Image description

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানের বিরুদ্ধে "ঐতিহাসিক বিজয়" ঘোষণা করলেও একটি গোপন মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় তেহরানের পরমাণু কর্মসূচি মাত্র কয়েক মাসের জন্য বিলম্বিত হয়েছে।

১২ দিনের পাল্টাপাল্টি হামলার পর ইরান ও ইসরায়েল মঙ্গলবার এক যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছায়। এর আগের সপ্তাহান্তে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানে বাংকার-বিধ্বংসী বোমা ফেলেন এবং দাবি করেন, এতে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু কেন্দ্রগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে।

তবে একটি প্রাথমিক মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই হামলায় ইরানের পরমাণু কর্মসূচির উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়নি—শুধু কয়েক মাস পিছিয়ে গেছে।

 

হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট এই মূল্যায়নের সত্যতা স্বীকার করলেও একে “সম্পূর্ণ ভুল” বলে মন্তব্য করেন।

যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পর জাতির উদ্দেশে ভাষণে নেতানিয়াহু বলেন, “ইরান কখনোই পরমাণু অস্ত্র অর্জন করতে পারবে না। আমরা ইরানের পরমাণু প্রকল্প ব্যর্থ করেছি। যদি তারা আবার এটি পুনর্গঠনের চেষ্টা করে, আমরা একই দৃঢ়তা ও তীব্রতা নিয়ে তা প্রতিহত করব।”

গত ১৩ জুন থেকে ইসরায়েল দাবি করেছিল, তারা ইরানের পরমাণু অস্ত্র কর্মসূচি থামাতেই হামলা চালাচ্ছে। যদিও তেহরান বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তাদের বিমান হামলায় ইরানের পরমাণু কর্মসূচি "বছরখানেক পিছিয়ে" গেছে।

মঙ্গলবার যুদ্ধবিরতি ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পরই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষিপ্তভাবে ইরান ও ইসরায়েল—উভয় পক্ষকে যুদ্ধবিরতির শর্ত লঙ্ঘনের জন্য ভর্ৎসনা করেন। এরপর তেহরান জানায়, ইসরায়েল যদি চুক্তি মেনে চলে, তাহলে তারাও যুদ্ধবিরতির শর্ত মানবে। ইসরায়েলও পরে জানায়, তারা আর হামলা চালায়নি।

ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান বলেন, তার দেশ আবারও পরমাণু আলোচনায় ফিরতে আগ্রহী, তবে শান্তিপূর্ণভাবে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের অধিকার তারা বজায় রাখবে।

মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো মঙ্গলবার জানায়, মার্কিন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার (DIA) খসড়া রিপোর্ট অনুযায়ী, বোমা হামলায় ইরানের সেন্ট্রিফিউজ বা সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদ ধ্বংস হয়নি। কেবল কিছু স্থাপনার প্রবেশপথ বন্ধ হয়েছে, কিন্তু ভেতরের গোপন ভবন অক্ষত রয়ে গেছে।

এই রিপোর্ট ফাঁস হওয়ায় ক্ষুব্ধ হোয়াইট হাউজ প্রেস সেক্রেটারি বলেন, “এ ধরনের রিপোর্ট ফাঁস করা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে হেয় করা এবং সাহসী মার্কিন বৈমানিকদের অপমান করার এক প্রচেষ্টা মাত্র। তারা একদম নিখুঁতভাবে একটি দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করেছেন।”

ইরান ও ইসরায়েল বহু বছর ধরে ছায়াযুদ্ধে জড়িত থাকলেও এবারের ১২ দিনের লড়াই ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ ও ধ্বংসাত্মক। ইসরায়েলি হামলায় পরমাণু ও সামরিক স্থাপনার পাশাপাশি আবাসিক এলাকাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে বিজ্ঞানী, জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা এবং শত শত সাধারণ মানুষ নিহত হন। পাল্টা হামলায় ইরানও ইসরায়েলের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষণ করে।

পরবর্তীতে ট্রাম্পের নির্দেশে যুক্তরাষ্ট্র বাংকার-বিধ্বংসী বোমা ব্যবহার করে ইরানের গোপন পরমাণু স্থাপনায় আঘাত হানে। এই বোমা ইসরায়েলের নেই।

জবাবে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালায়। তবে ট্রাম্প এই হামলাকে "দুর্বল প্রতিক্রিয়া" বলে আখ্যা দেন এবং জানান, ইরান আগেই সতর্ক করেছিল বলে মার্কিন ও কাতারি সেনারা নিরাপদে সরে যেতে পেরেছে।

ট্রাম্প এরপর যুদ্ধবিরতির রূপরেখা ঘোষণা করেন।

ইসরায়েলি নাগরিক তেল আবিবের বাসিন্দা তামি শেল বলেন, “সবাই ক্লান্ত। আমরা একটু স্বস্তি চাই। আমাদের জন্য, ইরানিদের জন্য, ফিলিস্তিনিদের জন্য—এই পুরো অঞ্চলের জন্য।”

অন্যদিকে ইরানে অনেকেই যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চিত।

তেহরান থেকে পালিয়ে কাস্পিয়ান সাগরের উপকূলে আশ্রয় নেওয়া ২৮ বছর বয়সী আমির বলেন, “আমি জানি না এই যুদ্ধবিরতি কতদিন থাকবে... কিন্তু সত্যি বলতে, সব কিছু আগের মতো হয়ে যাবে বলে মনে হয় না।”

ইসরায়েলের হামলায় অন্তত ৬১০ জন ইরানি বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ৪,৭০০ জনের বেশি আহত হয়েছেন বলে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যুদ্ধবিরতির খবরে সতর্ক আশাবাদ প্রকাশ করেছে।

সৌদি আরব ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ট্রাম্পের ঘোষণাকে স্বাগত জানায়। রাশিয়ার মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, “আমরা আশা করি এই যুদ্ধবিরতি স্থায়ী হবে।”

তবে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সতর্ক করে দেন, ইরান গোপনে আবার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণে ঝুঁকতে পারে—এ আশঙ্কা বেড়েছে।

যুদ্ধবিরতির পর ইসরায়েলি সেনাপ্রধান আইয়াল জামির জানান, এখন তাদের লক্ষ্য আবার গাজা উপত্যকায় ফিরে যাওয়া।

ইসরায়েলি বিরোধী দল, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও বন্দি পরিবারের প্রধান সংগঠন যুদ্ধবিরতির পাশাপাশি গাজাতেও যুদ্ধ থামানোর আহ্বান জানিয়েছে।