
Sabina Ahmed(সাবিনা আহমেদ)
আমেরিকা-র B-2 স্পিরিট, যাকে স্টেলথ বোম্বার বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত স্ট্র্যাটেজিক বোম্বার। এর লো-অবজারভেবল স্টেলথ টেকনোলজি এটিকে শত্রুর রাডার-এ প্রায় অদৃশ্য করে তোলে।
B-2 স্পিরিট বানিয়েছে নর্থরপ গ্রুম্যান, সহযোগীতা করেছে বোয়িং, হিউজ ও ভট। ১৯৭৯ সালে এর ডিজাইন শুরু হয়, প্রথম টেস্ট ফ্লাইট উড়ে ১৯৮৯ সালে, এবং ১৯৯৩ থেকে এই বম্বার অপারেশনাল। এখন পর্যন্ত মোট ২১টি B-2 তৈরি হয়েছে, যার ১ টি টেস্ট এয়ারক্র্যাফট আর একটি ক্র্যাশ করার পর এখন একটিভ আছে ১৯টি।
B-2 এর প্রধান ঘাঁটি আমেরিকার মিসৌরির হোয়াইটম্যান এয়ার ফোর্স বেস, যেখানে ৫০৯থ বোম্ব উইং এগুলো পরিচালনা করে। এছাড়া নেভাল সাপোর্ট ফ্যাসিলিটি ডিয়েগো গার্সিয়া, আরএএফ ফেয়ারফোর্ড (ইউকে), এবং আরএএফ বেস টিন্ডাল (অস্ট্রেলিয়া)-তে অস্থায়ী মোতায়েন হয়।
B-2 লং-রেঞ্জ মিশন এর জন্য এয়ারিয়াল রিফুয়েলিং ব্যবহার করে। হোয়াইটম্যান থেকে গন্তব্যে যেতে একাধিক কেসি-১৩৫ বা কেসি-৪৬ ট্যাঙ্কার সহায়তা করে। ইরান আর ইয়েমেন এর মিশনে প্যাসিফিক এর উপর দিয়ে উড়ার সময় গুয়াম বা ডিয়েগো গার্সিয়াতে রিফুয়েলিং করেছে। মিশন এর দৈর্ঘ্য একটানা ৩০-৭০ ঘণ্টা হতে পারে। ২০০১ এ আফগানিস্তান মিশনে যাওয়ার রেকর্ড একটানা ৪৪ ঘণ্টা।
B-2 স্টেলথ বোম্বার শত্রু রাডারে ধরা না পরে প্রায় অদৃশ্য থাকে কারণ এর বিশেষ প্রযুক্তি এবং ডিজাইন। এর ফ্লাইং-উইং আকৃতি রাডার তরঙ্গ ছড়িয়ে দেয়, ফলে এটি ধরা পড়ে না। এছাড়া, কার্বন-ভিত্তিক কম্পোজিট উপাদান রাডার তরঙ্গ শোষণ করে। রাডার ক্রস-সেকশন (RCS) হলো একটি বস্তুর রাডারে কতটা দৃশ্যমান তা পরিমাপের একক। B-2 স্টেলথ বোম্বারের RCS মাত্র ০.১ বর্গমিটার, যার মানে এটি রাডারে খুবই কম প্রতিফলিত হয়; যা রাডারে একটি ছোট পাখির মতো প্রায় অদৃশ্য বা খুব ক্ষুদ্র লক্ষ্য হিসেবে দেখা যায়। এর ফলে শত্রু রাডারের পক্ষে B-2 শনাক্ত করা অত্যন্ত কঠিন। থার্মাল ইনসুলেশন আবরণ এবং ইঞ্জিন এক্সহস্ট ইনফ্রারেড সিগনেচার কমিয়ে রাখে।
এছড়া B-2 স্টেলথ বোম্বারে রয়েছে অত্যাধুনিক ফ্লাইট কন্ট্রোল সিস্টেম, যা নিচু উচ্চতায় (যেমন মাটির কাছাকাছি) উড়ানোর সময় বিমানকে স্থিতিশীল রাখে এবং মসৃণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে শত্রু রাডার এড়িয়ে নিচু দিয়ে উড়তে সাহায্য করে। B-2 তে চারটি শক্তিশালী ইঞ্জিন আছে, যার প্রতিটি ১৭,৩০০ পাউন্ড থ্রাস্ট (চালিকাশক্তি) উৎপন্ন করে। এই শক্তি বিমানটিকে দীর্ঘ দূরত্বে, ভারী অস্ত্র বহন করে দ্রুত ও কার্যকরভাবে উড়তে সক্ষম করে। আর উড়ার সময় ট্রান্সপন্ডার বন্ধ রেখে গোপন রুটে উড়ে, ফলে ফ্লাইটরাডার২৪ এ ধরা পড়ে না। লো ইনফ্রারেড সিগনেচার এবং কনট্রেইল সেনসর শত্রুর এয়ার ডিফেন্সকে বোকা বানায়।
তবে শত্রু পাইলট বা কোনো পর্যবেক্ষক যদি B-2 এর উড়ার সময় এর ২০ নটিক্যাল মাইল (প্রায় ৩৭ কিলোমিটার) এর মধ্যে আসে, তাহলে তারা চোখে দেখে (ভিজুয়ালি) বিমানটিকে শনাক্ত বা “ইন্টারসেপ্ট” করতে পারে। সহজ কথায়, রাডারে ধরা না পড়লেও, খুব কাছে এলে বিমানটি চোখে দেখা যেতে পারে। আর নটিক্যাল মাইলের কাছাকাছি ভিজুয়াল ইন্টারসেপশন সম্ভব।
B -2-তে ২ জনের ক্রু: একজন পাইলট (বামে) এবং একজন মিশন কমান্ডার (ডানে)। বিশেষ মিশন এর জন্য অতিরিক্ত আরও একজন ক্রু থাকতে পারে।
প্রতি মিশন-এর খরচ: প্রতি ঘণ্টা ফ্লাইটের খরচ প্রায় $১৩৫,০০০। একটি ৩০ ঘণ্টার মিশন-এর খরচ হতে পারে $৪ মিলিয়নের বেশি। এত ব্যয় বহুল এর মেইনটেন্যান্স ও ফুয়েল খরচের জন্য।
এর মেইনটেন্যান্স অত্যন্ত জটিল। প্রতি ফ্লাইটের পর B-2-এর স্টেলথ কোটিং ও সারফেস ক্ষতিগ্রস্থ হয় থেকে রক্ষায করার জন্য একে এয়ার-কন্ডিশন্ড হ্যাঙ্গারে রাখা হয়। প্রতি ৭ বছরে ক্রিস্টালাইজড হুইট স্টার্চ দিয়ে কোটিং পরিষ্কার করা হয়। এর প্রতি ফ্লাইটে ১১৯ ঘণ্টা মেইনটেন্যান্স লাগে, যার জন্য ৫০-১০০ জনের টিম কাজ করে। ওকলাহোমা সিটি এয়ার লজিস্টিক্স সেন্টার (টিঙ্কার এএফবি)-এ ডিপো মেইনটেন্যান্স হয়।
আমেরিকা ছাড়া কোনো দেশের অপারেশনাল স্টেলথ বোম্বার নেই। চায়নার জিয়ান এইচ-২০ এবং রাশিয়ার তুপোলেভ পিএকে ডিএ এখনও নির্মাণাধীন, এগুলো এখনো অপারেশনাল নয়। B-2 এখনো একমাত্র ইন-সার্ভিস স্টেলথ বোম্বার।
B-2 এর অভ্যন্তরীণ অস্ত্র বে (weapons bay) তে অস্ত্র বহন করে, যা স্টেলথ বৈশিষ্ট্য বজায় রাখে, কারণ বাহ্যিক অস্ত্র রাডার ক্রস-সেকশন বাড়ায়। এটি দীর্ঘ দূরত্বে (৬,০০০ নটিক্যাল মাইলের বেশি, রিফুয়েলিং ছাড়া) এই ভারী পে-লোড বহন করতে পারে। B-2 পারমাণবিক ও প্রচলিত বোমা, নির্ভুল ক্ষেপণাস্ত্র এবং বিশেষ অস্ত্র বহন করতে পারে। B-2 মোট ৪০,০০০ পাউন্ড (প্রায় ১৮ মেট্রিক টন) পর্যন্ত অস্ত্র বহন করতে পারে। এটি বিভিন্ন মিশনের জন্য ৮০টি ছোট বোমা বা ১৬টি বড় বোমা বহন করতে পারে।
আমেরিকার B-2 বেশ কয়েকটি যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছে:
- কসোভো ওয়ার (১৯৯৯): প্রথম ৮ সপ্তাহে ৩৩% সার্বিয়ান টার্গেট ধ্বংস, ৬৫০+ জেডিএএম ব্যবহার।
- আফগানিস্তান (২০০১): অপারেশন এন্ডিউরিং ফ্রিডম-এ ৪৪ ঘণ্টার মিশন-এ তালিবান টার্গেট ধ্বংস।
- ইরাক (২০০৩): ২২ সর্টিজ, ১.৫ মিলিয়ন পাউন্ড মিউনিশনস ব্যবহার করেছে।
- লিবিয়া (২০১১, ২০১৬): অপারেশন ওডিসি ডন ও লাইটনিং-এ স্ট্র্যাটেজিক টার্গেট ধ্বংস।
- ইয়েমেন (২০২৪): হুথি-দের ৫টি আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়েপন্স স্টোরেজ ধ্বংস, জিবিইউ-৫৭ এমওপি ব্যবহার।
- ইরান (২০২৫): ফোর্ডো, নাতানজ, এসফাহান-এ নিউক্লিয়ার সাইটস হামলা, ৬টি এমওপি ব্যবহার।
ধ্বংসের মাত্রা টার্গেটর উপর নির্ভর করে। কসোভোতে প্রিসিশন স্ট্রাইক এর কারণে সিভিলিয়ান ক্যাজুয়ালটি কম ছিল, কিন্তু ইরান এর মতো মিশনে আন্ডারগ্রাউন্ড নিউক্লিয়ার সাইটস ধ্বংসের কারণে স্ট্র্যাটেজিক ইমপ্যাক্ট বেশি। এখন পর্যন্ত কোনো B-2 শত্রুর হাতে ধ্বংস বা ডিটেকশন হয়নি।
বি-২ এর স্টেলথ প্রযুক্তি আমেরিকার নিরাপত্তার অন্যতম মূল চাবিকাঠি। প্রতিটি বিমানিয়ার দাম ২.১ বিলিয়ন ডলার। প্রযুক্তি ফাঁসের ঝুঁকি থেকে এই বোম্বারকে আজ পর্যন্ত আমেরিকা অন্য কোনও দেশে বিক্রি কিংবা হস্তান্তর করেনি। ইজরায়েলকেও না। আমেরিকা শুধু নিজ বেইস থেকে এটি পরিচালনা করে।
B-2 স্পিরিট আমেরিকার এয়ার সুপিরিয়রিটির প্রতীক। এটা একই সাথে একটা বিউটি আর ভয়ঙ্কর ফাইটিং মেশিন। আমেরিকার ওয়েপন সিস্টেম যে কি পরিমাণ উন্নত আর ভয়ঙ্কর তার সম্পর্কে বহির্বিশ্বের জনগণের ধারণা খুব সীমিত।
আর এই সীমিত ধারণার কারণেই মানুষ পিস টাইমে শান্তিতে ঘুমায়, আর যুদ্ধের সময় শুরু হয় নাইট মেয়ার। আল্লাহ সবাইকে শান্তিতে রাখুক, এই কামনা করছি।
ছবিটা ইউএসএ টুডে থেকে নেয়া।