ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শিয়া আল–সুদানি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা দেশ ছেড়ে না গেলে ইরাকের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে নিরস্ত্র করা সম্ভব নয়। সোমবার (৪ নভেম্বর) বার্তা সংস্থা রয়টার্স-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ মন্তব্য করেন।
সুদানির এই মন্তব্য এমন এক সময় এলো, যখন আগামী ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ইরাকের বহুল প্রত্যাশিত সংসদ নির্বাচন।
ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টায় রয়েছেন সুদানি। যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের ডলার লেনদেনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মিত্র, অন্যদিকে প্রতিবেশী ইরান সমর্থন করে প্রধানত শিয়াপন্থি সশস্ত্র সংগঠনগুলোর জোট পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সেস (পিএমপি)-কে।
নির্বাচনে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় টিকে থাকতে জনসমর্থন অর্জনের চেষ্টায় রয়েছেন সুদানি।
তিনি বলেন, ‘এখন আর আইএস নেই। নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা? আলহামদুলিল্লাহ, সেটাও আছে... তাহলে ৮৬টি রাষ্ট্রের উপস্থিতির কারণ কী?’ — ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দেওয়া দেশগুলোর সংখ্যা উল্লেখ করে বলেন তিনি।
‘এরপর অবশ্যই এমন একটি স্পষ্ট পরিকল্পনা থাকবে যাতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বাইরে কোনো অস্ত্র না থাকে। এটাই সবার দাবি,’ যোগ করেন তিনি।
গ্রীষ্মকালে যুক্তরাষ্ট্র দুইটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করেছে।
রয়টার্সের ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাইডেন প্রশাসনের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও ইরাকের মধ্যে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে একটি পরিকল্পনায় ঐকমত্য হয়, যা কেবল দুই দেশের নেতাদের অনুমোদন পেলেই কার্যকর হবে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে পশ্চিম আনবার প্রদেশের আইন আল-আসাদ বিমানঘাঁটি থেকে সব মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের বাহিনী প্রত্যাহার এবং রাজধানী বাগদাদে তাদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমানোর কথা।
সুদানি জানান, ভবিষ্যতে মিলিশিয়াগুলোকে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে, কিংবা তাদের সদস্যরা অস্ত্র ত্যাগ করে রাজনীতিতে যোগ দিতে পারেন।
লেবাননের সাদৃশ্য
এ প্রস্তাব এমন এক সময়ে এসেছে, যখন যুক্তরাষ্ট্র লেবাননে হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করতে হিমশিম খাচ্ছে।
ইরাকের পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সেস ও হিজবুল্লাহ— উভয়ই ইরানের অর্থ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এক শিথিল জোটের অংশ, যাকে বলা হয় ‘অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স’। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বাধীন ইসরাইল আক্রমণের পর এই জোট ইসরাইলি হামলায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ইরাকি মিলিশিয়ারা জর্ডানে মার্কিন সেনাদের লক্ষ্য করে হামলা চালায়, তবে গাজায় ইসরাইলবিরোধী যুদ্ধে মূলত তারা সরাসরি অংশ নেয়নি।
৭ অক্টোবরের পর গাজায় ইসরাইলের অভিযানকে বিশ্বের বহু নেতা, জাতিসংঘ ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় অক্টোবর মাসে একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি হলেও ইসরাইল তা বারবার লঙ্ঘন করেছে।
দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র ইরাককে পিএমএফ–সংযুক্ত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ভেঙে দিতে চাপ দিয়ে আসছে। একই সময়ে মার্কিন দূত টম ব্যারাক লেবাননে হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে এক অসম যুদ্ধবিরতিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয় হিজবুল্লাহ, যা ইসরাইলকে দলটির বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোর বৈধতা দেয়। এরপরও ইসরাইলি হামলায় তারা কোনো বড় পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
লেবাননের সেনাবাহিনী ইতোমধ্যে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বহু এলাকায় হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করেছে বলে আঞ্চলিক কূটনীতিকরা জানিয়েছেন। সরকার বাকি অঞ্চলগুলোতে হিজবুল্লাহর ভারী অস্ত্র সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তরের জন্য আলোচনা চালাচ্ছে, যদিও হিজবুল্লাহ এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।
বাহরাইনে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে মার্কিন দূত ব্যারাক বলেন, ‘বলপ্রয়োগ করে হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করা সম্ভব নয়। বরং তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশগুলোকে অর্থনৈতিক প্রণোদনা দিতে হবে, যাতে যোদ্ধারা স্বেচ্ছায় অস্ত্র জমা দেয়।’
লেবাননে হিজবুল্লাহ সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল এবং দলটির সদস্যরা মার্কিন সমর্থিত সরকারেও রয়েছে। তাদের সশস্ত্র শাখা ও সামাজিক সেবামূলক নেটওয়ার্ক সরকার-নিয়ন্ত্রিত কাঠামোর বাইরে পরিচালিত হয়।
ইরাকে পিএমএফ সদস্যরাও সরকারি বেতন পান। সুদানির আমলে ২০২৩ সালের তিন বছরের বাজেটে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার সদস্যের এই বাহিনীকে অতিরিক্ত ৭০০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয়।