
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজা যুদ্ধ শেষ করতে যুদ্ধবিরতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের চাপ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। শুক্রবার প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমসের এক বিস্তৃত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এই অভিযোগ তোলা হয়েছে। শতাধিক ইসরাইলি ও আমেরিকান কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে নিউ ইয়র্ক টাইমসের এই প্রতিবেদনটি দাবি করেছে, নেতানিয়াহু গাজা যুদ্ধ চলাকালে এমন একাধিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যেগুলো তার নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থান টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে গৃহীত হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকে ইসরাইলি জনগণের জরিপ তুলে ধরেছিলেন। ওই জরিপে দেখা গেছে ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ গাজা যুদ্ধ বন্ধ করে জিম্মি বিনিময় চুক্তি করতে চায়। এর উত্তরে নেতানিয়াহু বলেন, আমার ভোটারদের ৫০ শতাংশ তা চায় না।
আরও একটি উদাহরণ তুলে ধরে নিউ ইয়র্ক টাইমস জানায়, ৯ জুন ইসরাইল ইরানের উপর হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল এবং ঠিক তার দুই দিন পর সংসদ ভেঙে দেওয়ার ভোট হওয়ার কথা ছিল। সেদিন নেতানিয়াহু জোট রক্ষা করতে হারেদি (অতিধার্মিক) নেতা মোশে গাফনিকে গোপনে জানান যে, ইরানে শিগগির হামলা চালানো হবে। ডিগেল হাতোরাহ দলের নেতা গাফনিকে তলব করে প্রধানমন্ত্রী তাকে একটি গোপনীয়তা চুক্তিতে স্বাক্ষর করান এবং এরপর আসন্ন ইরান হামলার তথ্য জানিয়ে দেন। দুই দিন পর গাফনি ও তার দল জোট সরকারের পক্ষে ভোট দেয়। এর ফলে নেতানিয়াহুর সরকার ভেঙে পড়া থেকে রক্ষা পায়। সেদিন রাতেই ইসরাইলি বিমানবাহিনী ইরানে হামলা চালায়।
ইসরাইলি সাংবাদিক ও গাফনির ঘনিষ্ঠজন ইসরাইল কোহেন নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, এই ইরান হামলাই ছিল একমাত্র জিনিস যা হারেদিদের সরকার ভাঙা থেকে বিরত রেখেছিল। আর বিবি (নেতানিয়াহু) এটা জানতেন।
প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়, গাজা যুদ্ধকালীন নেতানিয়াহু একাধিক সিদ্ধান্ত নেন যেগুলো যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করে। এর পেছনে আছে তার রাজনৈতিকভাবে বাঁচার চেষ্টা, মিত্রদের সন্তুষ্ট করা এবং কৌশলে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা।
তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবরের পর নেতানিয়াহু লেবাননের হিজবুল্লাহ নেতাদের ওপর আকস্মিক হামলার সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে যান। একইভাবে এপ্রিল ২০২৪ সালে যুদ্ধবিরতি আলোচনাও ভেস্তে দেন। এক মন্ত্রিসভা বৈঠকে তিনি ছয় সপ্তাহব্যাপী যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আনতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ যখন গুজব শুনে বলেন, আপনি যদি এই আত্মসমর্পণের মতো প্রস্তাব আনেন, তাহলে এই সরকারের আর অস্তিত্ব থাকবে না, তখন নেতানিয়াহু তার প্রতিরক্ষা উপদেষ্টাদের প্রস্তাব না দেয়ার নির্দেশ দেন।
রিপোর্টে আরও তথ্য তুলে ধরা হয় যে, অক্টোবর ৭ এর আগের নয় মাসে নেতানিয়াহু তার শীর্ষ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে গেছেন। সাবেক আইডিএফ চিফ হার্জেল হালেভি, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট এবং শিন বেত প্রধান রোনেন বার বারবার নেতানিয়াহুকে বলেন, তার সরকারের বিচার ব্যবস্থা সংস্কার পরিকল্পনা ইসরাইলের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
নিউ ইয়র্ক টাইমস জানায়, ইসরাইল ছিল মারাত্মক ঝুঁকিতে। দেশটি ছিল এক গভীর বিভাজনের মধ্যে- বিচার সংস্কার নিয়ে উত্তাল। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে আইডিএফ-এর এক গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়, ইসরাইলের প্রতিপক্ষ- হামাস, হিজবুল্লাহ ও ইরান-ইসরাইলি সমাজ ও সেনাবাহিনীর ভেতরের ফাটল পর্যবেক্ষণ করছিল। তারা গোপনে আলোচনা করছিল যে, ইসরাইল কি এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে, এখনই আক্রমণের সময়? এই অনুসন্ধান দক্ষিণ এশিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত বিশ্বের নেতৃত্বের রাজনৈতিক স্বার্থ বনাম জাতীয় নিরাপত্তা ও মানবাধিকার রক্ষার প্রশ্নে এক গুরুতর বিতর্ক উত্থাপন করে।