Image description

১৯৫৩ সালে আমেরিকার এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ইরানে এসেছিলেন একটি টাকাভর্তি স্যুটকেস নিয়ে। সেই টাকা ব্যবহার হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে সরাতে। সাত দশক পর ২০২৫ সালে, যুদ্ধশেষে ইরানি কর্মকর্তাদের ‘ব্যাগ গোছানোর’ গুজব ছড়ায় কিন্তু বাস্তবতা আজ সম্পূর্ণ ভিন্ন।

১২ দিনব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংঘাত শেষে, ২৪ জুন যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু একে ‘বড় বিজয়’ বলে দাবি করেন। তাঁদের মতে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস হয়েছে। তবে যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর সপ্তাহখানেক পেরোতেই এই দাবি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

আমেরিকার বহু সংবাদমাধ্যম সন্দেহ প্রকাশ করেছে, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো আসলেই পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে কি না। কারণ, এসব স্থাপনার অধিকাংশই পাহাড়ঘেরা গোপন ভূগর্ভস্থ এলাকায় অবস্থিত। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, শত শত কেজি সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম এখন কোথায় তা কেউ জানে না।

 

ধরা যাক, ট্রাম্প-নেতানিয়াহুর হামলায় সত্যিই ইরানের কর্মসূচি বন্ধ হয়েছে। তবুও তা দীর্ঘস্থায়ী সমাধান নয়। কারণ, ইরান চাইলে এখন আরও সহজে পারমাণবিক অস্ত্রের পথে এগোতে পারে আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থা আইএইএ’র ওপর বিশ্বাস হারিয়ে এবং দেশের অভ্যন্তরে অস্ত্র বানানোর দাবি জোরদার হওয়ায়।

 

এই যুদ্ধের মূল্য আমেরিকা ও ইসরায়েলকেও দিতে হয়েছে। ইসরায়েলের অধিকৃত এলাকার বহু শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, যা দেশটির সাধারণ জনগণের কাছে প্রথমবারের মতো যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা। এদিকে, ইরান পাল্টা হামলায় কাতারে অবস্থিত আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ আল উদেইদ ঘাঁটিতে ১২টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ে, যার ছয়টি সঠিকভাবে লক্ষ্যভেদ করে। অথচ ট্রাম্প বরাবরই এ ঘটনা অস্বীকার করেছেন।

বিশ্লেষক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বহু আগেই সতর্ক করেছিলেন ইরানের পরমাণু কর্মসূচি শুধু হামলা চালিয়ে ধ্বংস করা অসম্ভব। পাশাপাশি, নেতানিয়াহু ও ট্রাম্প জানতেন যে, ইরানের কাছে উন্নত ও প্রচুর পরিমাণ ক্ষেপণাস্ত্র আছে, যা দিয়ে মাসের পর মাস ইসরায়েলে পাল্টা আঘাত হানা সম্ভব।
তাহলে প্রশ্ন হলো তাঁরা এমন একটি যুদ্ধ কেন শুরু করলেন, যার ফলাফল আগেই জানতেন?

সিরিয়ার ছায়া ইরানে ফেলার অপচেষ্টা

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে, হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) নামে একটি জঙ্গি গোষ্ঠী সিরিয়ার রাজধানী দমাস্কাসে প্রবেশ করে, প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের দুই যুগের শাসনের ইতি ঘটায়।

দীর্ঘ এক দশক দায়েশ জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়ে সিরিয়া সুরক্ষিত রেখেছিলেন আসাদ। মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় অর্থনীতি ধ্বংস হলেও দেশ চালিয়ে গেছেন। এমনকি ২০১১ সালে আরব দেশগুলোর অবহেলার পর সম্প্রতি আবারও আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রত্যাবর্তন শুরু করেছিলেন।

তবুও, সেই সরকার আশ্চর্যজনকভাবে এক মাসে ভেঙে পড়ে। পরে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল আরব ও তুর্কি মধ্যস্থতায় সিরিয়ার সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের একাংশকে কিনে নিয়েছিল। যারা আসাদের পক্ষে ছিল, তারা পালিয়ে যায়। আসাদ এখন রাশিয়ায় অবস্থান করছেন, তাঁর বহু সাবেক কমান্ডার এখন HTS’র পক্ষে কাজ করছেন।

এই অভিজ্ঞতা মাথায় রেখেই ইসরায়েল ইরানের ক্ষেত্রে একই কৌশল প্রয়োগের স্বপ্ন দেখেছিল নেতৃত্ব নিধন। ১৩ জুন, ইরানের শীর্ষ বিজ্ঞানী ও জেনারেলদের হত্যা করার পর ইসরায়েল বহু ইরানি কর্মকর্তাকে হুমকি দিয়ে বলে তারা যেন ঘোষণা করে, ইসলামি প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে আর সম্পর্ক নেই, নতুবা পরিবারসহ মৃত্যুবরণ করবে।

‘ব্যাগ গোছানো’র নাটক ও নেতানিয়াহুর ভিডিও বার্তা

ওয়াশিংটন পোস্ট প্রকাশিত একটি ফোনালাপে শোনা যায়, এক ইরানি কর্মকর্তাকে ভিডিও বানিয়ে ইসরায়েলে পাঠাতে বলা হয়, যাতে দেখা যায় তিনি সরকার থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন।

বিভিন্ন উৎস মতে, প্রায় ২ হাজার ইরানি রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকর্তার কাছে এই বার্তা পৌঁছেছিল। পরিকল্পনাটি ছিল সিরিয়ার মতো যাতে ইরান নিজের শক্তি ব্যবহারের আগেই নেতারা পালিয়ে যায় এবং সরকার পড়ে যায়।

১৩ জুনের নেতানিয়াহুর এক ভিডিওবার্তায় ইঙ্গিত ছিল, ‘‘ইরানের শীর্ষ নেতারা ইতোমধ্যেই ব্যাগ গুছিয়ে ফেলছেন। তারা জানেন, কী আসছে।’’ পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে একটি ভিডিও যেখানে দেখা যায়, কিছু কালো গাড়ি তেহরানের মেহরাবাদ বিমানবন্দরের দিকে যাচ্ছে। একজন নারীর কণ্ঠে বলা হয়, ‘‘দেখুন, কীভাবে পালাচ্ছে তারা।’’তবে ভিডিওটি যে বানানো ও মিথ্যা, তা পরে পরিষ্কার হয়ে যায়। উদ্দেশ্য ছিল ভয় সৃষ্টি।

ইরানের দাঁড়িয়ে যাওয়া এবং ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি

অবশেষে ইরানি কর্মকর্তারা পিছু হটেননি। মাত্র ১২ ঘণ্টার মধ্যে নতুন সেনা কমান্ডার নিয়োগ হয়। সব রাজনৈতিক গোষ্ঠী একতাবদ্ধ হয়ে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির নেতৃত্বে রুখে দাঁড়ান। তিনি ঘোষণা দেন শত্রুকে হতাশ করবেন।

এই পরিণতির পর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে আসে নেতানিয়াহু ও ট্রাম্প কী ভেবে মনে করলেন, তারা ইরানে সিরিয়ার কৌশল প্রয়োগ করতে পারবেন?

উত্তর লুকিয়ে আছে ১৯৫৩ সালের সেই কুখ্যাত ইতিহাসে।

তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্টের নাতি এবং সিআইএ কর্মকর্তা কেরমিট রুজভেল্ট ইরানে আসেন একটি টাকাভর্তি স্যুটকেস নিয়ে। তিনি সেনা, গণমাধ্যম ও ধর্মীয় নেতাদের ঘুষ দেন, ভাড়া করা লোক দিয়ে দাঙ্গা বাধান, প্রোপাগান্ডা চালান সব মিলিয়ে মোসাদ্দেক সরকারকে হটিয়ে দেন।

২০২৫ সালে নেতানিয়াহুর চিন্তাভাবনায় সেই স্যুটকেস যেন ফিরে এসেছে তবে এবার সেটি ইরানিদের হাতে থাকা ব্যাগ, যেটা দিয়ে তাঁরা দেশ থেকে পালাবেন!

ইরান যে আর আগের মতো নয়, সেটা পশ্চিম আর কবে বুঝবে?আজ প্রশ্ন একটাই কেন পশ্চিমা বিশ্ব ও তাদের দীর্ঘদিনের প্রকল্প ইসরায়েল এখনও বিশ্বাস করে, ইরানকে হুমকি, প্রলোভন বা আগ্রাসনের মাধ্যমে বশ মানানো যাবে?

১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে ইরান পাল্টেছে। এখন আর তারা শুধু বেঁচে থাকার জন্য লড়ে না, তারা জানে কীভাবে টিকে থাকতে হয়, কীভাবে রুখে দিতে হয় ভিনদেশি ‘স্যুটকেসের আগ্রাসন’।