
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন অন্তর্বর্তী সরকারের নৌ-পরিবহন এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি, সরকারের কার্যক্রম, ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান, পোশাক শ্রমিকদের পরিস্থিতিসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি।
অক্টোবরের দিকে তফসিল ঘোষণা, ডিসেম্বরে নির্বাচন এবং জানুয়ারির মধ্যে নতুন সরকার গঠন হতে পারে—এমন সংকেত পাচ্ছি।
দ্য ডেইলি স্টার: দেশ এখন কোন দিকে যাচ্ছে?
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: সরকারের সব কাজে একজন উপদেষ্টার সম্পৃক্ততা থাকে না। আমি যদি এই প্রশ্নের মূল বিষয় বুঝে থাকি, তাহলে বলতে পারি, নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে, তারা কাজ করছে। আমি যদি খুব ভুল না করে থাকি, তাহলে অক্টোবরের দিকে তফসিল ঘোষণা, ডিসেম্বরে নির্বাচন এবং জানুয়ারির মধ্যে নতুন সরকার গঠন হতে পারে—এমন সংকেত পাচ্ছি।
এরই মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস বলেছেন, জরুরি সংস্কার শেষে নির্বাচনে যেতে চাইলে এ বছরের শেষের দিকে এবং বিস্তৃত সংস্কার চাইলে আগামী বছরের প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে। সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন এসেছে। এগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু হয়েছে। আমরা মনে করি, সংস্কার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তাদের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো সংস্কার টিকবে না।
ডেইলি স্টার: পূর্ব অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা করছেন?
সাখাওয়াত হোসেন: আমি যা বলছি, এগুলো সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত মতামত। প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া টাইমলাইন অনুযায়ী ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। আমি মনে করি, কিছু বিষয়ে মৌলিক সিদ্ধান্তে না এসে নির্বাচনে যাওয়া উচিত নয়। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত সময়ের মধ্যে সেটা সম্ভব।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, পরবর্তী নির্বাচিত সরকার দীর্ঘমেয়াদী সংস্কার চালিয়ে নেবে। এটা আশাব্যঞ্জক বলে মনে করি। রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি একটি ভাবমূর্তি তৈরি করতে পেরেছেন। তিনি যখন এ ধরণের বক্তব্য রাখেন, তখন আশ্বস্ত হওয়ার মতো কারণ আছে।
তবে, অতীত অভিজ্ঞতা ভালো না থাকায় অনেকের মধ্যে সংশয় কাজ করে। কারণ, রাজনৈতিক দলে একজন নেতাই সব নন। তার দলে আরও অনেকে আছেন। এর বাইরে অন্যান্য দলও সংসদে যাবে। তারা কী চাইবে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।
আস্থা ফেরানোর আলাদা কোনো ফর্মুলা নেই। যারা দায়িত্ব পালন করবেন, তাদের বুঝতে হবে কাদের সঙ্গে কথা বললে হবে, কাদেরকে চায়ের দাওয়াত দিতে হবে।
ডেইলি স্টার: আপনি নির্বাচন কমিশনার ছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকে যদি বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচন কি নির্বাচন কমিশন করে নাকি সরকার?
সাখাওয়াত হোসেন: পৃথিবীর কোথাও নির্বাচন কমিশন একা নির্বাচন করতে পারে না। ছয়-সাত লাখ মানুষকে কাজ করতে হয়। পুলিশ, প্রিসাইডিং অফিসারসহ বেশিরভাগ বিষয়ে সরকারের সহযোগিতা নিয়ে কাজ করতে হয়। এতে দোষের কিছু নেই। প্রশ্ন হচ্ছে নির্বাচন বিষয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিটা কী।
যেমন: গত তিনটি নির্বাচনে সরকার চেয়েছে তাকে জিততে হবে, পরে অন্য কিছু। এটা করতে গিয়ে তারা প্রথমবার বিরোধীদল ছাড়া নির্বাচন করলো, দ্বিতীয়বার রাতের নির্বাচন করলো এবং তৃতীয়বার ডামি নির্বাচন করলো।
পৃথিবীতে এমন মডেলে নির্বাচন আর কোথাও দেখা যায়নি। এমনকি আমাদের দেশে এরশাদের আমলেও এমন ঘটনা ঘটেনি। জেলা প্রশাসকরা বেছে বেছে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের লোকজনকে প্রিসাইডিং অফিসার বানিয়েছিল।
ডেইলি স্টার: এখনো তো আগের অবস্থাই রয়ে গেছে। মানুষের মধ্যে কী বিশ্বাস এসেছে যে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু হবে, ভোট দিতে পারবে?
সাখাওয়াত হোসেন: সাধারণ মানুষের বিশ্বাস এখনো আসেনি। নির্বাচন কমিশনের উপরের দিকে পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু নির্বাচন নিয়ে গত এক দশকের বেশি সময়ে হওয়া অনিয়মের বিষয়ে মানুষের আস্থা রাতারাতি ফেরানো সম্ভব নয়। তাই অনাস্থার জায়গাটা এখনো রয়ে গেছে বলে মনে করি। মানুষের আস্থা ফেরানোই বড় চ্যালেঞ্জ।
নির্বাচন কমিশনকে বলবো, এটা কোনো আমলাতান্ত্রিক দায়িত্ব নয়। এটা অনেক কঠিন দায়িত্ব। সাধারণ মানুষের আপনাদের ওপর বিশ্বাস থাকতে হবে। যেমন: আমরা (যখন নির্বাচন কমিশনার ছিলাম) খারাপ-ভালো যাই করি, আমাদের ওপর মানুষের একটা বিশ্বাস ছিল।
ডেইলি স্টার: রাজনৈতিক সরকার মুখে মুখে নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতার কথা বললেও আসলে করে না। এখন অন্তর্বর্তী সরকার আছে। আপনারা কমিশনকে সহযোগিতা করবেন?
সাখাওয়াত হোসেন: অবশ্যই করবো। আমাদের সরকার থেকে এরই মধ্যে বলে দেওয়া হয়েছে, নির্বাচন কমিশনকে মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা ফেরাতে হবে।
আমরা যখন দায়িত্ব পালন করেছি তখন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছি। এর বাইরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে মানুষের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছি।
ডেইলি স্টার: নির্বাচন কমিশন কীভাবে সাধারণ মানুষের আস্থা ফেরাবে?
সাখাওয়াত হোসেন: এর আলাদা কোনো ফর্মুলা নেই। যারা দায়িত্ব পালন করবেন, তাদের বুঝতে হবে কাদের সঙ্গে কথা বললে হবে, কাদেরকে চায়ের দাওয়াত দিতে হবে। নিজেদের মতো কাজ করতে হবে।
ডেইলি স্টার: নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন ডিলিমিটেশন আলাদা কমিশনের মাধ্যমে সম্পন্ন করার সুপারিশ করেছে। এটা নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করবে বলে বর্তমান কমিশন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। আপনি কী মনে করেন?
সাখাওয়াত হোসেন: ডিলিমিটেশন অনেক জটিল একটি বিষয়। অন্যান্য দেশে এটা সাধারণত একটি কমিশনের মাধ্যমে হয়। নির্বাচন কমিশন এটা করলে রাজনৈতিক দলের দোষারোপের শিকার হতে হয়। আলাদা কমিশনের মাধ্যমে হলেও নির্বাচন কমিশনের প্রণীত গাইডলাইন অনুযায়ী কাজ করতে হয়। এমন হলে মনে করি ভালো উদ্যোগ হবে।
ব্যাংক কোথা থেকে ঋণ দেবে? কোম্পানিগুলো তো ঋণ নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। বেক্সিমকো যেসব কোম্পানির নামে ঋণ নিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ১৬টির হদিসই পাওয়া যাচ্ছে না।
ডেইলি স্টার: বেক্সিমকোর কারখানা নিয়ে কী হচ্ছে? এত শ্রমিক বেকার হচ্ছে কেন? সালমান এফ রহমান থাকতে তো কারখানা বন্ধ হয়নি।
সাখাওয়াত হোসেন: খুব ভালো একটা প্রশ্ন করেছেন। এটাই হচ্ছে আমাদের বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা। সরকার কোনো কারখানা বন্ধ করেনি। কারখানা বন্ধ হচ্ছে, কারণ এসব কোম্পানি ব্যাংক ঋণ নিয়ে সাব-কন্ট্রাক্টে চলছিল। এখন ব্যাংক আর ঋণ দিচ্ছে না, কারখানাও চলতে পারছে না। ব্যাংক কোথা থেকে ঋণ দেবে? কোম্পানিগুলো তো ঋণ নিয়ে আর ফেরত দেয়নি।
বেক্সিমকোতে ২৭ হাজার শ্রমিকের হিসাব আমরা পেয়েছি। কিন্তু বেক্সিমকো যেসব কোম্পানির নামে ঋণ নিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ১৬টির হদিসই পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থাৎ এসব কোম্পানির নামে ঋণ নিয়েছে, শ্রমিক দেখানো হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে হদিস নেই।
ডেইলি স্টার: তাহলে ঋণ নিয়ে টাকাটা কোথায় বিনিয়োগ করেছে?
সাখাওয়াত হোসেন: শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম বেক্সিমকো ২৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এটা ভাবা যায়? অন্যান্য ব্যাংক মিলিয়ে বেক্সিমকো মোট ৪০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এসব টাকা নিয়ে কী করেছে হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না।
ডেইলি স্টার: ব্যবসার জন্য ঋণ নিতে সমস্যা কোথায়?
সাখাওয়াত হোসেন: ঋণ নিতে সমস্যা নেই। কিন্তু এসব ঋণের কোনো টাকা তো ফেরত দেয়নি।
ডেইলি স্টার: আপনারা ফেব্রুয়ারির মধ্যে বেক্সিমকোর শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
সাখাওয়াত হোসেন: আমরা হিসাব করে দেখেছি, এখানে ৫০০ কোটি টাকার বেশি লাগবে। অর্থ বিভাগকে বলেছি, মানবিক কারণে এই টাকা দিতে হবে। সেইসঙ্গে এসব শ্রমিকের কর্মসংস্থান কীভাবে করা যায় সেই চিন্তাও চলছে। সরকার কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার পক্ষে নয়। শ্রমিকদের ক্ষতি হয় এমন কোনো উদ্যোগ সরকার নেবে না। দুই দফায় ৫৫ কোটি এবং ৫৮ কোটি টাকা সরকারের তরফ থেকে শ্রমিকদের দেওয়া হয়েছে।
আমেরিকার একটি কোম্পানি বেক্সিমকোর প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। তারা মূল্যায়ন করছে যে বেক্সিমকোর প্রতিষ্ঠানগুলোকে টেকওভার করতে পারে কি না। জাপানের একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীও বেক্সিমকোর বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। তারা তিনমাসের পাইলটিং করে দেখবে যে প্রতিষ্ঠানগুলো চালানো যায় কি না।
ডেইলি স্টার: বেকার শ্রমিকদের কী হবে?
সাখাওয়াত হোসেন: আমেরিকার একটি কোম্পানি বেক্সিমকোর প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। তারা মূল্যায়ন করছে যে বেক্সিমকোর প্রতিষ্ঠানগুলোকে টেকওভার করতে পারে কি না। তারা নিলে ব্যাংকঋণগুলোকে কীভাবে কী করা হবে, সেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।
জাপানের একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীও বেক্সিমকোর বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। তারা তিনমাসের পাইলটিং করে দেখবে যে প্রতিষ্ঠানগুলো চালানো যায় কি না। এ বিষয়ে ইতিবাচক কিছু হলে সরকার এসব প্রতিষ্ঠান যাতে চলতে পারে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে। এতে শ্রমিকদের বেকার হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না আশা করি।
ডেইলি স্টার: অন্যের কোম্পানি এভাবে চালাতে গেলে আইনি জটিলতায় পড়তে হবে না?
সাখাওয়াত হোসেন: এসব নিয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কাজ করছে।
ডেইলি স্টার: গাজী গ্রুপের কোম্পানিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেগুলোর কী হবে?
সাখাওয়াত হোসেন: ওদের বিষয়ে কেউ আসেনি। এ বিষয়ে আমার জানা নেই।
ডেইলি স্টার: যেসব কারখানায় টাকা দিতে হচ্ছে, তাদের মালিকদের আয় করা টাকা কোথায়?
সাখাওয়াত হোসেন: এটা আমাদেরও প্রশ্ন। গত সরকারের আমলে এত এত উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু কেউ টাকা দেশে আনেনি।
রাষ্ট্রের অবস্থা বুঝতেই তিন মাস লেগেছে। ব্যাংকগুলো লুট করা হয়েছে, রিজার্ভের অবস্থা ছিল শোচনীয়, অর্থনীতি নিয়ে সরকার অসম্ভব চ্যালেঞ্জে ছিল। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বলতে কিছুই ছিল না, তারপরও অল্প সময়ের মধ্যে অসাধারণ উন্নতি হয়েছে।
ডেইলি স্টার: সরকারের ছয় মাসকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
সাখাওয়াত হোসেন: এই সরকারের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে রাষ্ট্রটা ব্যর্থ হয়ে যায়নি, রাষ্ট্র ফাংশন করছে। যদিও পরিস্থিতি আরও ভালো হলে খুশি হতাম। এর জন্য সবচেয়ে বড় ক্রেডিট হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণের।
একটি লিডারলেস আন্দোলনের পর কী হয় তার উদাহরণ ইরাক, লিবিয়াতে আমরা দেখছি। বাংলাদেশে একটি সরকার হঠাৎ হওয়া আন্দোলনে সব ছেড়ে পালিয়েছে। জাতীয় সংসদে বিরোধী দল পর্যন্ত নেই যারা হাল ধরবে। ঠিক তখন আমাদের সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। অনেকে চেয়েছে দেশটা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ুক, এখনো অনেকে চাচ্ছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ এই সরকারের ওপর আস্থা রেখেছে।
ডেইলি স্টার: মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি ছিল।
সাখাওয়াত হোসেন: রাষ্ট্রের অবস্থা বুঝতেই তিন মাস লেগেছে। ব্যাংকগুলো লুট করা হয়েছে, রিজার্ভের অবস্থা ছিল শোচনীয়, অর্থনীতি নিয়ে সরকার অসম্ভব চ্যালেঞ্জে ছিল।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বলতে কিছুই ছিল না, তারপরও অল্প সময়ের মধ্যে অসাধারণ উন্নতি হয়েছে। এর মূল কৃতিত্ব সাধারণ মানুষের। আমি দাবি করছি না যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রত্যাশিত উন্নতি হয়েছে। যদি সেটা হতো তাহলে সেনাবাহিনীকে এতদিন ক্যান্টনমেন্টের বাইরে রাখার প্রয়োজন হতো না।
নিত্যপণ্য আমদানি নির্ভর একটা দেশে এভাবে সরকার পতন হলে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা তৈরি হয়ে যায়। সেই জায়গা থেকে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছি। এর মধ্যে পতিত সরকারের দুষ্কৃতিকারীরা সরকারকে অস্থিতিশীল করতে বিভিন্নভাবে কাজ করছে। তিতুমীর কলেজের আন্দোলন আপনারা দেখেছেন।
ডেইলি স্টার: তিতুমীরের ছাত্রদের পেছনে পতিত সরকারের লোকজন ছিল?
সাখাওয়াত হোসেন: অবশ্যই।
ডেইলি স্টার: যত কিছুই হোক, মানুষ এই সরকারের কাছে তাদের প্রত্যাশা বড় করেই দেখতে চায়?
সাখাওয়াত হোসেন: এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু আমাদের বড় সমস্যা হচ্ছে, ধৈর্য কম। যা ১৬ বছরে হয়নি তা কী ছয় মাসে করে দেওয়া সম্ভব? অন্তত এতটুকু তো বুঝতে হবে।
ডেইলি স্টার: সেটা হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু সরকার ঠিক পথে আছে কি না, গতিশীল থাকতে পারছে কি না, সেই প্রশ্নগুলো উঠছে।
সাখাওয়াত হোসেন: মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়তো সরকারের গতি ৮০ কিলোমিটার হলে ভালো হতো। আমরা হয়তো ৪০-৫০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারছি। ৮০ কিলোমিটার গতিতে উঠতে গেলে আমাদেরকে সময় দিতে হবে।
ডেইলি স্টার: আপনাদের হাতে এত সময় নেই।
সাখাওয়াত হোসেন: ঠিক। আমরা কয়েক বছর ক্ষমতায় থাকবো না যে সব কাজ গুছিয়ে যেতে পারবো। আমাদের পরে যারা দায়িত্ব পাবেন তারা সেটা চালিয়ে নেবেন। রাষ্ট্রটা তো আমাদের সবার।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হলো ভালো হতো। তবে আগের মতো গুম, খুন, তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না, এতটুকু উন্নতি হয়েছে।
ডেইলি স্টার: জুলাই আন্দোলনে আহত ব্যক্তি, নিহতদের পরিবারকে রাস্তায় নামতে হচ্ছে কেন?
সাখাওয়াত হোসেন: বেশ কয়েকজনকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হয়েছে, আরও যাবেন। দেশে যারা আছেন তাদের অনেকের কাছে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা পৌঁছেছে। অসন্তোষ আছে কাজের গতি নিয়ে। আশা করি এটাও কেটে যাবে, কাজ হচ্ছে।
ডেইলি স্টার: আহতরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় প্রতিবাদ করেন, একজন উপদেষ্টাকেও সেখানে যেতে দেখা যায় না। সেখানে যান হাসনাত আব্দুল্লাহরা। উপদেষ্টারা তাহলে কী করেন?
সাখাওয়াত হোসেন: আমি আপনাদের সঙ্গে একমত। এটা আমাদের ইন্ডিভিজুয়াল ফেইলর অথবা কালেকটিভ ফেইলর।
ডেইলি স্টার: আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মানুষ খুবই উদ্বিগ্ন।
সাখাওয়াত হোসেন: আমরাও বুঝি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হলো ভালো হতো। তবে আগের মতো গুম, খুন, তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না, এতটুকু উন্নতি হয়েছে।
ডেইলি স্টার: যুবদল নেতাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হত্যার অভিযোগ করেছে পরিবার।
সাখাওয়াত হোসেন: এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তদন্ত চলছে।
ডেইলি স্টার: এই সময়ে এমন সাহস তারা কীভাবে পেল?
সাখাওয়াত হোসেন: আমি বললাম, খুব দ্রুত এ ঘটনায় শাস্তির কথা জানতে পারবেন। এর আগে এক ব্রিগেডিয়ার ডাকাতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছিল। সাতদিনের মধ্যে তাকে চাকরিচ্যুত করে জেলে পাঠানো হয়েছে।
লন্ডনে গিয়েছি, বিজনেস ক্লাসের টিকেট নেইনি, ইকোনমি ক্লাসে গিয়েছি। ভিআইপি টার্মিনাল ব্যাবহার না করায় আমার সহকর্মীদের তো মূর্ছা যাওয়ার অবস্থা।
ডেইলি স্টার: উপদেষ্টা ও সচিবদের গাড়ি ব্যবহার নিয়ে আগেও প্রশ্ন ছিল, এই সরকারের আমলেও উঠছে। কেন?
সাখাওয়াত হোসেন: অন্যদের বিষয়টা বলতে পারবো না। আমার জন্য বরাদ্দ সরকারি গাড়ির বাড়তি ব্যবহার করি না, আমার পরিবারের কাউকে করতে দেই না। আমি যে সরকারি গাড়িটি ব্যবহার করি, সেটাতে আমার স্ত্রী মাত্র দুইবার উঠেছেন, তাও আমার সঙ্গে।
বিদেশে গেলে ভিভিআইপি টার্মিনাল ব্যবহার করি না। অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটেও ভিভিআইপি টার্মিনাল ব্যবহার করি না। লন্ডনে গিয়েছি, বিজনেস ক্লাসের টিকেট নেইনি, ইকোনমি ক্লাসে গিয়েছি। ভিআইপি টার্মিনাল ব্যাবহার না করায় আমার সহকর্মীদের তো মূর্ছা যাওয়ার অবস্থা। তাদের বলি, তোমরা যারা ভিভিআইপিতে যেতে চাও যাও, আমি সাধারণ লাইনে দাঁড়িয়ে যাবো।
ডেইলি স্টার: শ্রম আইন সংশোধন কতদূর এগোলো?
সাখাওয়াত হোসেন: আইএলও স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে কিছু বিষয়ে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ। একটি কারখানায় শতকরা ১৫ জন সম্মত হলে ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারবে—এমন একটা সিদ্ধান্তের বিষয়ে মালিক, শ্রমিক ও সরকারের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় কথা হচ্ছে।
ডেইলি স্টার: পোশাক শ্রমিকদের যে সমস্যাগুলো হয়েছে এগুলো কি সামনে বৃদ্ধির আশঙ্কা আছে?
সাখাওয়াত হোসেন: শ্রমিকদের সমস্যাগুলোর সমাধানে সঠিক ব্যবস্থা নিতে সরকার কার্পণ্য করছে না। কিন্তু শ্রমিকদের একটি অংশকে উস্কানি দেওয়ার মাধ্যমে অন্য পক্ষ সমস্যা তৈরি করতে চাচ্ছে। এটাই বড় সমস্যা।
ডেইলি স্টার: শ্রমিকদের উস্কানি দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে সব সরকারই অভিযোগ করে, আপনারও করছেন। কেন?
সাখাওয়াত হোসেন: একটা উদাহরণ দেই। বেক্সিমকোর ইস্যুতে শ্রমিকদের নিয়ে বসার সিদ্ধান্ত হলো। শ্রমিক নেত্রী মোশারেফা মিশুসহ অন্যদের সঙ্গে বৈঠক করবো বলে বসে আছি। তার আগেই রাস্তা আটকানো হলো, গাড়িতে আগুন দেওয়া হলো, গ্রামীণের ফ্যাক্টরিতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটলো। এগুলো কারা ঘটালো? এগুলোকে আমরা কী বলবো? সমস্যা হয়েছে বেক্সিমকোর কারখানায়, গ্রামীণের কারখানায় আগুন কেন?
ডেইলি স্টার: বন্দরগুলোর কী অবস্থা?
সাখাওয়াত হোসেন: অভ্যুত্থানের পর সমস্যা হচ্ছিল। এখন স্থিতিশীল আছে। এরই মধ্যে আমি তিনবার পরিদর্শন করেছি। ডেডলাইন দিয়ে দিয়ে বন্দর ভিজিট করছি, যাতে দ্রুত বন্দরের সেবার উন্নতি হয়। ২০ বছর আগের কনটেইনার বন্দরে এখনো পড়ে আছে। এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে নির্দেশ দিয়েছি, কাজ হচ্ছে।
ডেইলি স্টার: সিন্ডিকেট ভাঙতে পেরেছেন?
সাখাওয়াত হোসেন: অস্বীকার করবো না, সিন্ডিকেট এখনো ভাঙা যায়নি। চেষ্টার মধ্যে আছি।
ডেইলি স্টার: এই সময়েও একই অবস্থা?
সাখাওয়াত হোসেন: একটা সিস্টেম যখন চলতে থাকে তখন হঠাৎ করে সেটা পরিবর্তন কী ধরণের প্রভাব ফেলতে পারে সেটা আগে ভাবতে হয়। এমনিতেই সরকার একটা উদ্যোগ নিলে নানান জায়গা থেকে 'গেল গেল' বলে জিকির তোলা হয়। ফলে অনেক চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
সিন্ডিকেট এখনো ভাঙা যায়নি। চেষ্টার মধ্যে আছি।
ডেইলি স্টার: গভীর সমুদ্র বন্দরের কী অবস্থা? আমাদের কি এটা দরকার? আমরা চালাতে পারবো? শ্রীলঙ্কা দুটি গভীর সমুদ্র বন্দর করে এখন চীনের কাছে লিজ দিয়েছে।
সাখাওয়াত হোসেন: অবশ্যই আমাদের গভীর সমুদ্র বন্দর প্রয়োজন। এতদিন হচ্ছিল না চীন ও ভারতের দ্বন্দ্বে। এখন জাপান করবে। তাই সমস্যা কেটে গেছে। এটা পরিচালনার জন্য ঠেকবে না। আমরা পারবো।
বিদ্যমান বন্দরগুলোর অবস্থাও ভালো। ডেনমার্ক, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব দুবাইসহ অন্তত পাঁচটি দেশের বিনিয়োগকারীরা বন্দরে বিনিয়োগ করতে লাইন ধরে আছে। মাতারবাড়ীতে সৌদি আরব সামগ্রিকভাবে দায়িত্ব নিতে আগ্রহী। মোংলাতে চীন দুটি কনটেইনার টার্মিনাল বানাবে।
ডেইলি স্টার: শেষ প্রশ্ন। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উপরে উপরে যা দেখা যাচ্ছে ভেতরেও কী তাই?
সাখাওয়াত হোসেন: আমরা কী ভারতের সঙ্গে মারামারি করতে গিয়েছি? গালি দিয়েছি? একটা উদাহরণ দেন। আমরা সমতার ভিত্তিতে সম্পর্কের কথা বলেছি। এটা কী খারাপ কথা?
বাংলাদেশ ভারতকে কী কী দিয়েছে সে সম্পর্কে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উক্তিই যথেষ্ট যে, 'ভারত কোনো দিন সেটা ভুলতে পারবে না'।
অথচ দেখেন, নেপাল ও ভুটান থেকে আমাদের দেশের বন্দর ব্যবহারের জন্য সামান্য অনুমতিটুকুও ভারত দেয়নি। কারণ তারা বাংলাদেশের মানুষকে মূল্যায়ন করে না। সরকারের সঙ্গে সম্পর্ককেই শুধু গুরুত্ব দেয় ভারত, যা বিগত ১৬ বছরে কী হয়েছে আপনারা জানেন।
ডেইলি স্টার: তখন সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া নিয়ে সমস্যা হয়নি, এখন কেন হচ্ছে?
সাখাওয়াত হোসেন: তখন সরকার কিছু বলেনি, তাই সমস্যাও দেখা যায়নি। মানুষ গুলি করে মেরেছে, বাংলাদেশ সরকার কিছু বলেনি। বিজিবিকে বলেছে পতাকা বৈঠক করে মরদেহ নিয়ে আসতে।
কিন্তু এখন আমরা কথা বলছি, প্রতিবাদ জানাচ্ছি। তুমি একটা মাইর দিলে আমি ঘুষি না দিতে পারি একটা থাপ্পড় দিব। আমি তো আমাদের পক্ষ থেকে ভারতের সঙ্গে কোনো গণ্ডগোল দেখি না। তারা এত বড় দেশ, তাদের সঙ্গে আমি কেন গণ্ডগোল করতে যাবো?
ডেইলি স্টার: এই সরকার নিয়ে ভবিষ্যতে মানুষ কীভাবে মূল্যায়ন করবে বলে মনে করেন।
সাখাওয়াত হোসেন: বিদায়ের পর গালিও খাবো, ভালো কথাও শুনবো।