প্রশান্ত মহাসাগরে আরও দুটি জাহাজে হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে অন্তত পাঁচজন নিহত হয়েছেন। এর ফলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের তথাকথিত সমুদ্রপথে মাদক পাচারবিরোধী সামরিক অভিযানে এ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা বেড়ে অন্তত ১০৪ জনে দাঁড়িয়েছে। গত সেপ্টেম্বর থেকে প্রশান্ত ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে এই অভিযান চলছে।
শুক্রবার (১৯ ডিসেম্বর) আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
মার্কিন সামরিক বাহিনীর সাউদার্ন কমান্ড (সাউথকম) জানিয়েছে, প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথের নির্দেশে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে আন্তর্জাতিক জলসীমায় থাকা দুটি জাহাজে ‘মারাত্মক কাইনেটিক হামলা’ চালানো হয়। এর মধ্যে একটি জাহাজে তিনজন এবং অন্যটিতে দুজন নিহত হন।
এর একদিন আগেই বৃহস্পতিবার একই অঞ্চলে আরেকটি জাহাজে মার্কিন হামলায় চারজন নিহত হয় বলে জানিয়েছে সাউথকম। মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে এসব হামলায় মোট ৯ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।
মার্কিন সামরিক বাহিনী নিহতদের সন্ত্রাসী বলে দাবি করলেও, গত সেপ্টেম্বর থেকে প্রশান্ত ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে ধ্বংস করা প্রায় ৩০টি জাহাজ যে সত্যিই মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত ছিল—এমন কোনো প্রমাণ এখনো প্রকাশ করেনি ওয়াশিংটন।
এদিকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হেগসেথের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি জাহাজে হামলার পর যারা ভাঙা নৌকার ধ্বংসাবশেষ আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিল, তাদের ওপরও দ্বিতীয় দফা হামলার নির্দেশ দেওয়া হয়। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, জাহাজডুবির পর বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের ওপর হামলা চালানো আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত।
লাতিন আমেরিকার একাধিক নেতা ও আইন বিশেষজ্ঞ এই হামলাগুলোকে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তবে ট্রাম্প প্রশাসন এসব হত্যাকাণ্ডকে যুক্তরাষ্ট্রে মাদক পাচার ঠেকানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে তুলে ধরছে। বিশেষ করে ভেনেজুয়েলাভিত্তিক মাদক কার্টেলগুলোর বিরুদ্ধে এই অভিযান চালানো হচ্ছে বলে দাবি করা হয়েছে।
এছাড়া ট্রাম্প লাতিন আমেরিকায় ব্যাপক সামরিক মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছেন এবং ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানোর হুমকিও দিয়েছেন। তার অভিযোগ, মাদুরো একটি মাদক পাচার চক্র পরিচালনা করছেন।
চলতি সপ্তাহের শুরুতে ট্রাম্প আরও এক ধাপ এগিয়ে ভেনেজুয়েলার বন্দরগুলোতে আসা-যাওয়া করা যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত সব তেল ট্যাংকারের ওপর ‘সম্পূর্ণ নৌ অবরোধ’ আরোপের নির্দেশ দেন। এর উদ্দেশ্য দেশটির তেল সম্পদ সীমিত করা এবং অর্থনীতিকে দুর্বল করা বলে মনে করা হচ্ছে।
ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মাদুরো এই সামরিক তৎপরতার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, মাদকবিরোধী লড়াইয়ের অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র আসলে ভেনেজুয়েলায় ‘শাসন পরিবর্তন’ ঘটাতে এবং দেশের তেল সম্পদ দখল করতে চায়।
ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা বৃহস্পতিবার বলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও ভেনেজুয়েলার মধ্যে মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত, যাতে সশস্ত্র সংঘাত এড়ানো যায়। মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লাউডিয়া শেইনবাউমও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপ ঠেকাতে শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানিয়ে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছেন।
লাতিন আমেরিকার অন্যতম প্রভাবশালী নেতা লুলা সাংবাদিকদের বলেন, ওয়াশিংটন ও কারাকাসের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সংকট নিয়ে ব্রাজিল ‘খুবই উদ্বিগ্ন’। তিনি জানান, ট্রাম্পকে তিনি বলেছেন যে ‘গুলি চালিয়ে সমস্যার সমাধান হয় না, আলোচনার টেবিলে বসাই উত্তম পথ।’
লুলা আরও প্রশ্ন তোলেন, এই অভিযানের পেছনে আসল উদ্দেশ্য কী। এটা কি শুধু মাদুরোকে উৎখাত করার বিষয়? নাকি ভেনেজুয়েলার তেল, গুরুত্বপূর্ণ খনিজ বা বিরল ধাতু—এমন কোনো স্বার্থ জড়িত আছে? কেউ স্পষ্ট করে বলে না, এই যুদ্ধ কেন প্রয়োজন।
এদিকে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে প্রায় ১৫ হাজার মার্কিন সেনা এই অভিযানে অংশ নিচ্ছে। এটি কয়েক দশকের মধ্যে লাতিন আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক সমাবেশ। অভিযানে ১১টি যুদ্ধজাহাজ, উন্নত এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান, অন্যান্য বিমান ও ড্রোন ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বিমানবাহী রণতরীও রয়েছে।