
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের টানাপড়েনের প্রেক্ষাপটে বড় ধরনের কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। ওয়াশিংটন থেকে নতুন অস্ত্র ও নজরদারি বিমান কেনার পরিকল্পনা আপাতত স্থগিত করেছে দিল্লি। সরকারি একাধিক সূত্র বলছে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের রপ্তানি পণ্যে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের পর কয়েক দশকের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে। অস্ত্র কেনা স্থগিত করা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ভারতের প্রথম বড় ধরনের অসন্তোষের প্রকাশ।
সংবাদমাধ্যম রয়টার্স জানিয়েছে, ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংকে শিগগিরই ওয়াশিংটনে পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা চুক্তি চূড়ান্ত করার কথা ছিল। এর মধ্যে ছিল জেনারেল ডায়নামিকসের তৈরি স্ট্রাইকার যুদ্ধযান, রেথিয়ন ও লকহিড মার্টিনের তৈরি জ্যাভলিন ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং প্রায় ৩৬০ কোটি ডলারের ৬টি বোয়িং পি৮১ সামুদ্রিক নজরদারি বিমান কেনা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক আরোপের পর এই সফর বাতিল হয়েছে এবং চুক্তিগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে।
ভারতীয় কর্মকর্তাদের ভাষ্য, এই কেনাকাটা স্থগিতের সিদ্ধান্ত লিখিতভাবে ঘোষণা করা না হলেও বাস্তবে কার্যক্রম স্থবির। দুই পক্ষ চাইলে দ্রুত অচলাবস্থা কাটিয়ে আবার আলোচনায় ফিরতে পারে, তবে আপাতত কোনো অগ্রগতি নেই।
ট্রাম্প প্রশাসন ৬ আগস্ট ভারতীয় পণ্যে অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় রপ্তানির মোট শুল্কহার ৫০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে—যা দেশটির প্রধান বাণিজ্য অংশীদারদের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ হার। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, ভারত রাশিয়া থেকে তেল কিনে ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে অর্থ জোগাচ্ছে।
ট্রাম্পের অতীত রেকর্ড বলছে, তিনি একাধিকবার হঠাৎ শুল্কের হার পরিবর্তন বা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাই দিল্লি এখনো ওয়াশিংটনের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, শুল্ক ইস্যু ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে স্পষ্টতা আসলেই প্রতিরক্ষা কেনাকাটার বিষয়ে অগ্রগতি হতে পারে।
ভারতের অবস্থান ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিচারিতার অভিযোগ
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ প্রতিরক্ষা অংশীদারত্ব গড়ে তুললেও দিল্লির অভিযোগ, তাদের ‘অন্যায়ভাবে নিশানা’ করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় মিত্ররা নিজেদের প্রয়োজনে এখনো রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য করছে, অথচ ভারতের ওপর চাপ বাড়ানো হচ্ছে।
ভারতের আরেক সরকারি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দেশটি রাশিয়া থেকে তেল আমদানি কমাতে প্রস্তুত, যদি যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য সরবরাহকারী দেশ একই দামে তেল সরবরাহ করে। তবে ট্রাম্পের কঠোর অবস্থান এবং দেশের ভেতরে বাড়তে থাকা মার্কিনবিরোধী জাতীয়তাবাদী মনোভাব এই পরিবর্তনকে রাজনৈতিকভাবে কঠিন করে তুলেছে।
রাশিয়ার সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ক
ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক দেশ, এবং ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়াই তাদের প্রধান সরবরাহকারী। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দিল্লি ফ্রান্স, ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশি কেনাকাটায় ঝুঁকেছে, তবুও কয়েক দশকের পুরোনো সামরিক সরঞ্জামের রক্ষণাবেক্ষণে এখনো রাশিয়ার প্রযুক্তি ও যন্ত্রাংশের ওপর নির্ভরশীল।
মস্কো সম্প্রতি ভারতের কাছে এস-৫০০ বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে। তবে ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে নতুন রুশ অস্ত্র কেনার তেমন প্রয়োজন নেই। এর পেছনে কারণ রাশিয়ার অস্ত্র রপ্তানিতে সীমাবদ্ধতা, ইউক্রেন যুদ্ধে নিজেদের অস্ত্রভান্ডারের অধিক ব্যবহার এবং কিছু অস্ত্রের দুর্বল পারফরম্যান্সের সমালোচনা।
রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তাৎপর্য
বিশ্লেষকদের মতে, দিল্লির এই সিদ্ধান্ত কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং একটি স্পষ্ট কূটনৈতিক বার্তা। এটি দেখিয়ে দিচ্ছে, ওয়াশিংটনের চাপের মুখে ভারত সহজে নতি স্বীকার করবে না এবং প্রতিরক্ষা খাতকে আলোচনার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতেও পিছপা নয়। একই সঙ্গে এটি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও একটি শক্তিশালী সংকেত দিচ্ছে—জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে ভারত কোনো পক্ষের কাছেই একপাক্ষিক ছাড় দিতে রাজি নয়।