Image description

অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস পূর্তি উপলক্ষে বর্তমান সরকারের অর্জন ও চ্যালেঞ্জ, সামনের দিনের পরিকল্পনা ও স্বাধীন সাংবাদিকতার নানা বিষয়ে কালের কণ্ঠের সঙ্গে একান্ত আলাপ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মোহাম্মদ শফিকুল আলম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কালের কণ্ঠের সাইদ শাহীন

প্রশ্ন : সরকারের ছয় মাস পূর্তি কিভাবে মূল্যায়ন করছেন?

উত্তর : গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশে সবার আগে প্রয়োজন ছিল শান্তি ও স্থিতিশীল পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনা। দেশকে যদি একটি দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় পতিত উড়োজাহাজের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে আমরা বলতে পারি, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দেশকে সফট ল্যান্ডিং করিয়েছেন। দেশে স্থিতিশীলতা ও শান্তি ফেরাতে বর্তমান সরকার শতভাগ সফল।

 
দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক উন্নত হয়েছে। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাবেন, দেশে পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম খুন-গুম হয়েছে। তবে ছিনতাই কিছুটা বেড়েছে। সেটি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ কাজ করছে।
 
অন্যদিকে জনজীবনে মূল্যস্ফীতি নিয়ে উদ্বেগ অনেকটাই কমেছে। গত মাসেও মূল্যস্ফীতি ১ শতাংশ কমেছে। আগামী জুন-জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি স্বাভাবিক হতে পারে। রোজার মাসে ধর্মপ্রাণ মানুষ স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল মূল্যে পণ্য কিনতে পারবে।
 
এই সময়ে দেশে প্রায় ১৮০টি আন্দোলন হয়েছে। সেগুলো মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে করতে পেরেছে। সার্বিক পরিস্থিতিতে আমরা হয়তো মানুষের যে বড় প্রত্যাশা রয়েছে, সেটি এই স্বল্প সময়ে পূরণ করতে পারিনি, তবে আমরা দেশের সার্বিক পরিস্থিতি আরো উন্নত করতে বদ্ধপরিকর।

 

প্রশ্ন : সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার কিভাবে প্রতিরোধ করছেন?

উত্তর : অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের বর্তমান অর্জনকে ভুলভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করছে ভারতীয় মিডিয়া। এ ছাড়া বর্তমান সরকারপ্রধানের নেতৃত্বকে ম্লান করতে স্বৈরাচারী পতিত সরকার অর্থায়ন করছে।

 
দেশ থেকে যারা বিলিয়ন ডলার পাচার করে নিয়ে গেছে, তারাই এই খাতে অর্থায়ন করছে। শুধু তা-ই নয়, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে জঙ্গি হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা হচ্ছে। তাঁর যে সুনাম ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, সেটি ধ্বংসের চেষ্টা হচ্ছে। আমরা এই ধরনের মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক কাজের বিরুদ্ধে কাজ করছি।

 

প্রশ্ন : গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনতে কী উদ্যোগ নিচ্ছেন?

উত্তর : আগে মানুষের কথা বলার সুযোগ ছিল না। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ছিল না। আমরা মানুষের কথা বলার সুযোগ ফিরিয়ে দিয়েছি। গণমাধ্যমগুলোকে বর্তমান সরকারকে প্রশংসা করে প্রতিবেদন বানাতে নিষেধ করেছেন সরকারপ্রধান। বরং আমাদের গঠনমূলকভাবে সমালোচনা করলে আমরা দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারব। আমাদের সুবিধা হলো এই সরকারের নামে কোনো ধরনের বদনাম নেই। গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় আমরা সব ধরনের কালাকানুন বাদ দিতে উদ্যোগ নিয়েছি।

প্রশ্ন : দেশের অর্থনীতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে কী করছেন?

উত্তর : স্বৈরাচারী সরকার দেশের অর্থনীতিকে একটি ভয়াবহ সংকটময় অবস্থানে রেখে গিয়েছিল। অর্থপাচারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে ভঙ্গুর অবস্থায় ফেলে রেখেছিল। অনেক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের অর্থ পরিশোধ করেনি পতিত সরকার। সেগুলো আমাদের পরিশোধ করতে হয়েছে। প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারের মধ্যে এরই মধ্যে চার বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমে ব্যাংকব্যবস্থায় টাকা রাখেনি। পুরো একটা ফোকলা অর্থনীতি আমরা পেয়েছি। সেখান থেকে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নামতে দিইনি। টানা পাঁচ মাস ধরে রপ্তানির ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি রয়েছে।

প্রশ্ন : জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডে জড়িত অপরাধীদের বিচার কার্যক্রমের অগ্রগতি কত দূর?

উত্তর : বর্তমান সরকারের বড় কাজ ছিল জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডে যারা জড়িত ছিল, তাদের বিচারের আওতায় আনা। আমরা সবাইকে বিচারের আওতায় আনতে পেরেছি। খুব দ্রুত তাদের ট্রায়াল শুরু হবে। এ বিচার সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে পরিচালিত হবে। আমরা আদালতকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিয়েছি। চলতি বছরের শেষের দিকে অনেক অপরাধীর বিচারের রায় প্রকাশ পেতে পারে।

গুম কমিশন এরই মধ্যে জানিয়েছে, বিগত সরকারের আমলে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ গুম হয়েছে। অনেককে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্বৈরাচারী সরকার ছাত্র-জনতার ওপর কিরূপ হত্যাযজ্ঞ, অত্যাচার ও জুলুম করেছিল, সে বিষয়ে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিংস কমিটি চলতি সপ্তাহে তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। সেই প্রতিবেদনে দেশের সাধারণ মানুষ জানতে পারবে তথাকথিত গুম জননী ও চোর জননী কিভাবে মানুষের ওপর অত্যাচার করেছে।

প্রশ্ন : দেশ থেকে পাচার হওয়া টাকা কিভাবে ফেরত আনবেন?

উত্তর : অর্থপাচার যতটা সহজ, সেই টাকা ফিরিয়ে আনা বেশ কঠিন। বিগত সরকারের অর্থপাচার এখন প্রমাণিত সত্য। গত সরকারের চুরিচামারির কারণে আমরা গরিব হয়েছি। প্রতিবছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার করে পাচার করা হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার করা হয়েছে। পুরো ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে আড়াই লাখ কোটি টাকা চুরি হয়েছে। যেসব দেশে টাকা পাচার করা হয়েছে, সেখান থেকে অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করছি। যে দেশেই গিয়ে থাকুক না কেন, সেই অর্থ ফেরত আনতে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। আমরা এরই মধ্যে ফার্ম নিয়োগ কার্যক্রম শুরু করেছি। পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে অ্যাঙ্গোলা যদি পারে, তবে আমরাও পারব।

প্রশ্ন : ঢালাওভাবে সচিবালয়ের প্রবেশ কার্ড বাতিল করা হয়েছে, কিভাবে সমাধানের উদ্যোগ নিচ্ছেন?

উত্তর : আগের অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড প্রদানের নিয়ম ও পদ্ধতি ভয়ংকর রকমের দুষ্টচক্র দ্বারা প্রভাবিত ছিল। এখানে কিছু ধারা ছিল, যা সাংবাদিকতার পরিপন্থী। এ ছাড়া কার্ড খুব স্বল্পমেয়াদি ছিল। এই কার্ড পেলে সরকারের গুণগান গাইতে হবে। সব কটি বিষয় সমাধানের জন্য সাংবাদিকদের সংগঠনের নেতৃবৃন্দ দিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটির সুপারিশ ও গাইডলাইনের আলোকে বাস্তবসম্মত উপায়ে কার্ড দেওয়া হবে। এই কার্ড সাংবাদিকবান্ধব হবে। প্রাথমিকভাবে এক বছরের পরিবর্তে সব সাংবাদিককে তিন বছরের জন্য কার্ড দেওয়া হবে। সবার জন্য স্থায়ী কার্ড করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

প্রশ্ন : রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য ধরে রাখতে আপনাদের কৌশল কী?

উত্তর : আমরা চাই সবার মধ্যে ঐক্য থাকুক। একটা বড় ঐক্য হবে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আমরা সবাই একই কাতারে অবস্থান করব। এই প্রশ্নে কোনো বিভেদ আমাদের মধ্যে থাকবে না। আবার আমাদের মিত্রদের সঙ্গে ঐক্য যেমন থাকবে, তেমনি বিতর্কও থাকবে। দুটি বিষয় একই সঙ্গে চলতে পারে। কেউ যেন আগের স্বৈরাচারের মতো না করে। আগের স্বৈরাচার যেমন মানুষের অধিকার হরণ করেছে। সেই রাজনীতি যেন ফিরে না আসে, সেটিই আমরা চাই। প্রতিটি রাজনৈতিক দল তাদের আদর্শ ও লক্ষ্য নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করবে। আমরা সেই স্বাধীনতায় বিশ্বাসী।