওগুলো আমাদের ফোকাস করতে হবে।
নরমালি কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলো ৪০ শতাংশ এফিসিয়েন্ট। এটা যদি ৪৪ শতাংশ করা যায়, তবে কয়লার ব্যবহার ১০ শতাংশ কম করা সম্ভব। এখন বাড়ানোর যে খরচ সেটা তো কাউকে দিতে হবে। এটার জন্য এই লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড।
এগুলোর জন্য দরকার প্রপার প্ল্যানিং। টাকা কেন দেবে ওই ফান্ড থেকে তার যথোপযুক্ত কারণ দরকার। ওই টাকা দিয়ে কী করব, কার কাছ থেকে এফিসিয়েন্সি বাড়াব। কত এক্সট্রা লাগবে কতদিনে ব্যাংক লোন পরিশোধ করব, এগুলো প্ল্যানিং থাকলেই না টাকা আসবে।
ডেইলি স্টার: দক্ষ জনশক্তি তৈরির ওপর গুরুত্ব দিতে তার জন্য কী কী করতে হবে?
সাইফুর রহমান: সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে প্রতিবেশী ও সমমনা দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো। থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপান, সাউথ আফ্রিকা, মিডল ইস্ট—এদের সঙ্গে আলোচনা করা। এটা আমাদের হয় না।
উদাহরণ হিসেবে বলি, আমি গেলাম গত বছর The Conference of the Electric Power Supply Industry (CEPSI) তে। এটা দুবছর পরপর হয়। এশিয়ান পাওয়ার সেক্টরের টপ ইঞ্জিনিয়াররা এখানে আসেন। সবার সঙ্গে পরিচিত হলাম, ভারত, নেপাল, মালয়েশিয়া, মিয়ানমারের প্রতিনিধি সেখানে আছে কিন্তু বাংলাদেশের কেউ নাই। ওখানে বাংলাদেশের কেউ থাকলে নিশ্চয়ই সমৃদ্ধ হতো অন্যদের থেকে।
আমাদের এখানেও পাওয়ার ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটে বাইরের অতিথিদের নিয়ে আসতে পারেন। এটা হয় না আমাদের এখানে।
আমাদের বুরোক্রেসি খুব ইনট্রেনজিক। তারা একটা অফিস বা বিভাগ খুলতে প্রথমে চিন্তা করে আমার গাড়ি কোনটা আসবে, তেল কতটুকু পাওয়া যাবে, পিয়ন কয়জন হবে আর অফিস বিল্ডিং কয়টা। মূল কাজটার কথা কেউ বলে না।
ডেইলি স্টার: আমাদের এনার্জি মিক্সে কত শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থাকতে পারে। কেউ কেউ বলেন যে আমাদের শতভাগ রিনিউএবল সম্ভব।
সাইফুর রহমান: বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গেলে আমিও এটা শুনি। কিন্তু তারা কেউই ইঞ্জিনিয়ার না। তারা হয় ইকোনোমিস্ট, হিস্টোরি গ্র্যাজুয়েট বা অন্যরা। তাদের জিজ্ঞেস করতে হয় কাগজে কলমে দেখাতে যে ঈভাবে শতভাগ সম্ভব। আমাদের তো এত জমিই নাই দেশে। সর্বোচ্চ আমাদের ৩০ শতাংশ পর্যন্ত রিনিউএবল সম্ভব বলে মনে করি।
কার্বন এমিশনের কথা বাদ দিলে বাকিটা আসতে হবে নিউক্লিয়ার বা ক্রস বর্ডার ট্রান্সমিশন থেকে। আরেকটা ব্যাপার আছে আমাদের এখানে। ভেড়ামারা দিয়ে ভারত থেকে যে বিদ্যুৎ আসছে, সেটা একটু ব্যয়বহুল হয়েছে কারণ বাংলাদেশের ইলেকট্রিসিটি নেটওয়ার্ক খুব দুর্বল। ফ্রিকোয়েন্সি খুব ভ্যারি করে। ওরা বলছে আমরা পাওয়ার লাইন লাগিয়ে দেই, নয়েসটা ইন্ডিয়ায় চলে আসবে। ওরা একটা এইচভিডিসি হাই ভোল্টেজ ডিসি ব্যাক টু ব্যাক টার্মিনাল করে দিয়েছে। ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসছে ৪০০ কেভি লাইন দিয়ে। বিদ্যুৎটা আসার পর ডিসি হয়ে ইনপুট হচ্ছে, আবার এসি হয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। খরচ হয়েছে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার শুধু ওই বক্সটার জন্য। ওইটার কোনো ভ্যালু নাই কিন্তু। একটা বক্স কেবলমাত্র। এটা লেগেছে কারণ আমাদের ট্রান্সমিশন লাইনের দুর্বলতা।
আমাদের গ্রিড কোডও পুরোপুরি মেলে না ভারতের সঙ্গে। গ্রিড কোডটা করা হয় একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ স্ট্যান্ডার্ড মেনটেইন করার জন্য। সেটা হয়নি বলে খরচ বেড়েছে। কুমিল্লা থেকে যেটা আসছে, সেটার সাবস্টেশন কিন্তু কুমিল্লায়। আগরতলা থেকে বিদ্যুৎ আসছে, সেটা কুমিল্লার আশপাশে বিতরণ হচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশের কোনো ইনপুট নাই। ফলে বাংলাদেশের ফ্রিকোয়েন্সি ওখানে কোনো প্রভাব ফেলছে না। কিন্তু বিদ্যুৎখাতের দিকে চিন্তা করলে এটা একটা ভারতের টেরিটোরিতে পরিণত হয়েছে।
ডেইলি স্টার: সামনে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসবে। সৌরবিদ্যুৎও আনার পরিকল্পনা আছে। এগুলো একত্রে মেনটেইন করার জন্য আমাদের গ্রিড কতটা প্রস্তুত?
সাইফুর রহমান: আমাদের গ্রিড সিস্টেম তো অনেক দুর্বল। মনে করুন একটা গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। আপানর গাড়ির স্প্রিং ভালো না, গর্ত হলে ঝাকি খায়। দুর্বল গ্রিড মানে আমাদের স্প্রিংটা খারাপ। ভোল্টেজ আর ফ্রিকোয়েন্সি ফ্লাকচুয়েট করে। এটার রেশ পড়ে ব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে। ভোল্টেজ কমে-বাড়ে। ফ্রিজ চলে না।
এটা সবল করতে গেলে কিছু উপকরণ লাগে। যেমন একটা হচ্ছে ফ্লেক্সিবল এসি ডিভাইস নাই। জিজ্ঞেস করলে বলে টাকা নাই। কিন্তু আপনি টাকা তো পেয়েছেন। ৫০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছেন এইচভিডির জন্য। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে ধার করেছেন। ওটাও চাইলে করতে পারেন। আপনি কি চান ৫ বছর পরে, আপনার গ্রিড সিস্টেম কতটা আপগ্রেড করতে চান, এগুলো নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে।