
ক্ষুধা, মৃত্যু, নিয়মিত বোমা বর্ষণ। এমন একটি ভূখণ্ডে শান্তি ফেরানো গেলে এর চেয়ে ভালো উদ্যোগ আর কি হতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়ে এমন উদ্যোগ নিলেও বাস্তবতা বলেছে, আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া এখনো বেশ দূরে ও কঠিন।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকের একেবারে আগ মুহুর্তে কয়েকটি দেশের স্বীকৃতি দেওয়াকে ফিলিস্তিন আপাতত কূটনৈতিক জয় হিসেবে দেখতে পারে। কারণ, জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্যের মধ্যে ১৫৬টিই তাদের পক্ষে আছে। কিন্তু বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সংবাদ বিশ্লেষণগুলোতে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই স্বীকৃতিগুলো মূলত প্রতীকী। এগুলো প্রকৃত রাষ্ট্র গড়ে তোলার পথে এখনই খুব একটা সাহায্য করবে না।
রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে আগে যুদ্ধ বন্ধের পাশাপাশি সীমানা নির্ধারণ ও ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিভাজন দূর করতে হবে। যেসব শর্ত দিয়ে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে সেগুলো পূরণ না হলেও জটিলতা কাটবে না।

সোমবার ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ। ছবি: এএফপি
কেন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা একটি জটিল প্রক্রিয়া, চলুন তা ধাপে ধাপে বোঝা যাক।
দরকার ‘প্রকৃত সার্বভৌমত্ব’
এক সময় ফিলিস্তিন ভূখণ্ড ছিল পূর্বে জর্ডান নদ থেকে পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের পর ইসরায়েল পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম ও গাজা উপত্যকা দখল করে নেয় (২০০৭ সালে গাজার দখলদারি ছেড়ে দেয়)। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির মাধ্যমে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ গঠিত হওয়ার মাধ্যমে কিছুটা স্বায়ত্তশাসন পেলেও এটি পুরোপুরি স্বাধীনতা পায়নি।
কারণ, একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সীমানা নির্ধারণ, সেনাবাহিনী গঠন ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দরকার। কেবল স্বীকৃতি দিলেই এগুলো নিশ্চিত হবে না। যেমন- ২০১২ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়। এর মাধ্যমে তারা কোনো বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) দারস্থ হওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু এরপরও ইসরায়েলি দখলদারি বন্ধ হয়নি। কারণ এখনো ফিলিস্তিন সার্বভৌমত্ব অর্জন করেনি।

মাহা নেসার। ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডল ইস্টার্ন ও নর্থ আফ্রিকান স্টাডিজ স্কুলের সহযোগী অধ্যাপক মাহা নেসার তাঁর এক নিবন্ধে বলেছেন, প্রকৃত সার্বভৌমত্বের জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন দরকার। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতা এটাকে আটকে রেখেছে।
ভেটোর বাধা উতড়ানো
জাতিসংঘের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, নতুন সদস্য গ্রহণের জন্য সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদের মধ্যে সমঝোতা দরকার হয়। সদস্যপদ লাভের যেকোনো আবেদন প্রথমে মহাসচিবের কাছে যায় এবং পরে তা নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদের কাছে পাঠানো হয়।
জাতিসংঘের সাধারণ সদস্য বর্তমানে ১৯৩টি। তাদের মধ্যে নিরাপত্তা পরিষদের মোট সদস্য দেশ ১৫টি। এর মধ্যে পাঁচটি দেশ পরিষদের স্থায়ী সদস্য। বাকি ১০ দুই বছরের জন্য অস্থায়ীভাবে নির্বাচিত হয়। নতুন সদস্য দেশের আবেদন প্রথমে এই নিরাপত্তা পরিষদ যাচাই করে। তারা সুপরিশ করলে পরে তা সাধারণ পরিষদের ১৯৩ দেশের সামনে তুলে ধরা হয়।
নিরাপত্তা পরিষদে কোনো খসড়া প্রস্তাব পাস হতে হলে অন্তত ৯টি সদস্য দেশের সমর্থন প্রয়োজন হয়। তবে খসড়াটি তখনই চূড়ান্তভাবে পাস হবে যখন সেটির বিরুদ্ধে স্থায়ী সদস্যদের কেউ ভেটো দেবে না। স্থায়ী ৫ সদস্যের কোনো একটিও যদি ভেটো দেয় তাহলে ওই খসড়া আর পাস হয় না।

ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য করার খসড়া প্রস্তাবে ভেটো দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি। ২০২৪ সালে। ছবি: ইউএন
যেমন- গত বছরের এপ্রিলে ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য রাষ্ট্র করার বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদে একটি খসড়া প্রস্তাব তোলা হয়। সেখানে ১২টি সদস্য দেশ পক্ষে ভোট দেয়। কিন্তু একটি স্থায়ী সদস্য ভেটো দেওয়ার কারণে সেটি আর পাস হয়নি। ভেটোটি দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। বাকি দুটি দেশ ভোট দেওয়া থেকে নিজেদের বিরত রাখে।
তখন যুক্তরাষ্ট্রের এমন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে রাশিয়া বলেছিল, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। আর ভোট না দেওয়ার কারণ হিসেবে যুক্তরাজ্য বলেছিল, ফিলিস্তিনে আগে সংস্কার দরকার। রাষ্ট্র গঠনের জন্য হামাসকে বাদ দিয়ে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে মূল দায়িত্ব নিতে হবে। আর চীনের প্রতিনিধি বলেন, অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় ফিলিস্তিনের জন্য জাতিসংঘের সদস্য পদ পাওয়া এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হলো- যুক্তরাষ্ট্র, চীন, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া ও ফ্রান্স। আর বর্তমানে অস্থায়ী ১০ সদস্য হলো- বাহরাইন, কলম্বিয়া, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গো, লাটভিয়া, লাইবেরিয়া, ডেনমার্ক, গ্রীস, পাকিস্তান, পানামা ও সোমালিয়া।
তাই রাষ্ট্র হিসেবে জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য পদ পেতে ফিলিস্তিনকে এই ভেটোর বাধা উতরাতে হবে।
সীমানার মীমাংসা
ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া দেশগুলো যে দুই-রাষ্ট্র সমাধানের কথা বলছে, সেটি মূলত পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম ও গাজা উপত্যকাকে কেন্দ্র করে একটি রাষ্ট্রের পরিকল্পনা।
২০১২ সালে জাতিসংঘের ৬৭তম সাধারণ অধিবেশনের নথি অনুযায়ী, দুই রাষ্ট্র সমাধানের মাধ্যমে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে এসব অঞ্চল থেকে ইসরায়েলের দখল প্রত্যাহার করতে হবে। নথিতে আরও বলা হয়, পূর্ব জেরুজালেম দখল ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের বেড়া দেওয়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বৈধ নয়। পাশাপাশি এটি আন্তর্জাতিক আইনের বিরোধী। নথিতে সুপারিশ করা হয়, ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল উভয়েই জেরুজালেমকে রাজধানী দাবি করায়- এই সমস্য আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।

অসলো চুক্তি স্বাক্ষরের পর হাত মেলান ইয়াসির আরাফাত (ডানে) ও আইজ্যাক রবিন (বাঁয়ে)। ফাইল ছবি: এএফপি
বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৯৩ সালে পিএলএ নেতা ইয়াসির আরাফাত ও ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিনের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি হয়। যেটি অসলো চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তি অনুযায়ী, ফিলিস্তিনিরা স্বশাসনের আংশিক অধিকার পাবে এবং ইসরায়েল পশ্চিম তীরের জেরিকো ও গাজা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করবে। কিন্তু চুক্তি হলেও তা মানা হয়নি।
রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিম তীর হলো প্রায় ২.৭ মিলিয়ন ফিলিস্তিনির আবাসভূমি। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের সময় ইসরায়েল এই পশ্চিম তীর দখলে নেয়। চলমান যুদ্ধের সময়ও সেখানে ইহুদিদের বসতি গড়ে তুলতে উৎসাহ দিচ্ছে। ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা ফিলিস্তিনিদের আবাদি জমিও দখল করছে। এর ফলে এই এলাকায় ফিলিস্তিনিদের মালিকানাধীন জমি কমে আসছে।

ইসরায়েলি অভিযানের মুখে পশ্চিম তীর থেকে চলে যাচ্ছে একটি পরিবার। গত বছরের আগস্টে। ছবি: এএফপি
সম্প্রতি ইসরায়েল গাজা সিটিও দখলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। সুতরাং ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে আগে পূর্ব জেরুজালেম, পশ্চিম তীরের সীমানা সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করতে হবে।
অভ্যন্তরীণ বিভাজন
স্বীকৃতি দেওয়ার আগে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স কিছু শর্ত দিয়েছে। এর মধ্যে আছে ফিলিস্তিনের পরবর্তী নির্বাচন আয়োজন করতে হবে হামাসকে বাদ দিয়ে। কিন্তু একটি জরিপ দেখাচ্ছে, এটি বাস্তবায়ন করা বেশ কঠিন। কারণ অধিকাংশ ফিলিস্তিনি হামাসকে সমর্থন করে।
হামাস হলো ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের একটি। অপরটি হলো ‘ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ’। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার কাছে হামাস চিহ্নিত সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে।
এনবিসি নিউজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফিলিস্তিনি পলিসি অ্যান্ড সার্ভে রিসার্চ সেন্টারের জরিপ বলছে, ফিলিস্তিনিদের এক-তৃতীয়াংশ মনে করেন- পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এবং গাজায় হামাসের মধ্যে অভ্যন্তরীণ ও রাজনৈতিক বিভাজনই তাদের ক্ষতির বড় কারণ। একই জরিপে দেখা গেছে, গাজা ও পশ্চিম তীরে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের অর্ধেকের বেশি ‘ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের’ তুলনায় হামাসকে ভোট দেবেন। তারা মনে করেন, হামাসই আল-আকসা মসজিদ ও পূর্ব জেরুজালেমে মুসলিমদের অন্যান্য পবিত্র স্থানগুলো রক্ষা করতে পারবে।
ফলে যে শর্ত দিয়ে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেটি বাস্তবায়ন করতে গেলে নির্বাচন ঘিরে নতুন করে অভ্যন্তরীণ সংঘাত দানা বাঁধতে পারে।