![Image description](https://content.bdtoday.net/files/img/202502/0e7b87be90bacc46ae47cb8992008962.png)
২০১০ সালে আওয়ামী লীগ শাসনামলে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হলে এর স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ও মানবাধিকার আইনে বিশেষজ্ঞ ব্রিটিশ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান। ট্রাইবুনাল নিয়ে বিতর্কের মুখে শেখ হাসিনার সরকার ২০১১ সালে তাকে বাংলাদেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়। এরপর থেকে দীর্ঘ সময় ট্রাইবুনালের ‘বিভিন্ন ত্রুটি ও নিরপেক্ষতা’ নিয়ে সরব ছিলেন তিনি।
বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ক্যাডম্যান এখন কাজ করছেন ট্রাইবুনালের আইনি পুনর্গঠনের প্রধান পরামর্শক হিসাবে। আওয়ামী লীগ আমলে বিচারবর্হিভূত হত্যা, নিরাপত্তাবাহিনী কর্তৃক জোরপূর্বক গুম, নিখোঁজ ও বিশেষভাবে জুলাই-আগস্ট হতাকাণ্ডের বিচার কার্যক্রমে পরামর্শ দিচ্ছেন।
ট্রাইবুনাল কর্তৃক গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর স্পর্শকাতর তথ্য ফাঁস হচ্ছে জানিয়ে বিচার প্রক্রিয়ায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে উদ্বেগ তুলে ধরেছেন টবি ক্যাডম্যান। এছাড়া আগের শাসনামলে গঠিত বিতর্কিত ট্রাইবুনালের কাঠামোগত সংস্কার, বিশেষভাবে ট্রাইবুনালের নাম পরিবর্তন চেয়েছেন তিনি।
এছাড়া কট্টর সমালোচক থেকে পরামর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া, গণঅভ্যুত্থানের মুখে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি করা থেকে শুরু করে; ভারত থেকে হাসিনাকে প্রত্যর্পণ ইস্যু, ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি, ট্রাইবুনাল নিয়ে আওয়ামী লীগের অভিযোগের জবাব এবং সর্বোচ্চ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী বিচার নিশ্চিত করা নিয়ে কথা বলেছেন যুগান্তরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবদুল মজিদ চৌধুরী।
যুগান্তর : আপনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) নিয়ে বরাবরই সমালোচক ছিলেন এবং ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানিয়ে এসেছিলেন, সে সময়কার প্রশাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে। এখন আইসিটির প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে ট্রাইবুনাল নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
টবি ক্যাডম্যান : প্রথমত, আমাকে কথা বলার সুযোগ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আমি আইসিটির বিরুদ্ধে নয়, বরং এর প্রক্রিয়ার সমালোচনা করেছি। ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের বিচার অনেক আগেই আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তা হয়নি, ফলে দীর্ঘ সময় বিচারহীনতার শূন্যতা সৃষ্টি হয়। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর আইসিটি গঠন করা হয় এবং বিরোধীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়। তবে, এই বিচার প্রক্রিয়া যথাযথ ছিল না এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এর বিরুদ্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল।
এখন আইসিটির আইন সংশোধন করা হয়েছে এবং আমি প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামের সঙ্গে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের সুপারিশ করেছি। এই সপ্তাহে আইনের উপদেষ্টা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করেছি এবং কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন রয়েছে। তবে, আইসিটির প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা আরও জোরদার করতে হবে। আমি একটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছি আইসিটির নাম পরিবর্তন করা উচিত, কারণ পুরনো নামটি মানুষের মনে আগের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের স্মৃতি ফিরিয়ে আনবে, যা পুরো প্রক্রিয়াকে কলুষিত করেছে। তাই, নাম পরিবর্তন না হলে, নতুন আইন এবং নেতৃত্বের পরিবর্তনেও আগের বিচার প্রক্রিয়ার ছায়া থেকে যাবে।
![](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2025/02/12/Sequence%2001-67acd1f647712.jpg)
যুগান্তর : আপনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে (আইসিটি) এ নিয়ে কী পরামর্শ দেবেন? এর নাম কী রাখা উচিত তাহলে?
টবি ক্যাডম্যান : এটি আমার সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয় নয়, এটি সরকারের সিদ্ধান্ত। আমি কিছু নামের সুপারিশ করেছি, তবে এটি কী নামে পরিচিত হবে সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ নয় মূল বিষয় হলো, এর নাম আগের মতো না রেখে ভিন্ন কিছু করা। এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ চেম্বার হতে পারে, বা আন্তর্জাতিক অপরাধের জন্য বিশেষ আদালত হতে পারে। মূলত, নতুন নামটি অতীত থেকে একটি স্পষ্ট বিচ্ছেদ বোঝাতে হবে। আমি বলেছি, এটি গণতন্ত্রের নতুন ভোর এবং আইনের শাসনের নতুন সূচনা। আমি বিশ্বাস করি, অন্তর্বর্তী সরকার, বিশেষ করে অধ্যাপক ইউনূস, আইন উপদেষ্টা, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং প্রধান প্রসিকিউটরসহ সংশ্লিষ্ট সবাই চান যেন এটি সঠিকভাবে পরিচালিত হয়।
ছাত্ররা যে কারণে আন্দোলন করেছে, তা ছিল গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য। তাই শুধু আইনি কাঠামো বদলালেই চলবে না, এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাতে হবে।
যুগান্তর : ২০১১ সালে তৎকালীন সরকারের নির্দেশে শাহজালাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ আপনাকে দেশে প্রবেশ করতে দেয়নি। প্রায় ১৪ বছর পর এখন আপনি সরকারের অংশ। এটি কি আপনার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট?
টবি ক্যাডম্যান: প্রথমত, আমি বলব, আমার ক্যারিয়ারের বিকাশে বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রয়েছে। বাংলাদেশে আসার আগে, আমি বসনিয়ায় যুদ্ধাপরাধের বিচারকার্য পরিচালনা করেছি। কিন্তু আমি মনে করি, আমি বাংলাদেশে যে কাজ করেছি, সেটি আমার জীবনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কাজগুলোর একটি। আমি প্রথমবার বাংলাদেশে এসেছিলাম ২০১০ সালের অক্টোবরে, এরপর আরও চারবার এসেছি। তবে ২০১১ সালের ৬ আগস্টের সেই ঘটনাটি আমি কখনো ভুলব না সেদিন ছিল আমার মেয়ের জš§দিনের আগের দিন। সেদিন, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে আমাকে দেশে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। আমাকে বিমানবন্দরে আটক করা হয়, পরে ফেরত পাঠানো হয়। তখন স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আমাকে আর বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না। যদিও তখন বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনা ছিল, তবে আমরা তখনো পুরোপুরি বুঝতে পারিনি এই বিচারের ওপর কতটা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ চলছে।
এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অন্তর্বর্তী সরকার এই ভুলের পুনরাবৃত্তি না করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে। আমি জানি, সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হলো একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা। তবে গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো সত্য, ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতা। তাই এটি কেবল আমার জন্য একটি ব্যতিক্রমী মুহূর্ত নয় বরং বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি নতুন সুযোগ। আমি এখানে শুধু একটি ক্ষুদ্র অংশ হিসাবে কাজ করছি, সরকারকে সঠিক পথে সহায়তা করছি। কিন্তু আসল পরিবর্তন আনতে হবে বাংলাদেশের জনগণকেই।
যুগান্তর : ৫ আগস্টের পর যখন নতুন করে ট্রাইবুনালের প্রক্রিয়া শুরু হয়, তখন প্রথম কে আপনাকে উপদেষ্টা হিসাবে প্রস্তাব জানিয়েছিল এবং তখন কী ধরনের আলোচনা হয়েছিল?
টবি ক্যাডম্যান : আমি খুব দ্রুতই আমন্ত্রণ পাই। আসলে আমি অনেকের সঙ্গে যোগাযোগে ছিলাম, যাদের সঙ্গে আগে থেকেই কাজ করেছিলাম। ব্রিটিশ আইনজীবী মাইকেল পোলাক এবং আমি দীর্ঘদিন ধরে মীর আহমাদ বিন সালমান (আহমাদ) এর মুক্তির জন্য লড়াই করছিলাম। তিনি ছিলেন নিখোঁজ ব্যক্তিদের একজন। শেখ হাসিনা সরকার সবসময় দাবি করেছিল, তারা আহমাদের নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নয়। অথচ শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার দুই দিনের মাথায় আহমাদ এবং ব্রিগেডিয়ার আজমী মুক্তি পান! এটি ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত ও বিস্ময়কর। আমি ব্যক্তিগতভাবে চেয়েছিলাম তাদের মুক্তি দেখতে, কারণ তারা প্রায় আট বছর ধরে অন্যায়ভাবে বন্দি ছিলেন, যা আমার কাছে ভয়ানক মনে হয়েছিল। তবে এই সুযোগে আমি অ্যাটর্নি জেনারেল, আইন উপদেষ্টা এবং অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত নিই।
অধ্যাপক ইউনূস আমাকে অনুরোধ করেন, আমি যেন আমার সুপারিশগুলো একটি প্রতিবেদন আকারে উপস্থাপন করি। এটি ছিল একটি গোপন প্রতিবেদন, যা আমি তাকে প্রদান করি। এরপর, আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয় আমি কি প্রধান প্রসিকিউটরের উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করতে আগ্রহী? আমি প্রধান প্রসিকিউটরের সঙ্গে আগেও কাজ করেছি, তাই আমি জানতাম তিনি একজন অত্যন্ত দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তি। তাই এটি আমার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ ছিল। আমি এটি বিনা পারিশ্রমিকে করতে সম্মত হই। পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, আমি এই ভ‚মিকার জন্য কোনো পারিশ্রমিক পাই না। তবে সরকারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে একটি সমঝোতা হয়েছে যে, ভবিষ্যতে যদি আমার কাজের জন্য কোনো তহবিল বরাদ্দ করা হয়, তবে তা অবশ্যই সরকারের অনুমোদিত হবে এবং কোনো রাজনৈতিক পক্ষ থেকে আসবে না। তবে আমার কাছে এটি কেবল একটি চাকরি নয় এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, যা আমি ন্যায়বিচারের স্বার্থে গ্রহণ করেছি।
যুগান্তর : আপনি সরকারকে নিজেই জানিয়েছিলেন, আপনি এটি করতে ইচ্ছুক, তাই তো?
টবি ক্যাডম্যান : আসলে, আলোচনা শুরু হয়েছিল আমার সুপারিশমূলক প্রতিবেদনের মাধ্যমে। আমি যে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ মনে করতাম, তার সুপারিশ দিয়েছিলাম; কিন্তু এটি কোনোভাবেই নিজের জন্য একটি চাকরি তৈরির উদ্দেশ্যে ছিল না। আমার মূল বক্তব্য ছিল : আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) কাঠামোগত সংস্কার কীভাবে করা উচিত। এবং যেসব বিশাল সম্পদ এবং টাকা বাংলাদেশ থেকে লুটপাট হয়ে বিদেশে পাচার হয়েছে, সেগুলো কীভাবে পুনরুদ্ধার করা যায়।
এই আলোচনার সময় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সরকার এ কাজে বিশেষজ্ঞ পরামর্শক নিয়োগ করতে আগ্রহী। আমি তখন প্রধান প্রসিকিউটরের সঙ্গে দেখা করি, যিনি তখন সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত। আমার প্রথম দফার আলোচনার সময় সরকার তখনো কোনো প্রধান প্রসিকিউটর নিয়োগ দেয়নি। তবে, দ্বিতীয়বার বাংলাদেশে এলে (সম্ভবত নভেম্বরের শেষ বা ডিসেম্বরের শুরুতে), তখন আলোচনা শুরু হয় আমি উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করব কিনা। পরবর্তী সময়ে আইন উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা শেষে আমাকে বিশেষ উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
![](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2025/02/12/Sequence%2001-67acd2c13c158.jpg)
যুগান্তর : অতীতে ট্রাইবুনালের কার্যক্রম নিয়ে আপনি বলেছিলেন, শেখ হাসিনার অধীনে বিচারব্যবস্থা রাজনৈতিক ফায়দার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছিল এবং বাংলাদেশের এই অভিজ্ঞতাটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এখন আপনি এই ট্রাইব্যুনালের পরামর্শদাতা। আপনি কি কোনো সংস্কারের জরুরি প্রয়োজনীয়তা দেখছেন?
টবি ক্যাডম্যান : বিচারব্যবস্থা একটি রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, এবং যখন আইনের শাসন উপেক্ষিত হয়, তখন এটি প্রথমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশে অপরাধ ও বিচার ব্যবস্থায় এখন অবশ্যই ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন। এই সংস্কার শুধু আইসিটি সম্পর্কিত নয়, বরং আরও বিস্তৃত এবং গভীর সংস্কার প্রয়োজন। আইসিটি ঠিক করলে এটি বিচারব্যবস্থার সংস্কারের সূচনা হতে পারে। বাংলাদেশে অনেক দক্ষ আইনজীবী ও বিচারক আছেন, যারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ছাড়াই তাদের কাজ করতে সক্ষম। তবে তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। আগে বিচারকদের স্বাধীনতা ছিল কম, কারণ এখানে ভয়ের ও চাপের সংস্কৃতি ছিল। তারা তখন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারতেন না। এখন সময় এসেছে এই সংস্কারের দিকে নজর দেওয়ার, এবং আমি মনে করি এটি একটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান লক্ষ্য হতে পারে। তবে শেষ পর্যন্ত এটি এমন কিছু যা পরবর্তী অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকেই নিতে হবে। তাদের বুঝতে হবে এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া, এবং বাংলাদেশ শুধু তখনই একটি দেশ হিসাবে উন্নতি করতে পারবে, যদি তারা এ সংস্কারগুলোকে গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করে।
যুগান্তর : আইসিটি থেকে হাসিনার গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে এবং সরকারের পক্ষ থেকে ইন্টারপোলে সব প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণও পাঠানো হয়েছে। তবে আমরা দেখছি, ইন্টারপোল এখনো নোটিশ জারি করেনি, আপনি কতটা আত্মবিশ্বাসী ইন্টারপোল শেষমেশ রেড নোটিশ জারি করবে?
টবি ক্যাডম্যান : ইন্টারপোল একটি স্বাধীন আন্তর্জাতিক পুলিশ নেটওয়ার্ক, এবং তাদের কাজ আইনগত বিধির আওতায়। যে অভিযোগগুলো করা হচ্ছে, সেগুলো অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য ও প্রমাণভিত্তিক হতে হবে, এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তা করা যাবে না। আমি আত্মবিশ্বাসী যে ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করবে, তবে প্রত্যর্পণ একটি আলাদা বিষয়, যা নিজস্ব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে। রেড নোটিশ গ্রেফতারের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে, কিন্তু নোটিশ জারি না হলেও তা প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করবে না। যদি হাসিনা কোনো দেশে চলে যান, সেখানে রেড নোটিশ থাকলে তাকে গ্রেফতার করা হবে এবং বাংলাদেশ তার প্রত্যর্পণ আবেদন করবে। ভারতের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যদি প্রত্যর্পণের ব্যাপারে তারা রাজনৈতিকভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়। ভারত যদি হাসিনাকে রক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়, তাদের সিদ্ধান্তের ফলে বিচার প্রক্রিয়া থেমে যাবে না। আইসিসি এবং আইসিটি আইনের মাধ্যমে বিচার হতে পারে, এমনকি হাসিনা যদি উপস্থিত নাও থাকেন। ভারত যদি প্রত্যর্পণ প্রত্যাখ্যান করে, বিচার কার্যক্রমের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না।
যুগান্তর : ‘শেখ হাসিনা বাংলাদেশে আসবেন বিচারের মুখোমুখি হওয়ার জন্য, ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলার জন্য’, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের এই বক্তব্য দিয়েছেন, আপনি কি মনে করেন এ ধরনের মন্তব্য আইন পরিপন্থি?
টবি ক্যাডম্যান : আমি অন্যদের মন্তব্য নিয়ে কিছু বলতে পারি না। তবে যদি শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণ করা হয়, তাহলে সরকারকে অবশ্যই সুষ্ঠু ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। কোনো ব্যক্তির শাস্তি কী হবে, তা একমাত্র স্বাধীন আদালতই নির্ধারণ করবেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে। এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করতে পারে এবং ইউরোপীয় কোনো দেশে তিনি আটক হলে, মৃত্যুদণ্ড থাকলে প্রত্যর্পণও কঠিন হবে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আদালতের, আমার নয়।
যুগান্তর : প্রধান প্রসিকিউটর বলেছেন, শেখ হাসিনা বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবেন, যাতে বিচার প্রক্রিয়ায় নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয় এবং এতে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য না থাকে। বিচারিক প্রক্রিয়াকে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্য আপনি আর কী কী পদক্ষেপ বিবেচনা করছেন?
টবি ক্যাডম্যান : উভয় পক্ষে বিদেশি আইনজীবীদের উপস্থিতি বিচার প্রক্রিয়াকে ন্যায্য করার জন্য আবশ্যক নয়। কারণ যদি এটি আবশ্যক হতো, তবে প্রতিটি দেশেই এমন একটি বিধান থাকতো, যার মাধ্যমে বিদেশি আইনজীবীরা উপস্থিত হতে পারতেন। তবে এটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা, যা শেখ হাসিনার অধিকার হবে, তিনি তার পছন্দমতো যে কোনো আইনজীবী নির্বাচন করতে পারবেন। তাই এটি গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া আইসিটি আইনে কিছু সংশোধনের প্রয়োজন, যেমন বিচারকের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ (ইন্টারলোকুটরি আপিল) এবং প্রমাণের যথাযথ নিয়ম। বিচারকদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের আশঙ্কা না থাকে। এটি আইন ও বিচারিক প্রক্রিয়ায় পরিষ্কারভাবে উলেখ করা প্রয়োজন।
![](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2025/02/12/Sequence%2001-67acd3e0bc052.jpg)
যুগান্তর : আপনি কি জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সহযোগিতা বা পরামর্শ চাইবেন, বিশেষ করে যারা হাসিনার শাসনামলে ট্রাইব্যুনাল নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন?
টবি ক্যাডম্যান : প্রক্রিয়াটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্বারা সঠিকভাবে সমর্থিত হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘের একটি নির্দিষ্ট ভূমিকা ও ম্যান্ডেট রয়েছে। আমরা জানি, জাতিসংঘের হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস অফিস এখানে এসেছিল, তারা জুলাই মাসের হামলার ওপর তাদের নিজস্ব তদন্ত পরিচালনা করেছে এবং আশা করছি তারা ১২ ফেব্রুয়ারি তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। অবশ্যই তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করবে তারা সরকারের কাছে কী প্রত্যাশা করছেন এবং কার্যকরভাবে জাতিসংঘের ভূমিকা কী হবে। তাই আমি মনে করি জাতিসংঘের সম্পৃক্ততা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং অবশ্যই, ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি কার্যকরী মেকানিজম রয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তা প্রদান করার জন্য। আমি জানি, আমি যেমন যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সঙ্গে আলোচনা করেছি, তারা চায় এই প্রক্রিয়াটি সঠিকভাবে সম্পন্ন হোক। এই সম্পৃক্ততা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় পরিচালনা করতে হবে, যাতে এটি স্বচ্ছ হয় এবং মৌলিক মানদণ্ড পূরণ করে। তাই, প্রধান প্রসিকিউটরের সঙ্গে এটি কার্যকরভাবে আমার দায়িত্বের একটি অংশ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জানান দেওয়া, এই প্রক্রিয়া সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী করা হচ্ছে।
যুগান্তর : পুলিশের সহায়তা বিচার প্রক্রিয়ার অগ্রগতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রসিকিউশন দল ইতোমধ্যে গ্রেফতার হওয়া অভিযুক্তদের আটক করতে ব্যর্থতার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। হাসিনার শাসনামলের অনেক পুলিশ কর্মকর্তা এবং নিরাপত্তা কর্মকর্তা বর্তমান ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। আপনি কি পুলিশ বিভাগ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বিভাগের কাছ থেকে পূর্ণ সহযোগিতা পাচ্ছেন?
টবি ক্যাডম্যান : আমি জানি, প্রসিকিউশন কিছু উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। অবশ্যই সম্প্রতি যে পরোয়ানাগুলো জারি করা হয়েছে, আমি গর্বিত সেই প্রসিকিউশন দলের অংশ ছিলাম এবং ট্রাইব্যুনালের সামনে হাজির হয়েছিলাম। এটি ছিল আমার প্রথম ট্রাইব্যুনালের সামনে উপস্থিতি। জারি করা পরোয়ানাগুলোর প্রক্রিয়া বেশ গোপন ছিল, যাতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফাঁস না হয়। কিন্তু কিছু তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। এ কারণে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। তথ্য ফাঁসের কারণে অভিযুক্ত কয়েকজন এখান থেকে পালিয়ে যেতে বা আত্মগোপন করতে সক্ষম হয়েছে। এটি একটি সমস্যা, যা সমাধান করা প্রয়োজন।
যুগান্তর : আপনি কি মনে করেন আইসিটি, সরকার বা আইন উপদেষ্টার মধ্যে কোনো ফাঁক রয়েছে, যা বর্তমানে পলাতক অভিযুক্তদের গ্রেফতার করতে বাধা সৃষ্টি করছে?
টবি ক্যাডম্যান : দেখুন, প্রথমত, অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা প্রধান প্রসিকিউটরের অফিসের দায়িত্ব নয়। সুতরাং আইসিটি প্রসিকিউশনের দায়িত্ব হলো ট্রাইব্যুনালে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির জন্য অনুরোধ পেশ করা। তারপর সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব এই গ্রেফতারগুলো কার্যকর করা। এখন, যদি এতে কোনো সমস্যা থাকে, তবে সেই সমস্যা সমাধান করতে হবে। এটি একটি খুব সোজা প্রক্রিয়া। আইসিটি পরোয়ানা জারি করবে আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তা কার্যকর করতে হবে। যদি কোনো তথ্য থাকে ওই পরোয়ানাগুলো কার্যকর হচ্ছে না, বা যদি কোনো প্রমাণ থাকে কিছু শনাক্তকৃত পুলিশ কর্মকর্তা এই তথ্য ফাঁস করছেন, তবে তা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। যারা এই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন, তাদের তদন্তের আওতায় আনা উচিত। যদি প্রমাণ থাকে, তবে তাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনতে হবে। আমি মনে করি, ভবিষ্যতে ফাঁসের ঘটনা রোধের একমাত্র উপায় হলো একটি শক্ত অবস্থান নেওয়া যে, যদি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়, তবে তাদের পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে। অন্তত তাদের তদন্তের স্বার্থে বরখাস্ত করা উচিত। যদি প্রমাণ পাওয়া যায় তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তথ্য ফাঁস করেছেন, তবে তাদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।
যুগান্তর : আপনি কি মনে করেন এ নিয়ে সরকারের কোনো ব্যর্থতা রয়েছে?
টবি ক্যাডম্যান : না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যা করছে বা যা করছে না, তার জন্য আপনি সরকারকে দোষী করতে পারেন না। অবশ্যই, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব রয়েছে এটি নিশ্চিত করা যে, এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে এবং এ ধরনের বিষয়গুলো সঠিকভাবে তদন্ত করা হয়। তবে আবার, কিছু পুলিশ কর্মকর্তার কার্যক্রমের জন্য সরকারকে দোষারোপ করা, আমি বলব, এটি অত্যন্ত কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ।
যুগান্তর : ভুক্তভোগীরা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে তদন্তের প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি দেখতে চান। তাছাড়া, বিশ্বের মানুষ বাংলাদেশের অগ্রগতির দিকে লক্ষ রাখছে, বিশেষ করে ছাত্রদের নেতৃত্বে হওয়া জুলাই-আগস্টের উত্থান পরবর্তী পরিস্থিতি কী হতে যাচ্ছে, সেদিকে সবার দৃষ্টি আছে। এ নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
টবি ক্যাডম্যান : এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যখন ভুক্তভোগী পরিবার ও নাগরিক সমাজ প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। আমরা বিভিন্ন দেশে দেখেছি, ভুক্তভোগীরা প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি আনতে পারে। নাগরিক সমাজের সঠিকভাবে সম্পৃক্ত হওয়া প্রয়োজন, যাতে তারা প্রক্রিয়ার বৈধতা বা অবৈধতা নির্ধারণের অংশ হিসাবে কাজ করতে পারে। তবে, নাগরিক সমাজের ভূমিকা যত গুরুত্বপূর্ণ, তাদের সম্পৃক্ততা এমনভাবে হতে হবে যাতে এটি কোনো পক্ষের নিয়ন্ত্রণে না থাকে। প্রধান প্রসিকিউটর এবং তার দলকে অবশ্যই স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ আনা হবে, এবং তা প্রমাণের ভিত্তিতে। প্রসিকিউশনের সঙ্গে নাগরিক সমাজের সম্পর্ক থাকা গুরুত্বপূর্ণ, তবে দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত প্রসিকিউটরেরই।
যুগান্তর : হাসিনার প্রত্যর্পণ বা যারা বর্তমানে বিচারাধীন, তাদের নিয়ে সরকারের আইন উপদেষ্টা বা অন্যদের সঙ্গে আপনার কি কোনো যোগাযোগ হয়েছে?
টবি ক্যাডম্যান : আমি প্রধান প্রসিকিউটরের উপদেষ্টা হিসাবে আইন উপদেষ্টার সঙ্গে নিযুক্ত হয়েছি। ড. আসিফ নজরুল আমাকে প্রধান প্রসিকিউটরের উপদেষ্টা হিসাবে কার্যকরভাবে নিয়োগ দিয়েছেন। আমার দায়িত্ব হচ্ছে প্রতিদিনের তদন্তের বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করা, শুধু শেখ হাসিনার মামলায় নয়, এমন অন্যান্য মামলার ক্ষেত্রেও যেখানে অভিযুক্তদের বিচার প্রক্রিয়ায় আনা। অভিযুক্তদের প্রত্যর্পণ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধিকারভুক্ত একটি বিষয়, এবং এটি তাদের দায়িত্ব। তবে, আইন মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে অভিযুক্তদের প্রত্যর্পণ অনুরোধগুলো কার্যকর করার বিষয়ে একটি সহযোগিতা রয়েছে। তবে, আপনাদের বুঝতে হবে যে অভিযুক্তদের প্রত্যর্পণটি আংশিক আইনি এবং আংশিক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রক্রিয়া।
যুগান্তর : আওয়ামী লীগ দাবি করেছে, ‘যুদ্ধাপরাধীদের’ প্রধান আইনজীবীকে ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আপনি আগে বিএনপি এবং জামায়াত নেতাদের পক্ষ থেকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আইনি সহায়তা প্রদানকারী হিসাবে যুক্ত ছিলেন। আপনি এ বিষয়টি কীভাবে দেখছেন এবং আপনি কি মনে করেন বিচারে এর প্রভাব পড়বে? আওয়ামী লীগের অভিযোগ নিয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
টবি ক্যাডম্যান : দেখুন, এটি অপ্রত্যাশিত অভিযোগ নয়। আমরা জানি অনেক প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। আমাকে বলতে হবে, এটি অপপ্রচার। একজন আইনজীবী হিসাবে আমি মাঝে মাঝে প্রসিকিউট করি, মাঝে মাঝে ডিফেন্ড করি, এবং আমি বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কাজ করি। বাস্তবতা হলো, আমি আগে এই আদালতে একজন ডিফেন্স আইনজীবী হিসাবে কাজ করেছি এবং এখন সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়গুলোর জন্য প্রসিকিউটর হিসাবে কাজ করছি, কারণ একটি বিষয় বুঝতে হবে, এখনকার চলমান তদন্তগুলো পুরোপুরি আলাদা, আগের মামলাগুলোর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। এই ট্রাইবুনালের প্রথম কার্যক্রম ছিল ১৯৭১ সালে কী ঘটেছিল সে সম্পর্কে, এবং আমি তখন ডিফেন্স আইনজীবী ছিলাম। আমি তখন সমালোচনাও করেছি, কারণ সেখানে প্রক্রিয়ার ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছিল। এখন (২০২৫ সালে) আমি যে মামলাগুলোর জন্য প্রসিকিউশনকে পরামর্শ দিচ্ছি, সেগুলো সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। ইংল্যান্ড এবং ওয়েলস বারের একজন সদস্য হিসাবে আমাকে কিছু নির্দিষ্ট মান বজায় রাখতে হয়, যেমন স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, নিরপেক্ষতা বজায় রেখে আমার দায়িত্ব পালন করা, বস্তুনিষ্ঠ পরামর্শ প্রদান করা এবং কোনো স্বার্থ না থাকা। আগের ঘটনা এবং বর্তমান ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। আমি মনে করি না এখানে কোনো সমস্যা আছে। তবে আমি জানি আমার নিয়োগ এবং অন্যদের নিয়োগ নিয়ে সমালোচনা থাকবে। এটি প্রত্যাশিত।
![](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2025/02/12/5878bd395aca86c597320f20a35c01777219d592b73a76b9-67acd2f94b078.jpg)
যুগান্তর : সরকারের পক্ষ থেকে আগামী এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন নিয়ে আলোচনা চলছে। কিছু দল আগে নির্বাচন চায়, আবার কেউ আগে জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করছে। আপনি বা ট্রাইব্যুনালের এ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা আছে?
টবি ক্যাডম্যান : নির্বাচন কবে হবে, তা অন্তর্বর্তী সরকারের ও জনগণের সিদ্ধান্ত। নির্বাচন তখনই হওয়া উচিত, যখন নিরাপদ ও সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা যাবে। তবে যারা গত বছরের জুলাই-আগস্টে হামলা চালিয়েছিল, তাদের অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত। বিচার দ্রুত শেষ করার ব্যাপারে জনগণের আগ্রহ স্বাভাবিক, কিন্তু এ ধরনের প্রক্রিয়াগুলোতে তাড়াহুড়ো করা সম্ভব নয়। এসব বিচার সময়সাপেক্ষ এবং অভিযুক্তদের ন্যায়বিচারের অধিকার নিশ্চিত করেই করতে হবে। এটি শুধু গত বছরের ঘটনার বিচার নয়; গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্বিচার গ্রেফতার ও নির্যাতনের মতো বহু ইস্যু তদন্তের প্রয়োজন। তাই ছয় মাসে এ কাজ শেষ করা সম্ভব নয়। এ বিচার প্রতিশোধমূলক নয়, এটি ন্যায়বিচার নিশ্চিতের প্রক্রিয়া, এবং আমরা সেটাই করতে চাই।
যুগান্তর : আপনার কাজ বা কোনো ধরনের কার্যক্রমে কি কোনো প্রতিবন্ধকতা বা বাধা তৈরি হচ্ছে? আপনি কি কোনো প্রতিবন্ধকতা অনুভব করছেন?
টবি ক্যাডম্যান : আমি বলব, এখানে আমার দৈনন্দিন কাজের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ট্রাফিক। ঢাকা শহরের বর্তমান বিশৃঙ্খল ট্রাফিক পরিস্থিতির কারণে এক সভা থেকে আরেক সভায় যাওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। এর বাইরে আমি কোনো প্রতিবন্ধকতা অনুভব করছি না। আমি যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছি তা হলো এখানে খুবই উষ্ণ অভ্যর্থনা, প্রসিকিউশন, আইন মন্ত্রণালয়, অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস এবং অন্তর্বর্তী সরকারের যেসব সদস্যের সঙ্গে আমি সাক্ষাৎ করেছি, তাদের কাছ থেকে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছি।
যুগান্তর : আপনি জানেন, ইতিহাস প্রায়ই ফিরে আসে, এমনকি শতাব্দী পার হলেও। রাজনৈতিক প্রভাব পরিহার করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে, আপনি কি মনে করেন এটা বাংলাদেশের জন্য বিশ্বের কাছে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপনের সুযোগ রয়েছে?
টবি ক্যাডম্যান : হ্যাঁ, আমি মনে করি এটা বাংলাদেশের জন্য একটি বিরাট সুযোগ। আমি বলব, এটা সম্ভবত প্রথম সত্যিকারের ছাত্র বিপ্লবগুলোর মধ্যে একটি। সব রাজনৈতিক দলই বাংলাদেশে বিভাজন এবং ইতিহাসকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছে। এটা এখন শেষ হতে হবে। আমি বসনিয়া-হের্জেগোভিনায় বেশ কিছু বছর কাটিয়েছি, দেশটিতেও সমানভাবে বিভক্ত জাতি, দেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে এখনো বিভাজনের মধ্যে বেঁচে আছে এবং সেখানকার মানুষও অতীতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমি প্রফেসর ইউনুসকে প্রথম সুপারিশে বলেছিলাম, সরকার পরিবর্তন হলে বর্তমান ও ভবিষ্যতের ইতিবাচক পরিবর্তন ব্যাহত হতে পারে, তাই বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে। এখন আপনাকে যা করতে হবে তা হলো, এমন বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠান তৈরি করা, যা জনগণের বিশ্বাস অর্জন করবে এবং যতটুকু সম্ভব দুর্নীতি দূর করা, যা ভবিষ্যতের কোনো সরকারকে ভালো কাজগুলোর ওপর হস্তক্ষেপে বাধা দেবে। এখন এটা নিঃসন্দেহে সবচেয়ে কঠিন কাজ।
যুগান্তর : আপনি বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠানের কথা বলছেন, তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, পুলিশ বিভাগের কার্যক্রম এবং তাদের কর্মকাণ্ডে জনগণের মধ্যে এখনো উদ্বেগ রয়েছে। এই উদ্বেগ কীভাবে দূর করা যায়?
টবি ক্যাডম্যান : পরিবর্তন রাতারাতি সম্ভব নয়, এবং বাংলাদেশ একা নয় বিশ্বের অনেক দেশই এমন সংকট মোকাবিলা করেছে, যেমন কলম্বিয়া, রুয়ানডা, বসনিয়া। তারা অতীতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে ভবিষ্যৎ গড়তে পেরেছে। তবে এর জন্য জনগণের প্রতিশ্রুতি জরুরি। এখনো আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও সেনাবাহিনীতে কিছু গোষ্ঠী থাকতে পারে, যারা পূর্ববর্তী সরকারকে সমর্থন করে। তবে মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা, নিরপেক্ষ বিচার নিশ্চিত করা কোনো নির্দিষ্ট দলকে নয়, বরং আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত বা যে কেউ অপরাধ করলে তাকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। যদি এই প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়, তবে সংস্কার টিকবে না, শুধু সরকার বদলাবে।
যুগান্তর : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
টবি ক্যাডম্যান : আপনাকেও ধন্যবাদ।