
ইসরাইলের কারাগারে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বন্দি রয়েছেন ‘ফিলিস্তিনের ম্যান্ডেলা’ হিসেবে খ্যাতি পাওয়া মারওয়ান বারঘুতি। ফিলিস্তিনি সংগঠন ফাতাহ আন্দোলনের সিনিয়র ও জনপ্রিয় নেতা তিনি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজা শান্তি পরিকল্পনার আওতায় ইসরাইলি জিম্মিদের মুক্তির বিনিময়ে প্রায় দেড় হাজার ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেবে নেতানিয়াহুর সরকার। কিন্তু তারা কোনোভাবেই মারওয়ান বারঘুতিকে মুক্তি দিতে রাজি হচ্ছে না। হামাস তার নাম বন্দিমুক্তির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বারবার দাবি জানালেও ইসরাইল তাতে সাড়া দিচ্ছে না।
এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ইঙ্গিতে কাতারের পক্ষ থেকেও বারঘুতির মুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয় ইসরাইলের কাছে। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। ইসরাইল সরকারের মুখপাত্র শোশ বেদ্রোসিয়ান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি এই মুহূর্তে আপনাদের নিশ্চিত করে বলতে পারি, বারঘুতি এই মুক্তির অংশ হবেন না।’ ইসরাইলি আদালত মারওয়ান বারঘুতিকে পাঁচ দফা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ছাড়াও অতিরিক্ত ৪০ বছর কারাদণ্ড দিয়েছে।
কে এই মারওয়ান বারঘুতি?
১৯৫৯ সালে অধিকৃত পশ্চিমতীরের রামাল্লাহর কাছে অবস্থিত কোবার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বারঘুতি। তিনি কিশোর বয়সেই ফাতাহ আন্দোলনে যোগ দেন এবং দ্রুত এর যুব আন্দোলনের মাধ্যমে নেতৃত্বের কাতারে উঠে আসেন। মারওয়ান বারঘুতি ফাতাহর গুরুত্বপূর্ণ নেতা হলেও দলীয় গণ্ডির বাইরে তার তাৎপর্য একজন জাতীয় নেতা হিসেবে। তাকে ফিলিস্তিনি জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৮৬ সালে অধিকৃত পশ্চিতীর থেকে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হওয়ার আগে কয়েকবার তাকে ইসরাইলি কারাগারে বন্দি থাকতে হয়েছে।
তিনি ১৯৯৪ সালে নির্বাসন থেকে স্বদেশে ফিরে আসেন এবং একই বছর ফাতাহর মহাসচিব নির্বাচিত হন। ২০০০ সালের শুরুর দিকে তিনি ইসরাইলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের দ্বিতীয় ইন্তিফাদা বা গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বে থাকা সবচেয়ে দৃশ্যমান ব্যক্তিত্বদের একজন ছিলেন। ইসরাইলের ক্রমবর্ধমান দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংলাপ এবং সশস্ত্র প্রতিরোধ উভয়ের পক্ষেই ছিলেন বারঘুতি।
দ্বিতীয় ইন্তিফাদায় তার বিপ্লবী ভূমিকা-পরবর্তী ২৩ বছরের জন্য তার ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়। কারণ তার এই ভূমিকার কারণেই ইসরাইল ২০০২ সালে তাকে গ্রেপ্তার করে এবং হত্যা ও সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্যপদে থাকাসহ পাঁচটি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে পাঁচ দফা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি অতিরিক্ত ৪০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে। এরপর থেকে ২৩ বছর ধরে তিনি ইসরাইলের কারাগারে রয়েছেন।
কিন্তু তিনি তার বিচারকারী ইসরাইলি আদালতকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে এটিকে পক্ষপাতদুষ্ট এবং রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিহিত করেন। এ কারণে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করতে অস্বীকৃতি জানান। বারঘুতির সমর্থকদের কাছে তার এই কারাদণ্ড ছিল ফিলিস্তিনি দলগুলোর জনপ্রিয় অল্প কয়েকজন নেতার একজনকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা।
গ্রেপ্তারের পর থেকে এই দীর্ঘ সময়ে বারঘুতি কারাগারেও একজন সক্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে ভূমিকা পালন করে গেছেন। তিনি ফিলিস্তিনি সংগঠনগুলোর মধ্যে বিভেদের অবসান, ইসরাইলি কারাগারে থাকা ফিলিস্তিনি বন্দিদের অধিকার আদায় এবং জাতীয় ঐক্যের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন সময় কারাগার থেকেই বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে চলেছেন।
২০০৬ সালে তিনি ফিলিস্তিনি প্রিজনার্স ডকুমেন্টের প্রধান লেখকদের একজন ছিলেন, যা ছিল ফাতাহ, হামাস, ইসলামিক জিহাদ এবং পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনের নেতাদের স্বাক্ষরিত একটি আন্তঃদলীয় প্রস্তাব। এই ডকুমেন্টে অভ্যন্তরীণ বিভেদের অবসান এবং ১৯৬৭ সালের সীমানার ভিত্তিতে দ্বিরাষ্ট্র সমাধান অনুসরণ করার আহ্বান জানানো হয়েছিল। এই দলিলে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনকে (পিএলও) ফিলিস্তিনি জনগণের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
বারঘুতি কারাগার থেকে যেসব চিঠি পাঠাতেন, তাতে সহিংসতার পরিবর্তে ঐক্যের ভিত্তিতে জনপ্রিয় প্রতিরোধের একটি নতুন পর্যায় গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হতো। বিশ্লেষকরা বলছেন, বারঘুতির প্রভাব শুধু ফাতাহ আন্দোলনের মধ্যেই সীমিত নয়, বরং ফিলিস্তিনি সব দল-উপদল ও সংগঠনের নেতাকর্মী এবং সাধারণ ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বিস্তৃত। দুই দশকের বেশি সময় ধরে কারাগারে থাকা সত্ত্বেও বারঘুতি সবচেয়ে জনপ্রিয় ফিলিস্তিনি নেতাদের একজন। বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, তিনি মাহমুদ আব্বাসের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হবেন। বিশ্লেষকরা বিশ্বাস করেন, তার মুক্তি ফিলিস্তিনি রাজনীতিকে নতুন রূপ দিতে পারে।
এ জন্যই ইসরাইল বারঘুতিকে ভয় পায়। ২০০২ সালের পর থেকে ইসরাইলের সব সরকারই জোর দিয়ে বলেছে, বারঘুতির ‘হাতে রক্ত লেগে আছে’ এবং তাকে কারাগারেই থাকতে হবে আজীবন। ইসরাইলের ভয় হচ্ছে, বারঘুতির মুক্তি ফাতাহ আন্দোলনকে শক্তিশালী করবে, পাশাপাশি ফিলিস্তিনি সংগঠনগুলোর মধ্যে ঐক্যের সম্ভাবনা জোরদার এবং অধিকৃত অঞ্চলগুলোয় ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। এ কারণেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর কট্টর ডানপন্থি জোট সরকার বারঘুতির নাম এবারের বন্দিমুক্তির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না করার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে।
গত আগস্ট মাসে ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গভির কারাগারে বারঘুতির সেলে গিয়ে তাকে গালাগাল করে বলেছিলেন, ‘তুমি জিততে পারবে না। যে ইসরাইলের জনগণের সঙ্গে ঝামেলা করবে, যে আমাদের শিশু ও নারীদের হত্যা করবে, আমরা তাকে নিশ্চিহ্ন করে দেব।’
রামাল্লাভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইসমত মনসুর এর আগে সংবাদমাধ্যম নিউ আরবকে বলেছিলেন, বারঘুতি ‘ফাতাহ এবং হামাসের মধ্যে পুনর্মিলন ঘটাতে এবং পশ্চিমতীর ও গাজাকে একীভূত করতে পারেন’। হামাস বিশ্বাস করে, ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিকারী মাহমুদ আব্বাসের বিপরীতে বারঘুতি একজন ঐক্য সৃষ্টিকারী নেতা।
ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী খলিল শিকাকি বলেন, বারঘুতিকে মুক্তি না দিতে ইসরাইলের অস্বীকৃতির মূলে রয়েছে তার ঐক্য সৃষ্টিকারী প্রভাবের ভয়। তিনি বলেন, ‘ইসরাইল বিশ্বাস করে যে, যদি তারা বারঘুতিকে মুক্তি দেয়, তাহলে তিনি ফিলিস্তিনিদের ঐক্যবদ্ধ করবেন।’ এ জন্যই পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো বারঘুতিকে ‘ফিলিস্তিনের ম্যান্ডেলা’ হিসেবে অভিহিত করে থাকে।
ইসরাইলি একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, ফিলিস্তিনি বন্দিমুক্তির তালিকায় পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনের (পিএফএলপি) মহাসচিব আহমেদ সাদাত, হামাসের সিনিয়র নেতা হাসান সালামেহ এবং ইব্রাহিম হামেদসহ অন্যান্য বন্দির নাম আছে। আরো আছে ইসরাইলে ৭ অক্টোবরের হামলায় জড়িত থাকার সন্দেহে আটক হামাসের সশস্ত্র শাখা কাসাম ব্রিগেডের সদস্যদের নাম অন্তর্ভুক্ত থাকলেও বারঘুতির নাম তালিকায় আনতে ইসরাইল মোটেও রাজি নয়।
মিডল ইস্ট আই থেকে ভাষান্তর : মোতালেব জামালী