
দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ। কোনো পক্ষই কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। এদিকে ভয়াবহ এই সংঘাতের লাগাম টানতে ইরানকে সমঝোতায় আনতে মরিয়া ইসরাইলের সহযোগীরা। তবে ইরান সাফ জানিয়েছে, ইসরাইলের নিঃশর্ত সমাপ্তি ব্যতীত এই যুদ্ধের ইতি টানা সম্ভব নয়। শুক্রবার এক্সের এক পোস্টে এ কথা জানান দেশটির প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান। বলেছেন, ইসরাইলের নিঃশর্ত সমাপ্তিই এই সংঘাতের অবসান ঘটাতে পারে। যদি এমনটা না হয় তাহলে ইসরাইলে হামলা অব্যাহত থাকবে। কার্যত এই হুঁশিয়ারির মাধ্যমে ইসরাইলকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের কথা বলেছে ইরান। এদিকে ইরানে হামলার বিষয়ে দুই সপ্তাহের সময় নিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প।
তাকে উদ্ধৃত করে এ তথ্য জানান হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট। বলেছেন, ইরানের সঙ্গে আলোচনা হওয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনা সামনে রয়েছে- যা হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। ইরানের সঙ্গে হামলায় জড়াবে কিনা তা আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেবেন ট্রাম্প। এদিকে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচির সঙ্গে বৈঠক করেছেন ফ্রান্স, জার্মানি ও বৃটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। এতে প্রাথমিক আলোচনা থেকে কোনো সমঝোতার আভাস পাওয়া যায়নি। ইরান-ইসরাইল পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছে।
এদিকে শুক্রবার ইসরাইলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তেহরানের রাস্তায় নামে লাখ লাখ মানুষ। অন্যদিকে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ও শুক্রবার দিনভর হামলা-পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইরান-ইসরাইল। কোনো পক্ষই ছাড় দেয়নি। তবে এদিন ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলে ইরানের ভয়াবহ হামলা পরিলক্ষিত হয়েছে। ইরানের হামলায় হাইফায় ১৭ ইসরাইলি নিহত হন। যাদের তিনজনের অবস্থা ছিল আশঙ্কাজনক। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার খবরে বলা হয়েছে, ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর বিয়েরশেভায় একাধিক ভবনের বহু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগুনে পুড়ে ভস্ম হয়েছে একাধিক জানবাহন। এছাড়া ইরানের ছোড়া একটি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে প্রধান একটি সড়কে বিশাল গর্ত দেখা গেছে। এছাড়া ইসরাইলের বিরসেবা শহরের সামরিক গোয়েন্দা ঘাঁটিতে নিখুঁত হামলার দাবি করেছে ইরান। অন্যদিকে ইরানেও ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। দেশটির গণমাধ্যম জানিয়েছে এই হামলায় ইরানের আরেক পরমাণুবিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। যদিও এই খবরের সত্যতা নিরপেক্ষ কোনো সূত্র নিশ্চিত করতে পারেনি। আবারও ইরানে হামলা জোরদারের নির্দেশ দিয়েছেন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাৎজ। অন্যদিকে ইরান-ইসরাইল সংঘাতে তৃতীয় কোনো পক্ষ জড়ালে এর পরিণতি ভয়াবহ হবে হুঁশিয়ারি দিয়েছে তেহরান।
জেনেভায় ইইউ মন্ত্রীদের সঙ্গে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক: ইরান-ইসরাইল সংঘাতের সমাধান পেতে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ইউরোপীয় কূটনীতিক এবং বৃটেন, জার্মানি ও ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি। তেহরানের সঙ্গে তেল আবিবের সংঘাতের পর এবারই প্রথম পশ্চিমাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন তিনি। এই বৈঠকে বৃটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামিও উপস্থিত ছিলেন। কূটনৈতিক সমাধান পেতে ইরানের সঙ্গে বসাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিহিত করেন তিনি। বৈঠকে আরাঘচি বলেন, চলমান কূটনৈতিক আলোচনার মধ্যেই ইরানের ওপর হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে তারা। এমন অবস্থায় এখনই কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে জোর দেন আরাঘচি। অন্যথায় জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক আইন খুব খারাপভাবে ব্যাহত হবে। এটি এমন একজনের আহ্বান যিনি তার পুরো জীবন সংলাপ ও কূটনীতির জন্য উৎসর্গ করেছেন। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, যিনি (ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের) চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের মোকাবিলা করা অভিজ্ঞ সৈনিক এবং তিনি জানেন কীভাবে নিজ মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে হয়। বিবিসি জানিয়েছে, বৈঠক শুরু হওয়ার পরপরই উভয়পক্ষের মধ্যে মতানৈক্য শুরু হয়েছে বলে মনে হয়েছে। ইসরাইল জানিয়েছে তারা এখনো ইরানে তাদের সকল লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। তারা ইরানে হামলা অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছে। এদিকে ইরান জানিয়েছে শান্তিপূর্ণভাবে পারমাণবিক শক্তি বিকাশের সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে তাদের। তবে ইসরাইল এটা মানতে নারাজ। তারা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে। এই বৈঠকের মাঝেই ইরানের ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
ইরানি প্রেসিডেন্টের হুঁশিয়ারি: শুক্রবার এক্সের এক পোস্টে মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেছেন, আমরা সবসময়ই শান্তি এবং শান্ত থাকার পক্ষে আছি। তবে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ বন্ধের একমাত্র উপায় হচ্ছে ইসরাইলের নিঃশর্ত সমাপ্তি। চিরতরে ইহুদিবাদীদের শত্রুভাবাপন্ন এমন হামলা বন্ধের নিশ্চয়তা দিতে হবে। ইসরাইলি আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেন, তারা আগ্রাসন অব্যাহত রাখলে এই যুদ্ধ বন্ধ হবে না। বরং ইরান আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে, যার ফলে হামলাকারীদের ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে।
ইরানে হামলা নিয়ে দুই সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেবেন ট্রাম্প: হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বক্তব্য রাখেন। বক্তব্য শুরুর পর, তিনি চলে আসেন ইসরাইল ও ইরানের চলমান সংঘাতে। তিনি বলেন, আমি জানি প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত নিয়ে এবং যুক্তরাষ্ট্র এ সংঘাতে জড়াবে কিনা- সে বিষয়ে অনেক জল্পনা চলছে। এরপর তিনি প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের একটি সরাসরি উদ্ধৃতি পড়ে শোনান। তাতে বলা হয়- ইরানের সঙ্গে আলোচনা হওয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনা সামনে রয়েছে- যা হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে আমি আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেবো, আমরা এতে যাবো কিনা।
‘যুক্তরাষ্ট্র যুুদ্ধে যোগ দিলে পুরো অঞ্চলে নরক ডেকে আনবে’: এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে বলে সতর্ক করেছে ইরান। দেশটির উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাঈদ খাতিবজাদে বলেছেন, ইসরাইলের হামলায় যুক্তরাষ্ট্র যদি সরাসরি জড়িয়ে পড়ে, তাহলে তা পুরো অঞ্চলের জন্য নরক ডেকে আনবে। তিনি বলেন, এটা আমেরিকার যুদ্ধ নয়। যদি প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প এই যুদ্ধে জড়ান, তাহলে ইতিহাসে তিনি একজন ‘অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত হবেন। খাতিবজাদে সতর্ক করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা এই সংঘাতকে একটি দীর্ঘস্থায়ী জঞ্জালে পরিণত করবে, আগ্রাসনকে আরও বাড়াবে এবং নৃশংসতা বন্ধের পথকে দীর্ঘায়িত করবে।
মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে এরদোগান-মের্জের ফোনালাপ: ইরান-ইসরাইল সংঘাতের মধ্যে প্রথমবারের মতো ফোনে কথা বলেছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান এবং জার্মানির চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্জ। উভয় নেতাই এই সংঘাত নিরসনে কূটনৈতিক সমাধানের ওপর জোর দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন জার্মান সরকারের এক মুখপাত্র। তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্য সংকট নিরসনে কূটনৈতিক সমাধানে সহযোগিতার ওপর জোর দিয়েছে উভয় দেশ। বার্তা সংস্থা আনাদোলু জানিয়েছে, জার্মান সরকারের চিফ অব স্টাফ থর্স্টেন বলেছেন, যদিও ইরানের সঙ্গে যেকোনো চুক্তির মুহূর্ত ভালো নয়। তবে চলমান পরিস্থিতিতে এটা গুরুত্বপূর্ণ। এদিকে জার্মান সরকারকে তুর্কি প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ইসরাইলের ক্রমাগত হামলায় ইরানের পরমাণু কেন্দ্রগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা থেকে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়তে পারে। যাতে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে।