Image description

গাজার ফিলিস্তিনিরা ২০ মাসের অবরোধ, স্থানচ্যুতি ও গণহত্যার পরও যেভাবে নিজেদের ভূমিতে টিকে থাকার অদম্য ইচ্ছাশক্তি দেখাচ্ছেন, সে বিপরীতে ইসরায়েলি ইহুদিরা এখন মরিয়া হয়ে দেশ ছাড়ার পথ খুঁজছেন।

গাজায় সহায়তা বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে হামলা, ক্ষুধার্ত মানুষদের হত্যার মাধ্যমে ইসরায়েল যে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে, ঠিক সেই সময়ে ইরানের পাল্টা হামলা পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করেছে। ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিক, দ্বৈত নাগরিকত্বধারী এবং পর্যটকরা এখন দেশ ছাড়তে মরিয়া হয়ে পড়েছেন। ‘রেসকিউ ফ্লাইট’ ও ‘এস্কেপ ফ্লোটিলা’র মতো বিশেষ উদ্যোগের মাধ্যমে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন হাজার হাজার ইসরায়েলি।

তবে পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে, ইসরায়েলি সরকার সম্প্রতি একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, ফলে ইসরায়েলিদের দেশত্যাগ কার্যত নিষিদ্ধ হয়ে গেছে।

যদিও সম্প্রতি যুদ্ধের কারণে দেশত্যাগ বেড়েছে, তবে ইসরায়েলি ইহুদিদের এ প্রস্থান নতুন কিছু নয়। এর আগেই বহু ইসরায়েলি নাগরিক দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছিলেন। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম মারিভ এক প্রতিবেদনে জানায়, নতুন একটি আন্দোলনের সূচনা হয়েছে, ইসরায়েলি ইহুদিদের যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তর সহজ করার জন্য।

‘লিভিং দ্য কান্ট্রি - টুগেদার’ নামের এ সংগঠন প্রথম পর্যায়ে ১০ হাজার ইসরায়েলিকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর পরিকল্পনা করে। এই সংগঠনের নেতৃত্বে আছেন নেতানিয়াহু-বিরোধী কর্মী ইয়ানিভ গোরেলিক ও ইসরায়েলি-আমেরিকান ব্যবসায়ী মরদেখাই কাহানা। কাহানা নিজেই বলেন, আমার নিউ জার্সির একটি বিশাল খামার রয়েছে, আমি ইসরায়েলিদের সেখানে একটি কিবুতজ তৈরি করে বসবাসের প্রস্তাব দিয়েছি।

একই সময়ে, বহু ইসরায়েলি নাগরিক যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপে পাড়ি জমানোর জন্য আবেদন করে যাচ্ছেন। ৮ অক্টোবর ২০২৩ থেকে শুরু হওয়া ফিলিস্তিনে গণহত্যা ও যুদ্ধ পরিস্থিতির পরপরই ইসরায়েলি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৮২ হাজার ইসরায়েলি ইহুদি দেশ ছেড়েছেন। বেসরকারিভাবে এ সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ইসরায়েলি ডেমোগ্রাফার সার্জিও ডেলা পেরগোলার মতে, ইসরায়েল থেকে ইহুদি জনগোষ্ঠীর এ ব্যাপক প্রস্থান ‘জাতিগত সংকট’ তৈরি করছে। কারণ, ২০১০ সাল থেকেই ‘রিভার টু দ্য সি’—অর্থাৎ জর্ডান নদী থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত—ফিলিস্তিনিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।

এ পরিস্থিতি রুখতে ইসরায়েলি সরকার গত সপ্তাহে নতুন একটি নীতিমালা চালু করে। এর আওতায়, যে কোনো ইসরায়েলি নাগরিককে দেশত্যাগ করতে হলে ‘সরকারি কমিটির’ অনুমতি নিতে হবে।

বর্তমানে প্রায় ৪০ হাজার বিদেশি নাগরিক ইসরায়েলে আটকা পড়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই কানাডা, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া ও জার্মানির নাগরিক, যাদের নিজ নিজ সরকার বাস ও বিমানে করে জর্ডান ও মিসরের মাধ্যমে সরিয়ে নিচ্ছে।

তবে ইসরায়েলি নাগরিকদের বেলায় অবস্থাটা উল্টো। তারা দেশ ছাড়তে চাইলে বিমান সংস্থাগুলো টিকিট বিক্রিতে বাধা দিচ্ছে। ইসরায়েলি পরিবহনমন্ত্রী মিরি রেগেভের নেতৃত্বে এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হয়েছে।

ইসরায়েলের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক হারেৎজ লিখেছে, ইসরায়েলিরা বিপদের মধ্যে দেশে ফিরতে পারে; কিন্তু বিপদ থেকে পালাতে পারবে না।

এদিকে, হারেৎজের আরেক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বর্তমান যুদ্ধে শুরু থেকে তিনগুণ বেশি ইসরায়েলি তরুণ দেশ ছাড়তে চাচ্ছে।

ইসরায়েলিরা এখন যেভাবে দেশত্যাগে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন, তা যেন ১৯৭০ দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ইহুদিদের ইসরায়েলে আনার সময়কার প্রচারণাকে উল্টো প্রতিফলিত করছে। সেই সময় ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র একযোগে বলেছিল, ‘আমার লোকদের যেতে দাও’।

আজ, ইসরায়েলি নাগরিকদের মুখেই সেই কথা: ‘নেতানিয়াহু, আমার লোকদের যেতে দাও’।

গাজায় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। খাবার, ওষুধ, চিকিৎসা—কোনো কিছু নেই। তারপরও ফিলিস্তিনিরা নিজেদের ভূমি ছাড়ছেন না।

হারেৎজের তথ্য বলছে, অধিকাংশ গাজাবাসী আজও নিজ ভূমিতে ফেরার আকাঙ্ক্ষা ধরে রেখেছেন। ইসরায়েলের যে ধারণা ছিল, তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বা পালিয়ে যাবে, তা ব্যর্থ হয়েছে।

একদিকে ইসরায়েলিদের দেশ ছেড়ে পালাতে বাধা দিচ্ছে সরকার, অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরা মৃত্যুর মুখেও নিজেদের ভূমি ছাড়ছেন না। যুদ্ধ, গণহত্যা ও অস্তিত্বের এই লড়াইয়ে পার্থক্যটা স্পষ্ট: একটি জাতি টিকে থাকতে চায়, আর একটি রাষ্ট্র তার জনগণকে বাধ্য করছে থাকতে।

লেখক: জোসেফ মাসাদ, নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক আরব রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস বিষয়ের অধ্যাপক

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া