Image description

দীর্ঘ ৮ বছর গুমের শিকার বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার আহমেদ বিন কাসেম আরমান প্রধান উপদেষ্টা ও গুমের শিকার অন্যদের সাথে আটকে রাখার স্থান পরিদর্শন করে ফেরার পর আয়নাঘরের আলামত নষ্ট করা সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। তিনি দমবন্ধ হওয়ার মতো সেই দীর্ঘ সময়ের পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন।

বলেছেন, আমাদের কেন এই অবর্ণনীয় অবস্থার মধ্যে রাখা হচ্ছে জানতে চাইলে বলা হতো ওপরের আদেশ হলো, আমাদের (বন্দীদের) সাথে এমন আচরণ করতে হবে যাতে আমাদের মৃত্যুও যেন না হয়, আবার ভালোভাবে যেন বেঁচেও থাকতে না পারি। এই অসহনীয় নির্যাতনের ৮ বছরে আমরা সূর্যের আলো পর্যন্ত দেখতে পাইনি। নিকষ অন্ধকার বা জালিয়ে রাখা আলোতে বোঝার উপায় ছিল না কখন দিন আর কখন রাত। হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় দুঃসহ দিনগুলোতে মনে হতো মৃত্যুর যন্ত্রণাও মনে হয় এর চেয়ে সহজ।

ফ্যাসিবাদী শাসনের সাজানো বিচারে মৃত্যুদণ্ড দেয়া বিশিষ্ট শিল্পোদ্যোক্তা ও জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা মীর কাসেম আলীর চূড়ান্ত রায়ের ১৩ দিন আগে তার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় কনিষ্ঠ ছেলে মীর আহমদ বিন কাসেম আরমানকে। এরপর ৮ বছর তাকে কোথায় কিভাবে রাখা হয়েছে তার কোনো খোঁজ কেউ পায়নি। তিনি জীবিত না মৃত তাও ছিল অজানা। ব্যারিস্টার আরমান আয়নাঘরে তার আট বছরের ভয়াবহ বন্দী জীবনের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন নয়া দিগন্তকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন পত্রিকার হেড অব মাল্টিমিডিয়া যুবরাজ ফয়সল। সাথে ছিলেন নির্বাহী সম্পাদক মাসুমুর রহমান খলিলী। সাক্ষাৎকারটির প্রথম পর্ব আজ পাঠকদের জন্য দেয়া হলো।

নয়া দিগন্ত : কিভাবে আপনাকে আটক করা হলো?

ব্যারিস্টার আরমান : তারা যখন আমাকে নিয়ে যায় তখন আমি আমার পিতা মীর কাসেম আলীর মামলা পরিচালনা করছিলাম। মামলা আপিল শুনানির পর রিভিউ শুনানির শেষ পর্যায়ে ছিল। এক দিন বা দুই দিন শুনানির পর চূড়ান্ত রায় হয়ে যাবে; এমন পর্যায়ে ছিল মামলাটি। আদালত থেকে বাসায় ফেরার পথে অজ্ঞাত একটি গাড়ি আমার গাড়িকে অনুসরণ করছিল। বাসায় ঢোকার কিছুক্ষণ পর একদল লোক বাসায় চলে আসে। তারা বলল, আমাকে তাদের সাথে যেতে হবে। তারা আমাকে জোর করে টেনে হিঁচড়ে বাসা থেকে নিয়ে যায়। গাড়িতে তুলে সাথে সাথে তারা আমার চোখ বেঁধে ফেলে। ওই সময় থেকেই এক অন্ধকার জীবন শুরু হয় আমার। প্রথম চোখ বেঁধে ফেলার পর থেকে আট বছর একইভাবে আমার চোখ বেঁধে রাখা হয়েছে। ছোট একটি সেলের ভেতরেও আমার চোখ বেঁধে রাখত। হাতকড়া পরিয়ে রাখা হতো। যখন আমি তাদের বলতাম আমি তো এখন সেলের ভেতরে; এখন হাতকড়া পরিয়ে রেখেছেন কেন। তারা বলত, এখানে এটাই নিয়ম। ২৪ ঘণ্টা হাত ও চোখ বেঁধে রাখা হতো। তারা আরো বলত, এখানে যারা আছে সবার সাথে একই ব্যবহার করা হচ্ছে। এমন একটা সেলে রাখা হতো যেখানে কোনো জানালা ছিল না। ভেতরে থেকে আমি বাইরে দিন না রাত বুঝতে পারতাম না। আমরা কে কোথায় আছি এটাও বলা হতো না। আজ কত তারিখ তাও বলত না। নামাজের সময়ও বলত না। ওয়াক্ত হয়েছে কি না বারবার জিজ্ঞেস করতাম। বলত, এখানে এটাই নিয়ম। কিছু বলা যাবে না, এটাই উপরের আদেশ। একমাত্র রমজান মাস এলে বলত, আজ রমজান মাস শুরু হয়েছে। এই রমজান নিয়ে বছর হিসাব করতাম। আটটি রমজান ও ১৭টি ঈদ আমি ওখানে কাটিয়েছি। এই থেকে আমি বুঝতাম কতটুকু সময় আমার কেটেছে।

নয়া দিগন্ত : বন্দীদের সাথে কী ধরনের আচরণ করা হতো?

ব্যারিস্টার আরমান : আমি যেখানে ছিলাম সেখানে বন্দীদের সাথে সুচিন্তিত ও পরিকল্পিতভাবে নির্মম ও নির্দয় আচরণ করা হতো। অমানবিক আচরণ করা হতো এমনভাবে যেন তারা মৃত্যুর চেয়েও কষ্টদায়ক এক অভিজ্ঞতায় পৌঁছে যায়। একজন বন্দীকে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম যে প্রয়োজনটুকু হতো সেখান থেকেও তাদের বঞ্চিত করা হতো। আবার কোনো বন্দী মৃত্যুর কাছাকাছি চলে গেলে যাতে সে মরতে না পারে সে জন্যও ব্যবস্থা করা হতো। একটা হাসপাতালে যত ধরনের মেডিক্যাল ফ্যাসিলিটিজ থাকা দরকার সব ছিল সেখানে। ডাক্তার ছিল চব্বিশ ঘণ্টা, মেডিক্যাল স্টাফ ছিল। হার্ট অ্যাটাক বা এ ধরনের কোনো অসুখ যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা হতো। ততটুকুই চিকিৎসা দেয়া হতো যাতে সে মরতে না পারে। বাঁচতেও যে উপকরণ তা দেয়া হতো না; আবার মরতেও দেয়া হতো না। তাদের মৃত্যুকে বিলম্বিত করে ভোগান্তিকে দীর্ঘায়িত করা হতো।

নয়া দিগন্ত : কার নির্দেশে বন্দীদের সাথে এমন আচরণ করা হতো?

ব্যারিস্টার আরমান : এটা করা হতো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ জায়গা থেকে মনিটরের মাধ্যমে এবং এই নীতিগত সিদ্ধান্ত সর্বোচ্চ জায়গা থেকেই এসেছে। আমি যখন বারবার বলতাম, আমাকে কেন আটক করা হয়েছে, কী অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে? তখন তারা বলত, ওপরের আদেশ। আমরা আদেশ পালন করছি। এভাবেই কেটেছে আমার আট বছর।

নয়া দিগন্ত : কী ধরনের খাবার দেয়া হতো?

ব্যারিস্টার আরমান : একটা জিনিস, সত্য কথা বলতে হবে। খাবারের মান ভালো ছিল। যারা আমাকে খাবার দিত তারা বারবার আমাকে বলেছে, যে খাবার আমরা খাচ্ছি, সেই খাবারই আপনাদেরকে দিচ্ছি। তবে পরিমাণ সীমিত ছিল। একজন প্রহরী আমাকে বলেছেন, প্রহরী হিসেবে তাদের জন্য যা বরাদ্দ ছিল, বন্দীদের জন্য তার অর্ধেক ছিল বরাদ্দ। কিন্তু তাদের জন্য বাইরে থেকে খাবার আসত। এখন আমরা গুম কমিশন থেকে জানতে পারছি ক্যান্টনমেন্ট বা ব্যারাক থেকে বন্দীদের জন্য খাবার আসত। সেখান থেকে যা বরাদ্দ করা হতো সৈনিকদের জন্য তার অর্ধেক বন্দীরা পেত।

নয়া দিগন্ত : অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সাথে আয়নাঘর পরিদর্শনে আপনারা কয়েকজন বন্দী গিয়েছিলেন। কী ধারণা হলো?

ব্যারিস্টার আরমান : প্রথমত, আমার লোকেশন আমি বুঝতে পারিনি। আট বছর বন্দী থাকার পর এক ধরনের ধারণা জন্মেছিল। গুম কমিশন গঠনের পর তারা আমাদের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আমি স্মৃতি থেকে কিছু তথ্য শেয়ার করি। তারা আমার বক্তব্য অন্যান্য বন্দীর কাছ থেকে নেয়া তথ্যের সাথে মিলিয়ে আমাকে কোথায় রাখা হয়েছিল তা আবিষ্কার করে। সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য হচ্ছে, তারা ওই বিল্ডিংয়ের কাঠামোটাই চেঞ্জ করে ফেলছে। বিভিন্ন সেল ভেঙে ফেলেছে। দরজা ভেঙে, দেয়াল তুলে সেগুলো রঙ করে দেয়া হয়েছে। নতুন রঙ করা হয়েছে, যাতে বোঝা না যায় সেখানে কয়লা দিয়ে কালো করে রাখা হয়েছে। কিন্তু বন্দী থাকার সময় আমাকে যখন চিকিৎসার জন্য বের করা হয়, বিভিন্ন সময় আট-দশবার বের করা হয়েছিল, তখন সেল থেকে বের হয়ে ডান দিকে ঘুরে ৫ ধাপের একটা সিঁড়ি পেতাম। এটা গুম কমিশনের কাছে জানাই। এই সিঁড়িটি ছিল তাদের মেইন ক্লু যেখান থেকে তারা সেলটি আবিষ্কার করতে পারে। আমার ভাষ্য অনুযায়ী দেয়াল ভেঙে আমাকে যে সেলে রাখা হয়েছিল গুম কমিশন তা আবিষ্কার করে। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহর কাছে হাজার শোকর, গুম কমিশনের নিরলস প্রচেষ্টা ও নির্ভিক তদন্তের কারণে আমাকে বন্দী রাখার সেল আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। আমি যখন ফের পরিদর্শনে যাই তখন আমাকে বন্দী রাখার সেলটি চিনতে পারি। আপনাদের মাধ্যমে আমি প্রধান উপদেষ্টা ও প্রসিকিউটরদের ধন্যবাদ জানাতে চাই যে, নানা প্রতিকূলতার মধ্যে তারা আয়নাঘর ভিজিট করেছেন। যারা আটক ছিলেন তাদের জন্য এটা একটা আস্থার জায়গা সৃষ্টি করেছে।

নয়া দিগন্ত : কিভাবে মুক্তি পেলেন?

ব্যারিস্টার আরমান : যখন আমরা আটক ছিলাম তখন বুঝতে পারতাম না দিন নাকি রাত। আমাকে যখন বের করা হলো তখন গভীর রাত। আমি তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ছিলাম। এ সময় আট-দশজন সেলের মধ্যে ঢুকে গেল। নরমালি গভীর রাতে তারা আসে না। ওই সময় তারা ঘুমায়। আমাকে তারা কড়া ভাষায় বলল, তাড়াতাড়ি নামাজ শেষ করেন। সাধারণত নামাজ পড়ার সময় তারা এমন আচরণ করত না। কিন্তু ওই দিন তাদের ওই তাড়াহুড়া দেখে আমি মনে করলাম, হয়তো আমাকে মেরে ফেলা হবে। নামাজ শেষ করলাম তাড়াতাড়ি। তারা চোখ বাঁধত সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী যেমন পোশাক পরে ওই ধরনের কাপড় দিয়ে। কিন্তু ওই দিন গামছা দিয়ে আমার চোখ বাঁধল। হাতকড়া খুলে গামছা দিয়ে আমার হাত বেঁধে ফেলল এবং আমাকে বের করে নিয়ে আসল। আমি মনে করলাম মৃত্যুর পর যাতে কেউ আমার লাশ দেখে বাহিনীর ওই ধরনের পোশাক দেখে চিনতে না পারে সেজন্যে গামছা দিয়ে চোখ ও হাত বেঁধেছে। যখন আমাকে নামানো হয় তখন মনে করলাম এখন একটা গুলির আওয়াজ শুনব, তারপর সবকিছু শেষ হয়ে যাবে।

আলহামদুলিল্লাহ! ফের যখন আয়নাঘর দেখতে যাই তখন মনে করলাম সৃষ্টিকর্তার কোনো পরিকল্পনা আছে আমাকে নিয়ে। যে জন্য আমাকে জীবিত রেখেছেন। আয়নঘর পরিদর্শনের সময় অন্যান্য বন্দীদের সাথে কথা বলছিলাম, একজন বললেন স্বৈরাচার, ফ্যাসিস্ট শাসক হাসিনা যদি ২৪ ঘণ্টা আগে বুঝতে পারত যে তাকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে, চলে যেতে হবে, তাহলে একজন লোক হলেও মেরে ফেলত এবং সেটা হচ্ছে আমি। কারণ কোনো রকম প্রমাণ রাখার সিদ্ধান্ত তাদের ছিল না। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় সেই ফ্যাসিস্ট ৩০ মিনিটের বেশি সময় পায়নি। একটা স্যুটকেস গোছানোর সময়ের চেয়ে বেশি সময় সে পায়নি। এজন্য হয়তো আমরা বেঁচে এসেছি। ফের আয়নাঘরে যাওয়ার পর আমার প্রথম অনুভূতি হচ্ছে এর একটা বিচার হওয়া দরকার। সারা দুনিয়ার মানুষের জানা দরকার ক্ষমতার লোভে মানুষ কত নিচে নামতে পারে! একজন মানুষ আরেকজন মানুষের সাথে কত নির্মম আচরণ করতে পারে। পশুর চেয়েও খারাপ আচরণ করতে পারে কিভাবে। সেটা একদিন নয়, বছরের পর বছর এবং সেটা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত এবং মনিটর করা হতো।

নয়া দিগন্ত : আপনি কি মনে করেন এ ঘটনার বিচার করা সম্ভব? কোন আইনে এর বিচার করা যেতে পারে।

ব্যারিস্টার আরমান : বাংলাদেশে আমাদের সাথে যা হয়েছে তা আন্তর্জাতিক আইনে একটি মানবতাবিরোধী অপরাধের সুনির্দিষ্ট খাতের মধ্যে পড়ে। এ ছাড়া সনাতনী আইন হিসেবে দেশে একটি পুরনো আইন আছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এই অ্যাক্ট যদিও অনেক পুরনো, তার ওপর গত স্বৈরশাসক ও ফ্যাসিস্ট সরকার এ আইনের প্রচুর অপব্যবহার করেছে। এ আইনটার আমূল পরিবর্তন করা দরকার। পরিভাষায় এ ধরনের অপরাধকে আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। এ জন্য যে অভিজ্ঞ আইনজীবী দরকার তা বাংলাদেশে সীমিত। সরকারের উচিত জাতিসঙ্ঘের সহায়তা নেয়া। তাদের মতামত অনুযায়ী এ আইনটিকে ঢেলে সাজানো এবং নিশ্চিত করা যে, আইনে বিচারের সময় কেউ যেন হস্তক্ষেপ করতে না পারে। অতীতে আমরা দেখেছি, এ আইনে বিচারের সময় হস্তক্ষেপ করা হতো, সাক্ষীদের অপহরণ করা হয়েছে জেলগেট থেকে। সাক্ষীদের আটকে রেখে শেখানো হতো তাদের কী বলতে হবে। ফলে স্বাধীনভাবে বিচার হয়নি। ভবিষ্যতে যে বিচার হবে তা যেন আন্তর্জাতিক মানের হয়। সেটা দেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হতে হবে এবং এটা ন্যায়বিচার হবে।

গত ফ্যাসিস্ট সরকার সবচেয়ে বেশি যেটা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে সেটি হচ্ছে বিচার বিভাগ। বিচার বিভাগকে তারা রাবার স্ট্যাম্পে পরিণত করেছে। তাদের কথা মতো বিচারককে রায় দিতে তারা বাধ্য করেছে। যদি কেউ তাদের কথা না শুনতো তবে তাদের মৃত্যুর হুমকি দিয়ে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। এ বিচার যদি সঠিকভাবে করা যায় তাহলে বিচার বিভাগের হারানো গৌরব ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। বিশেষ করে, বর্তমানে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার ভাবমূর্তি চরম সঙ্কটে। যদি অন্তর্বর্তী সরকার, দেশী আইনজীবী ও আন্তর্জাতিক সহায়তা নিয়ে ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার একটি ন্যায়বিচার করা সম্ভব হয়, তাহলে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করার এটি একটি সুযোগ। আমার আশা, এই বিচারটি সুষ্ঠু হবে, দেশী ও আন্তর্জাতিক মানের হবে এবং দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে বিচারটি স্বীকৃত হবে। এতে আমরা যারা ভিকটিম তারা ও যাদের বিচার হবে তারাও ন্যায়বিচার পাবেন।

নয়া দিগন্ত : রাষ্ট্রের কোন কোন কাঠামো আয়নাঘরের সাথে জড়িত ছিল বলে আইনজীবী হিসেবে আপনি মনে করেন?

ব্যারিস্টার আরমান : দীর্ঘ আট বছরের বন্দী জীবনে ভিকটিম হিসেবে আমি তাদের কাছে বারবার জিজ্ঞেস করেছি, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ কী? হয়তো আমি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবো। তারা একটা কথাই বারবার বলত, আদেশ। একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে বেশ কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ডাক্তারসহ এসেছিল। একেবারে মৃত্যুর কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। তখন তারা বলত, আপনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত ও নির্দেশ একেবারে সর্বোচ্চ জায়গা থেকে আসতেছে এবং আসবে। এটা আমি গুম কমিশনকে বলেছি। জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদনে বিষয়টি দালিলিকভাবে প্রমাণ হয়েছে যে, সব কার্যক্রম সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আসত। প্রথমত, একেবারে সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে খুবই উচ্চপদস্থ বেশ কিছু কর্মকর্তা এই নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের সাথে জড়িত। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সবচেয়ে বেশি অপব্যবহার করা হয়েছে। তার মধ্যে আমরা র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন র‌্যাব, ডিজিএফআইর নাম আমরা দেখছি সব জায়গায়। আশা করছি, গুম কমিশনের রিপোর্টে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হবে কারা এ ধরনের গুমের সাথে জড়িত। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার সংস্থা যে প্রতিবেদন করেছে এটাও একটা অকাট্য প্রমাণ যে কারা কিভাবে জড়িত ছিল। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি ও কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কোঅর্ডিনেটের দায়িত্বে ছিল। আর কিছু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ব্যবহার করা হয়েছে এই মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য।

নয়া দিগন্ত : এখন জানা গেছে একাধিক আয়নাঘর রয়েছে। আপনি কী মনে করেন?

ব্যারিস্টার আরমান : আমাকে দুটোতে নেয়া হয়েছে। প্রথম আয়নাঘরে আমি ১৬ দিন ছিলাম। প্রথম যেটি, সেটি খুবই স্যাঁতসেঁতে, দুর্গন্ধময়। আমার মনে আছে, মেঝের ভেতর দিয়ে ইঁদুর, কেঁচো ও তেলাপোকা হাঁটত। ওখানে আমি বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম। সেটা মুরগির খোপের চেয়েও ছোট মনে হতো আমার কাছে। একটা মানুষ কোনো মতে ঢুকতে পারবে, কফিনের মতো একটা জায়গা। বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমাকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে আমি বাকি আট বছর ছিলাম। এখন আমার প্রদত্ত তথ্য ও অন্যান্য যারা ভিকটিম তাদের সম্মিলিত তথ্য পরীক্ষা করে গুম কমিশন দেখেছে আমাকে র‌্যাবের সদর দফতরে অবস্থিত র‌্যাব গোয়েন্দা বিভাগের টিএফআই সেলে রাখা হয়েছিল। এ ধরনের সেল ঢাকা ও ঢাকার বাইরে আরো আছে। গুটিকয়েক মাত্র শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। আরো আছে যেগুলো সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। গুম কমিশন চেষ্টা করছে শনাক্ত করার। তবে সবচেয়ে বড় আয়নাঘর হচ্ছে ঢাকা ক্যান্টমেন্টের কচুক্ষেতে ডিজিএফআইয়ের পরিচালনায় যেটিকে জিএসআই বলা হয়। দ্বিতীয় বৃহত্তম হচ্ছে টিএফআই সেল; যেটিতে আমি ছিলাম। তৃতীয় বৃহত্তম হচ্ছে ঢাকায় গোয়েন্দা বিভাগ পরিচালিত যেটি সিটিসি বলা হয়। গুম কমিশনের তদন্তে হয়তো আরো বেরিয়ে আসবে। তারা সারা দেশে গুম ও এ ধরনের আয়নাঘর প্রাথমিকভাবে করেছিল হাইপ্রোফাইল লোকজনদের ধরার জন্য। এরপর এমন পর্যায়ে নিয়ে যায় যে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে লোকজন ঘুমুচ্ছিল তাদের জন্য। বিস্তৃতভাবে এসব আয়নাঘর করা হয়েছে যেটিকে আমরা আইনের ভাষায় বলি, ‘সিস্টেমেটিক অ্যান্ড ওয়াইড স্প্রেড’। টারগেটিং অব এ পলিটিক্যাল গ্রুপ, যেটা হচ্ছিল। আন্তর্জাতিক আইনে এটাকেই বলা হয় মানবতাবিরাধী অপরাধ। সেটা এখানে সুনির্দিষ্টভাবে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর হচ্ছিল।

নয়া দিগন্ত : আপনার সাথে আয়নাঘরে কারো দেখা হয়েছিল কি? কাউকে চিনতে পেরেছিলেন কি?

ব্যারিস্টার আরমান : দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমি যাতে আয়নাঘর চিনতে না পারি, আমাকে এমনভাবে রাখা হয়েছিল যেখানে আমাকে অ্যাটাচড টয়লেট দেয়া হয়েছিল, যাতে আর কোনো ব্যক্তির সাথে দেখা বা কথা বলার সুযোগ না হয়। গুম কমিশনের মাধ্যমে জেনেছি আর কোনো বন্দীর সাথে এটা করা হয়নি। ওরা অ্যাডজাস্ট ফ্যান চালাত যাতে এর শব্দে অন্যান্য শব্দ ঢাকা পড়ে যায়। শীতকালে আমাদের কোনো কষ্ট হওয়া ওদের বিবেচনায় ছিল না। যারা ওখানে প্রহরী ছিল তাদের কষ্ট হতো ঠাণ্ডায়। তখন শীতকালে ওই ফ্যানগুলো বন্ধ রাখতে বাধ্য হতো। তখন আমরা কিছু আওয়াজ শুনতাম। ট্রেনের আওয়াজ শুনতাম, গাড়ির আওয়াজ শুনতাম, প্লেনের আওয়াজ শুনতাম। কান্নার আওয়াজ শুনতাম। সবমিলিয়ে আমরা বুঝতে পারতাম ওখানে অনেক বন্দী আছে। আমি বুঝতে পারতাম নির্যাতন চলছে, টর্চার চলছে। বুঝতে পারতাম বিভিন্ন সময় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা পরিদর্শনে এসেছেন। যখন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা আসত তখন চোখ ও হাত বেঁধে দেয়ালের দিকে মুখ করে সারাদিন ওভাবেই বসিয়ে রাখত। নড়াচড়া করতে দিত না, টয়লেট, গোসল করতে দিত না। খালি বলত বড় স্যার আসবেন। আমি যেখানে ছিলাম সেখানে বাতাস চলাচল করার ব্যবস্থাও ছিল না। মানুষের দুর্গন্ধ পেশাব, পায়খানার দুর্গন্ধের মধ্যে ২৪ ঘণ্টা থাকতে হতো। হঠাৎ করে অনেক লোকের পায়ের আওয়াজ শুনতে পেতাম। দামি পারফিউমের সুগন্ধ পেতাম। মোবাইলের আওয়াজ শুনতাম। তখন বুঝতাম বেশ কিছু লোক পেছন থেকে আমাদের দেখছে।
(শেষাংশ আগামীকাল)