
আফগানিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক বিশেষ দূত জালমে খালিলজাদ সম্প্রতি এক্সে (সাবেক টুইটার) এক পোস্টে অভিযোগ করে লিখেছেন, “ইরান সরকার হাজার হাজার আফগান শরণার্থীকে বলপ্রয়োগে বহিষ্কার করছে। তাদের রাস্তায় ধরে, বাসে তুলে, পরিবার থেকে আলাদা করে সীমান্তে ফেলে আসা হচ্ছে।
তিনি দাবি করেন, “অনেক আফগান পরিবার একসঙ্গে ইরান ছাড়তে চাইলে ইরানি কর্তৃপক্ষ তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাড়িয়ে দিচ্ছে। ” এ ঘটনাকে তিনি ‘বর্বরতা’ হিসেবে আখ্যা দেন।
তবে, এই অভিযোগকে ইরান সরকার সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে। ইরানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অভিবাসন প্রধান নাদের ইয়ারাহমাদি জানান, “যাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে তাদের ৮০ ভাগই স্বেচ্ছায় ফিরে যাচ্ছে। যাদের হাতে বৈধ কাগজ নেই, শুধু তাদেরই ফেরত পাঠানো হচ্ছে; পরিবার বিচ্ছিন্নকরণ কিংবা বলপ্রয়োগের অভিযোগ ‘অতিরঞ্জিত’। ”
তিনি জানান, “তালেবান কর্তৃপক্ষও ফেরত প্রক্রিয়ায় উপস্থিত থাকছে, যাতে আইনি সহায়তা নিশ্চিত হয়। ”
আফগানিস্তানের ইসলাম ক্বালার উপ-কমিশনার হজরতউল্লাহ জাঈম আগা এ সম্পর্কে বলেন, “ইরান সরকার অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করছে। কোনো অপমান বা নির্যাতন ঘটছে না। ”
পেছনে ফিরে দেখা: শরণার্থীদের আগমন
ইরান ও আফগানিস্তানের মধ্যে ৯২১ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। এটি শুধু একটি ভূখণ্ডগত বিভাজন নয়—এটি ভাষা, ধর্ম, ইতিহাস ও ভাগ্যগত অভিন্নতার সেতুবন্ধও বটে। বিগত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে যুদ্ধ ও দখলদারিত্ব থেকে পালিয়ে আসা অর্ধকোটিরও বেশি আফগান নাগরিককে আশ্রয় দিয়েছে ইরান—যা এই অঞ্চলজুড়ে সবচেয়ে বড় ও দীর্ঘস্থায়ী শরণার্থী বাস্তবতা।
১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের পর লাখ লাখ আফগান নাগরিক ইরানে আশ্রয় নেন। এরপর ১৯৯৬ সালে তালেবান শাসন, ২০০১ সালে মার্কিন হামলা ও সর্বশেষ ২০২১ সালে তালেবানের ফের ক্ষমতা গ্রহণ—প্রতিটি ধাপেই আফগান জনগণের একটি বড় অংশ ইরানের দিকে ছুটে এসেছে।
দেশে ফিরে যাচ্ছেন আফগান শরণার্থীরা
শরণার্থীর প্রকৃত সংখ্যা
২০২৪ সালের প্রথমার্ধে ইরান সরকার ও জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) দেওয়া সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইরানে অবস্থানরত আফগান শরণার্থীর সংখ্যা ৬১ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে নিবন্ধিত (আইনি) শরণার্থী আনুমানিক ১৫ লাখ, ‘সেনসাস স্লিপধারী’ (আংশিক বৈধতা) প্রায় ২০ লাখ এবং সম্পূর্ণ অনিবন্ধিত/অবৈধ শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় ২৫–২৬ লাখ।
ইরান সরকার বলছে, দেশের মোট জনসংখ্যা ৯ কোটিতে পৌঁছালে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ৩% অভিবাসী গ্রহণযোগ্য (প্রায় ৩০ লাখ)। অথচ বর্তমানে ৬১ লাখ শরণার্থী অবস্থান করছে—যা এই সীমাকে দ্বিগুণেরও বেশি ছাড়িয়ে গেছে।
দায় কার?
ইরান সরকার বারবারই আফগান শরণার্থী ঢলের জন্য পশ্চিমা আগ্রাসন ও সামরিক হস্তক্ষেপকে দায়ী করে আসছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত গোলাম-হোসেইন দেহকানি বলেন, “২০০১ সালে ন্যাটোর নেতৃত্বাধীন আগ্রাসনের ফলে আফগান সমাজের অবকাঠামো ও জীবনযাত্রা ভেঙে পড়ে এবং শরণার্থীদের ঢল নামে প্রতিবেশী দেশগুলোতে। অথচ যেসব দেশ এই সংকট তৈরি করেছে, তারা সীমান্ত বন্ধ করে দেয় এবং দায় নিতে অস্বীকৃতি জানায়। ”
তিনি আরও বলেন, “এই দ্বিচারিতা—একদিকে দায়িত্ব অস্বীকার, অন্যদিকে শরণার্থীদের প্রতি কথিত সহানুভূতি—আসলে নীতিহীনতা। ”
কয়েকজন আফগান শরণার্থী
কী সুযোগ-সুবিধা পায় শরণার্থীরা?
ইরানে বসবাসরত আফগান শরণার্থীরা বহু মানবিক সুবিধা পেয়ে আসছেন।
শিক্ষা: প্রায় ৬ লাখ আফগান শিশু ইরানের সরকারি স্কুলে বিনামূল্যে শিক্ষা পাচ্ছে।
স্বাস্থ্যসেবা: সরকারি হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্রে স্থানীয় নাগরিকদের মতো সেবা পাচ্ছেন।
কর্মসংস্থান: ইরানের নির্মাণ থেকে কৃষিকাজ, রেস্টুরেন্ট থেকে কারখানা, কৃষি ও হস্তশিল্প—প্রায় সব খাতেই আফগান শ্রমিকরা কাজ করেন।
আবাসন: ৯৬% আফগান শরণার্থী শহর ও গ্রামে ইরানিদের পাশে বসবাস করছেন। তাদের অধিকাংশই স্থানীয় ইরানিদের কাছ থেকে বাসা ভাড়া নেয়। বাকি ৪% আফগান শরণার্থী জাতিসংঘ ও ইরান সরকারের যৌথ পরিচালিত ৩টি সরকারি ক্যাম্পে থাকেন।
কোভিড-১৯ টিকা: অভিবাসীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা প্রদান করা হয়েছে।
দেশে ফেরার জন্য কাগজপত্রহীন আফগানদের দীর্ঘ সারি
হঠাৎ ফেরত পাঠানো হচ্ছে কেন?
২০২৪ সালের মাঝামাঝি থেকে ইরান সরকার অবৈধ ও অনিবন্ধিত শরণার্থীদের দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া জোরদার করে। এটি মূলত নিরাপত্তাজনিত কারণে, বিশেষ করে কিছু আফগান নাগরিকের বিরুদ্ধে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের পক্ষে ড্রোন তৈরি ও গোপন অভিযান চালানোর অভিযোগ ওঠার পর।
ইরানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অভিবাসন প্রধান নাদের ইয়ারাহমাদি জানান, “যেসব শরণার্থীর বৈধ কাগজ নেই, তাদের ৫ জুলাইয়ের মধ্যে নিজ ইচ্ছায় দেশ ছাড়ার সুযোগ দেওয়া হয়। যারা সময়মতো চলে গেছে, তাদের জন্য ভবিষ্যতে পুনরায় ভিসার সুযোগ থাকবে। ”
তিনি আরও জানান, ইরানি ক্যালেন্ডার বছরের শুরু (২১ মার্চ) থেকে এখন পর্যন্ত ৭১৭,৬৫৮ জন আফগান নাগরিক ডোগহারুন, মিলাক ও দক্ষিণ খোরাসান সীমান্ত দিয়ে দেশ ত্যাগ করেছে।
শরণার্থীদের পেছনে ব্যয় কত?
ইরান দাবি করে, প্রতি বছর তারা ১০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে এই বিপুল শরণার্থী জনগোষ্ঠীর জন্য, অথচ আন্তর্জাতিক সহায়তা ‘অপর্যাপ্ত’।
২০২৪ সালের এপ্রিল–মে মাসে জাতিসংঘে নিযুক্ত ইরানি রাষ্ট্রদূত সাঈদ ইরাভানি জানান, “ইরান বছরে ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করছে দেশটিতে বসবাসকারী ৬০ লাখেরও বেশি আফগান নাগরিকের জন্য। ”
পক্ষান্তরে বছরে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক আসে ৫০–৭৫ মিলিয়ন ডলার। এ থেকে স্পষ্ট, আফগান শরণার্থীদের ভার ইরান সরকার প্রায় এককভাবে বহন করে আসছে।
সব শরণার্থী কি ফেরত যাবে?
অনেক আফগান বহু বছর ধরে ইরানে বসবাস করছেন। কেউ কেউ এখানেই জন্ম, শিক্ষা ও কর্মজীবনের সঙ্গে যুক্ত। যেমন ২২ বছর বয়সী আফগান বংশোদ্ভূত মেডিকেল শিক্ষার্থী মোরতেজা বলেন, “আমি এখানে বেড়ে উঠেছি, এখানেই কাজ করতে চাই। ইরানই আমার একমাত্র চেনা বাড়ি। ”
ইরান সরকার ঘোষণা করেছে, ২০২৫ সালের মধ্যেই দেশে অবস্থানরত প্রায় ২০ লাখ ‘সেনসাস স্লিপধারী’ আফগান শরণার্থীর ভবিষ্যৎ নির্ধারণে কার্যক্রম শুরু করা হবে। সেনসাস স্লিপধারীরা হলেন সেই সব আফগান নাগরিক, যাঁরা পূর্ববর্তী শুমারিতে অংশ নিয়ে অস্থায়ী বৈধতার একটি কাগজ পেয়েছেন। তাঁরা পুরোপুরি বৈধ শরণার্থী না হলেও সম্পূর্ণ অবৈধও নন—তাঁরা এক ধরনের অন্তর্বর্তী অবস্থায় রয়েছেন।
সরকার এই শ্রেণির শরণার্থীদের মধ্যে থেকে যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন, অপরাধে জড়িত নন এবং সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছেন—তাঁদের কিছু অংশকে স্থায়ী বসবাস বা কর্মসংস্থানের সুযোগ দেওয়ার কথা ভাবছে। অপরদিকে, যাঁদের বৈধতা নিশ্চিত নয় বা নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি রয়েছে, তাঁদের ধাপে ধাপে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে।
তবে এর মানে এই নয় যে, সব শরণার্থীকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। নিবন্ধিত শরণার্থীরা আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে থাকবেন। আবার অবৈধ অভিবাসীদের ক্ষেত্রেও মানবিক ও বাস্তবতা বিবেচনায় একাধিক ধাপে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এই প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য হলো—জনসংখ্যা ভারসাম্য বজায় রাখা, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং দীর্ঘমেয়াদে শরণার্থী নীতিকে একটি বাস্তব কাঠামোতে রূপ দেওয়া।
যদিও ইরান দীর্ঘদিন ধরে আফগান জনগণের প্রতি সহমর্মিতা ও মানবিক আচরণ দেখিয়ে এসেছে, তবে সাম্প্রতিক ফেরত পাঠানোর পদক্ষেপ নিয়ে দুই দেশের জনগণের মধ্যে কিছুটা আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। ইরানে বসবাসরত আফগানদের একাংশ মনে করছেন, দীর্ঘ সময় থাকার পরও তাদের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। অপরদিকে, তালেবান সরকারও কখনো কখনো ইরান সরকারের শরণার্থী নীতির সমালোচনা করেছে, বিশেষত ফেরত পাঠানো নিয়ে।
আফগানিস্তানের কিছু রাজনৈতিক ও সামাজিক গোষ্ঠী এই ঘটনাগুলোকে ইরান-বিরোধী আবেগ উসকে দিতে ব্যবহার করছে, যা কূটনৈতিক সম্পর্ককে কঠিন করে তুলতে পারে।
ইরান সরকার সতর্ক করে বলেছে, পশ্চিমা মিডিয়া এই ইস্যুকে ইরানবিরোধী প্রচারে ব্যবহার করছে। “যারা দুই দশক আফগানিস্তানে যুদ্ধ চালিয়ে লাখো মানুষ হত্যা করেছে, আজ তারাই আমাদের মানবিক আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ”
ভবিষ্যতের বাঁকে ইরান-আফগান সম্পর্ক
ইরান-আফগানিস্তান সম্পর্ক কেবল রাজনৈতিক নয়—এটি ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক আত্মিকতায় গাঁথা। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানদের আশ্রয় দিয়ে ইরান চার দশকেরও বেশি সময় ধরে এককভাবে যে মানবিক দায়িত্ব পালন করে এসেছে, তা বিশ্বের নজর কাড়ে। তবে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক চাপ এবং জনসংখ্যার ভারসাম্যের চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে এখন সেই নীতিতে পরিবর্তন আনার সময় এসেছে বলে ইরানিরা মনে করেন। যদি ইরান, আফগানিস্তান ও আন্তর্জাতিক সমাজ সম্মিলিতভাবে এই সমস্যা মোকাবিলায় এগিয়ে আসে, তাহলে এই অঞ্চল আবারও ভাগ্যগত অভিন্নতা ও স্থিতিশীলতার পথ খুঁজে পেতে পারে।
লেখক: ইরানে অবস্থানরত বাংলাদেশি সাংবাদিক