
ইরানের রাজধানী তেহরানে হামাসের রাজনৈতিক শাখার তৎকালীন প্রধান ইসমাইল হানিয়াকে হত্যার পর থেকেই আশঙ্কা করা হচ্ছিল তুরস্কও নিরাপদে নেই। কিন্তু, কাতারের রাজধানী দোহায় হামাসের বর্তমান নেতাদের হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা চালানো হলে সেই আশঙ্কা আরও তীব্র হয়। কেননা, দোহায় হামলার পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে বলেছেন, হামাসের নেতারা যে যেখানেই থাকুক না কেন তাদের লক্ষ্য করে হামলা হবেই।
২০২৪ সালের ৩১ আগস্ট ভোরে ঘটেছিল ঘটনাটি। এএফপির প্রতিবেদনে জানানো হয়, ঘটনাটির একদিন আগে ইসমাইল হানিয়া তেহরানে গিয়েছিলেন মাসুদ পেজেশকিয়ানের শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। ইসরায়েল এই হত্যার দায় স্বীকার বা অস্বীকার করেনি। হামাসের দাবি, এর পেছনে ইসরায়েলের হাত আছে।

হত্যাকাণ্ডের দিন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছিলেন, হামাস ও হিজবুল্লাহসহ ইরানের মিত্রদের ওপর ধ্বংসাত্মক আঘাত হানা হয়েছে।
এই হামলার পর এ কথাই চাউর হতে থাকে যে ইসরায়েল কোনো হামাস বা হিজবুল্লাহ নেতাকে বাঁচিয়ে রাখবে না। তারা যে যেখানেই থাকুক না কেন। সেই সূত্র ধরে এগোলে দেখা যায়, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেজেপ তায়িপ এরদোয়ানের সরকার ২০২৩ সালে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের অনেক আগে থেকেই হামাসের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে।
২০০৩ সালে একে পার্টি তুরস্কে ক্ষমতায় এলে প্রধানমন্ত্রী হন এরদোয়ান। সেসময় ইসরায়েলের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক ভালো ছিল। মোটা দাগে দেশ দুইটির মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে ২০০৮-০৯ সালের গাজা যুদ্ধের পর থেকে। ২০১০ সালে ভূমধ্যসাগরে আন্তর্জাতিক জলসীমায় গাজা ফ্রিডম ফ্লোটিলা মাভি মারমারায় ইসরায়েলি বাহিনী হামলা করলে দুই দেশের সম্পর্ক তলানিতে এসে পড়ে। এরপর তা আর স্বাভাবিক করা যায়নি।
গত রোববার আল জাজিরার এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়—মধ্যপ্রাচ্যে তুরস্ক কি ইসরায়েলি হামলার পরবর্তী লক্ষ্য? এতে বলা হয়, দোহায় ইসরায়েলি হামলার পর তেল আবিবের উচ্চাশা নিয়ে আঙ্কারা ক্রমশ সতর্ক।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কাতারে হামলার পরপরই ইসরায়েলি বিশ্লেষকরা তুরস্ক নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। এ ছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থি বিশ্লেষক ও আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো মাইকেল রুবিন মনে করেন ইসরায়েলি হামলার পরবর্তী লক্ষ্য হতে পারে তুরস্ক। তিনি আরও মনে করেন যে ন্যাটোর সদস্য হিসেবে তুরস্ককে রক্ষা করা কারও উচিত হবে না।

সংবাদ প্রতিবেদন অনুসারে, গত কয়েক মাস ধরে ইসরায়েলপন্থি সংবাদমাধ্যমগুলো 'ইসরায়েলের সবচেয়ে বিপদজনক শত্রু হিসেবে' তুরস্ককে তুলে ধরা হচ্ছে।
ইসরায়েলি বিশ্লেষকরা পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুরস্ককে 'হুমকি' ও গৃহযুদ্ধপরবর্তী সিরিয়ায় এই দেশটিকে 'আসন্ন বিপদ' হিসেবে উল্লেখ করছেন।
গাজা যুদ্ধ শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা না যাওয়ায় গত আগস্টে তুরস্ক এক সময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইসরায়েলের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করে।

মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান আটলান্টিক কাউন্সিলের ফেলো ওমর ওঝকিঝিলজিক আল জাজিরাকে বলেন, 'আঙ্কারায় তুরস্কবিরোধী বক্তব্যকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হচ্ছে কেননা, ইসরায়েলকে আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তার করতে দেখা যাচ্ছে।'
তার মতে, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পাওয়ায় ইসরায়েল এখন যেকোনো জায়গায় হামলা চালাতে পারে। ন্যাটো সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তুরস্ক আইন অনুসারে যে মার্কিন সমর্থন পাওয়ার কথা তা নাও পেতে পারে। আর তুরস্কও ভালোভাবে জানে যে তার নিরাপত্তা যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটো দেবে না।

এদিকে, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ক্রমাগত 'বৃহত্তর ইসরায়েল' গড়ার কথা বলায় মধ্যপ্রাচ্য নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হচ্ছে। সেই 'বৃহত্তর ইসরায়েল' ধারণা মিশর থেকে ইরাক পর্যন্ত বিস্তৃত হলেও আঙ্কারাকেই কি এখন মধ্যপ্রাচ্যে 'বড় শত্রু' হিসেবে দেখছে তেল আবিব? আর মধ্যপ্রাচ্যের তুলনামূলক শক্তিশালী এই দেশটিকে দুর্বল করে রাখতেই কি কাতারের পর তুরস্কে ইসরায়েলি হামলার কথা আসছে?
বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, অন্তত হামাসের কথা বলে তুরস্কে হামলা চালালে তা কোনো দেশই থামাতে আসবে না। তবে এ কথা সবাই জানেন যে, ইসরায়েল যা করে তা অন্যরা ভাবতেও পারেন না। আসলেই ইসরায়েল সরাসরি তুরস্কে হামলা চালাবে নাকি অন্যদের ব্যবহার করে দেশটিতে নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে—এখন তাই দেখার বিষয়।