Image description

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আর জনবহুল মহাদেশ এশিয়া। আনুমানিক ৪০০ ছাপান্ন কোটি জনসংখ্যা নিয়ে এশিয়াতে বিশ্বের ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ বসবাস করেন। বিশ্ব জনসংখ্যার মত, এশিয়ার জনসংখ্যা প্রায় চার গুণ বেড়ে গেছে।

সবশেষ স্বাধীন রাষ্ট্র পূর্ব তিমুর সহ ৪৯ টি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র নিয়েই মহাদেশ গঠিত। এই মহাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল দক্ষিণ এশিয়া এ অঞ্চলে বাংলাদেশ, ভারত, চীন, পাকিস্তান আর মিয়ানমারের মতো দেশ রয়েছে। এবার আরও একটি নতুন দেশ পেতে যাচ্ছে এই দক্ষিণ এশিয়া। সেইসাথে নতুন প্রতিবেশী রাষ্ট্র পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এবার প্রশ্ন হচ্ছে এই অঞ্চলে নতুন দেশ কোথায় হচ্ছে?তা হলে এই অঞ্চলের অবস্থানইবা কী হবে।

এশিয়া ও ইউরোপ একই ভূখণ্ডে অবস্থিত হওয়ায় একে ইউরেশিয়া বলা হয়ে থাকে। যদিও ইউরোপের সাথে এশিয়ার কোনও সীমারেখা নেই। সাংস্কৃতিকভাবে এশিয়া মহাদেশ বেশ বৈচিত্রপূর্ণ। এই মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ ভারতের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র অন্য যে কোনো একটি মহাদেশের চেয়ে বেশি। এছাড়া এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ভাষা, ধর্ম, বর্ণের বৈচিত্র্যতা, এশিয়া মহাদেশকে পুরো পৃথিবী থেকে আলাদা করে থাকে।

আর এই মহাদেশেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় উপসাগরের কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ।১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত চিরসবুজ এই দেশটি। ভাটির এই দেশটির সাথে ভারতের ৪,১৫৬ কিলোমিটার লম্বা আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে।

বাকি এক দিকে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সীমানা রয়েছে।অন্যদিকে বাংলাদেশের অন্যতম নিকটতম প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার যা আগে বার্মা নামেও পরিচিত ছিল। দেশটির আয়তনের বিচারে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম দেশ জনসংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি চল্লিশ লাখ।

মিয়ানমার প্রতিবেশী রাষ্ট্র হলেও বাংলাদেশিদের কাছে অনেকটা অচেনা একটি দেশ। প্রতিবেশী দুই দেশের জনগণের মধ্যে নেই কোনও সম্পর্কের আদান প্রদান ।সরকারি পর্যায়ে দেশটির সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও মিয়ানমার বরাবরই বাংলাদেশের জন্য সংকটই তৈরি করেছে। মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত ১৫ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা এখন বহন করছে বাংলাদেশ।

গেল কয়েক বছর ধরে দেশটির অভ্যন্তরীণ জাতিগত দাঙ্গা গৃহযুদ্ধ, যা বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকাকে অস্থির করে তুলেছে। আর এবার সীমান্তে যোগ হয়েছে নতুন ইস্যু আরাকান আর্মি ।

১৭৮৫ সাল পর্যন্ত আরাকান একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। এই সালে বার্মিজ মান্দালয়ে রাজ্যের হাতে স্বাধীন আরাকান এর পতন ঘটে। তবে পরবর্তী বছরগুলোতে বার্মিজ শাসকদের বিরুদ্ধে অসংখ্যবার বিদ্রোহ করে স্থানীয় বাসিন্দারা। ১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে যখন মিয়ানমারের স্বাধীনতা পায়। তখন কেন্দ্রীয় সরকারকে যারা চ্যালেঞ্জ করেছিল তার মধ্যে প্রথম দিকেই ছিল রাখাইন। সম্প্রতি জান্তাবাহিনীর বিরুদ্ধে আরাকান আর্মি যে বিষয়গুলো অর্জন করছে তাকে বিপ্লব হিসাবে দেখছে স্থানীয়রা।

আরাকান আর্মি কারা। কাচিন ইনডিপেনডেন্ট আর্মি কেআইএ সহায়তায় ইউনাইটেড লিগ অব আরাকানের সামরিক শাখা হিসেবে আরাকান আর্মি গঠিত হয় ২০০৯ সালে। তাদের লক্ষ্য একটি সার্বভৌম আরাকান রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা। আরাকান আর্মি কখন সামরিক তৎপরতা শুরু করে সেটি নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন।

তবে ধারণা করা হয়, ২০১৫ সাল থেকে তাদের সামরিক তৎপরতা শুরু হয়।মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে তারা গেল কয়েক বছর ধরে লড়াই চালিয়ে আসছে এবং এই সময়ে রাখাইন রাজ্য এবং পার্শ্ববর্তী চিন রাজ্যে নিজেদের অবস্থানকে সংহত করতে সমর্থ হচ্ছে।

সম্প্রতি মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীকে রীতিমত পরাজিত করে তারা রাখাইন অঞ্চল দখল করে নিচ্ছে। সবশেষ মংডু দখল করার মধ্য দিয়ে তারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে দিচ্ছে। সরকারি বাহিনীকে পরাজিত করে রাখাইনে ৮০ শতাংশের বেশি অঞ্চল দখল করে নিয়েছে রাজ্যটির সশস্ত্র বিদ্রোহী বাহিনী আরাকান আর্মি।

মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের আরও একটি টাউনশিপ বা শহর দখল করেছে দেশটির প্রভাবশালী জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। এটি দেশটির অন্যতম প্রধান শহর ইয়াঙ্গুন থেকে ১৮৫ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে এবং ইরাবতী নদীর বদ্বীপের একটি প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত।

গোয়া আরাকান আর্মির দখল করা রাখাইন রাজ্যের ১৪ তম শহর। রাজ্যে এমন মোট ১৭ টি টাউনশিপ বা শহর রয়েছে।মাত্র আর তিনটি শহর দখল করা বাকি থাকল। ফলে পুরো রাখাইন রাজ্য দখল করার লক্ষ্যে এটা তাদের অন্যতম বড় পদক্ষেপ নয়।আর এতেই নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার পথে আরও একধাপ এগিয়ে গেল রাখেন রাজ্য।

অর্থাৎ বাংলাদেশের পাশে নতুন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে৷ প্রতিষ্ঠার মাত্র দেড় দশকের কম সময়ের মধ্যে দেশটির সরকারি বাহিনীকে পরাজিত করে রাখাইন আর্মি তৈরি করতে যাচ্ছে নতুন দেশ।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যে কোনও সময় স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারে রাখাইন আর্মি। কক্সবাজার সীমান্তের ওপারে যে কোনও মুহূর্তে ঘোষণা আসতে পারে নতুন একটি রাষ্ট্রের।

দেশীয় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে, খুব শিগগিরই দক্ষিণ এশিয়ার নতুন দেশ আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। যা হচ্ছে রাখাইন রাজ্যকে ঘিরে।প্রতিবেশী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য ও আরাকান আর্মি কক্সবাজার সীমান্তের ওপারে যে কোনও মুহূর্তে হতে পারে নতুন একটি রাষ্ট্রের ঘোষণা।

জানা গেছে, রাখাইনকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে শুরু করেছে ভার, চীন, আমেরিকার মতো দেশগুলো। এতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যকে ঘিরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর এখন দক্ষিণ এশিয়ায় ।গত দেড় দশক আগে ২০০৯ সালের ৯ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয় এ এল ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান। ইউএলএ এর সামরিক শাখা আরাকান আর্মির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবিতে তারা তাদের কার্যক্রম শুরু করে।

রাখাইন নৃগোষ্ঠীর বৌদ্ধধর্মালম্বীদের এই সংগঠন নিজেদের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে সামনে রেখে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় এই গোষ্ঠীটি। আর প্রতিষ্ঠার মাত্র দেড় দশকের কম সময়ে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীকে পরাজিত করে রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তারা। তাই দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এখন নতুন সম্ভাবনার দানা বাঁধতে শুরু করেছে।

এদিকে ভৌগোলিকভাবে রাখাইনের অবস্থান ও সম্পদ চীন ও ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই রাখাইনকে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে এশিয়ার দুই পরাশক্তি ভারত ও চীন এরই মধ্যে তাদের জাল বিস্তার করে ফেলেছে৷ জানা গেছে, রাখাইনে আছে এই দুই দেশের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ।চীন রাখাইনে গড়ে তুলেছে গভীর সমুদ্র বন্দর।

বঙ্গোপসাগরে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবেলায় রাখাইনের এই বন্দর চীনের মহাস্ত্র। এ ছাড়া এই বন্দর থেকেই সরাসরি গ্যাস যায় চিনে।দেশটির বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বাস্তবায়ন এবং মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকায় তেল গ্যাস পাঠানোর বিকল্পও সহজ পথ ও এই অঞ্চলকে ঘিরে। এছাড়া মিয়ানমারের ইরাবতী নদীতে চীনের ১৩ হাজার মেগাওয়াটের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প রয়েছে।

অন্যদিকে ভারতের জন্য রাখাইন মহাগুরুত্বপূর্ণ। কালাদান মেগা প্রজেক্টের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বাইপাস করে সেভেন সিস্টার্স ও কলকাতার মধ্যে ভারতের যোগাযোগ সহজ করতে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে ভারত। এছাড়া সেভেন সিস্টার্স কে চীনের বিচ্ছিন্ন করার হুমকি মোকাবেলায় রাখাইন ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর কাছেও রাখাইন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে। এশিয়ার এই অঞ্চলের প্রভাব ও বাণিজ্যিক পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে রাখাইনের বিকল্প নেই। তাদের কাছে এমত অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে, রাখাইনে আন্তর্জাতিক ভূ রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ শুরু হয়েছে। তাতে বাংলাদেশের পরিস্থিতি আর অবস্থান কী হবে ?

মিয়ানমারের সরকার ও আরাকান আর্মি দু পক্ষের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক আছে। ভারত ও চীনের। নতুন রাষ্ট্র গঠন হলেও এই দুই দেশের তেমন প্রভাব পড়বে না। তবে নতুন রাষ্ট্র গঠিত হলে বাংলাদেশের কি কোনও চাপ বাড়তে পারে এমন প্রশ্ন রাখছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা ।

আরাকান স্বাধীন রাষ্ট্র হলে বাংলাদেশ পাবে নতুন একটি প্রতিবেশী দেশ। কেননা এতদিন বাংলাদেশের পাশে মিয়ানমারের ২৭১ কিলোমিটার সীমানা ছিল। এবার সেই সীমানা চলে যাচ্ছে নতুন একটি দেশের অধীনে। এতে বাংলাদেশের পাশে আর মিয়ানমার থাকছে না। নতুন প্রতিবেশী রাষ্ট্রই পাচ্ছে বাংলাদেশ।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান বাস্তবতায় সরকারের উচিত আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা। সেটা সরাসরি না হলেও ব্যাক চ্যানেলে করতে হবে। সরকার বলছে, মিয়ানমারের ২৭১ কিলোমিটার সীমান্ত পুরোটাই আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। অন্যদিকে দেশটি পরিচালনা করছে মিয়ানমার সরকার। ফলে সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে উভয় পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করছে বাংলাদেশ।