Image description
 

কখনো নিঃশর্ত সমর্থন, কখনো রাজনীতি, কখনো বা সামরিক সহায়তা। সবকিছু মিলিয়ে এক বিশেষ সম্পর্ক ইসরায়েল আর যুক্তরাষ্ট্রের। শুধু গত এক বছরের হিসাব করলেই দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র ১৮ বিলিয়ন ডলার মিলিটারি সহায়তা দিয়েছে ইসরায়েলকে। আর এমন উদাহরণ পৃথিবীর ইতিহাসে নেই।

এ দুই দেশের সম্পর্ককে অনেকেই বলেন নিঃস্বার্থ বন্ধুত্ব, আবার কেউ বলেন, ঠান্ডা মাথার কৌশলগত জোট। কখনও নিঃশর্ত সামরিক সহায়তা, কখনও আন্তর্জাতিক ফোরামে একে অপরের হয়ে সাফাই গাওয়া, আবার কখনও বিতর্কিত সিদ্ধান্তেও একে অপরের পক্ষে অবস্থান। সব মিলিয়ে এক ‘বিশেষ’ সম্পর্ক দুদেশের।

এ সম্পর্ক যেন কূটনীতির বাইরে গিয়েও এক দীর্ঘ ভালোবাসার গল্প! কিন্তু এ বন্ধুত্ব কি শুধুই নীতিনিষ্ঠ? নাকি এর পেছনে আছে কঠিন ভূরাজনীতি, কৌশল আর স্বার্থের হিসাব?

এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে ফিরে তাকাতে হবে এ দুদেশের ইতিহাসের দিকে। ইসরায়েল রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পর থেকে কীভাবে ধাপে ধাপে যুক্তরাষ্ট্র তার সবচেয়ে বড় মিত্র হয়ে উঠল চলুন জেনে নেই সেই গল্প।

এ সম্পর্কের শুরুটা কোথা থেকে কীভাবে গড়েছে, কীভাবে তা এত দৃঢ় হলো, আর আজকের জটিল বিশ্বরাজনীতিতে এ সম্পর্কের অর্থই বা কী- সেই গল্প নিয়েই আজকের এ লেখা।

স্বীকৃতি দিয়েই শুরু

ইসরায়েল নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করেন ১৯৪৮ সালের ১৪ মে। যেদিন ইসরায়েল নিজেকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করল, ঠিক সেদিনই প্রথম যে দেশটি তাদের স্বীকৃতি দিয়েছিল, সেটা যুক্তরাষ্ট্র। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান নিজে ঘোষণা করেন, ‘আমরা এ নতুন ইহুদি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিচ্ছি।’

এ ঘোষণার পেছনে ছিল অনেক লবিং, জায়নিস্ট আন্দোলনের চাপ এবং ঠান্ডা যুদ্ধের ভূরাজনৈতিক হিসাব। তবে আসল কথা হলো নিজেকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করার ১১ মিনিটের মাঝেই যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি পায় এ দেশ। আর আড়াই দিন পর পায় রাশিয়ার স্বীকৃতি, যা তখনকার জন্য ছিল অবাক করার মতো ঘটনা।

তবে এ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের একটি সাক্ষাৎকারে উঠে আসে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়ার কারণ-

স্ট্র্যাটেজিক বেট ইসরায়েল

১৯৫০-এর দশকে, বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন বনাম যুক্তরাষ্ট্র। মধ্যপ্রাচ্য তখন এক বিশাল গেমবোর্ড। আমেরিকা বুঝে গেল, যদি তারা ইসরায়েলকে পাশে না রাখে, তাহলে রাশিয়া সকল আরব দেশগুলোকে নিজ পক্ষে নিয়ে খেলতে পারে। আর এ সময় থেকেই শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিক ‘বেট’- ইসরায়েল।

সাহায্যের ঢল নামে

১৯৬০-র পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ট্যাক্সদাতাদের ডলার ইসরায়েলের দিকে এমনভাবে গড়াতে থাকে, যেন সেটা দ্বিতীয় কোনো আমেরিকান স্টেট! আজকের দিনে প্রতি বছর প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার সামরিক সাহায্য পায় ইসরায়েল। এটা শুধু বন্ধুত্ব নয়, এটা একটা ইনভেস্টমেন্ট। মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এক মোক্ষম হাতিয়ার।

ছয় দিনের যুদ্ধে সাত সাগরের নজর

১৯৬৭ সালে ইসরায়েল যখন মাত্র ছয় দিনে মিশর, জর্ডান আর সিরিয়াকে হারিয়ে দেয়, তখন সারা বিশ্ব অবাক হয়ে দেখে এক ক্ষুদ্র দেশের এত সামরিক দক্ষতা! কিন্তু তখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে কোনো ধরনের সাহায্য অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছিল না। তবুও জিতে যায় ইসরায়েল।

আর এ যুদ্ধই যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝিয়ে দেয় যে, ইসরায়েল কেবল বন্ধু নয় বরং একটি ‘স্ট্র্যাটেজিক অ্যাসেট’। আর এ সময়ের পর থেকেই ফ্রান্সকে বাদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের থেকে অস্ত্র কেনা শুরু করে ইসরায়েল।

 

যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের কাছে আসার গল্প
গিভ অ্যান্ড টেক

 

এরপর ১৯৭৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল ও ইজিপ্টের সঙ্গে একটি চুক্তিতে আসে। যাতে উল্লেখ থাকে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে বছরে ৩ বিলিয়ন ডলার ও ইজিপ্টকে বছরে ২ বিলিয়ন ডলার করে দিবে। এ সময়ই শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলকে সরাসরি আর্থিক সহায়তার ঘটনা।

এ দুটি দেশ ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসে নিজেদের মধ্যে একটি শুল্কমুক্ত বাণিজ্যিক সমঝোতা চুক্তি সই করে। মজার বিষয় হলো এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম শুল্কমুক্ত বাণিজ্যিক সমঝোতা। এমনকি খেয়াল করলে দেখে থাকবেন এ বছরের শুরুতে যখন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সকল দেশের ওপরই ভারি শুল্ক আরোপে ব্যস্ত, তখনও সেই তালিকায় ছিল না ইসরায়েলের নাম।

এ চুক্তি থেকে যে যুক্তরাষ্ট্রও কোনো উপকার পায়নি বিষয়টি তেমন না। সে সময় ইসরায়েল তিনটি বিষয়ে এগিয়ে ছিল। তাদের ইন্টেলিজেন্স (মোসাদ), আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম ও উন্নত প্রযুক্তি। শুল্কমুক্ত বাণিজ্যিক সমঝোতা চুক্তির ফলে ইসরায়েল থেকে তিনটি উপকারই নিচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং এতে তাদের বিশাল কর্মসংস্থান তৈরি হয়।

মিডিয়ার প্রেম

আপনি যদি ১৯৭০–৮০ দশকের হলিউড সিনেমাগুলো দেখেন, খেয়াল করবেন ইসরায়েলি চরিত্ররা বেশিরভাগ সময়ই হিরো। অন্যদিকে, আরব দেশগুলো দেখানো হয় নেতিবাচক চরিত্রে।

এর মাধ্যমে গড়ে ওঠে জনমতের সহানুভূতি ‘ইসরায়েল ইজ দ্য গুড গাই’। দীর্ঘ সময় ধরে প্রচারিত এ ধারণাটি গেঁথে যায় সাধারণ আমেরিকানদের মনে।

বর্তমানের জটিল বাস্তবতা

বর্তমানে যদিও যুক্তরাষ্ট্র- ইসরায়েল সম্পর্ক মজবুত, তবে ভেতরে ভেতরে চিড়ও ধরেছে। ইসরায়েলের নেতানিয়াহু সরকার, পশ্চিম তীরে বসতি সম্প্রসারণ, গাজায় সহিংসতা এবং আদালত সংস্কার ইস্যুতে মার্কিন ডেমোক্রেটদের মধ্যে প্রশ্ন উঠছে- ‘যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের এ ভালোবাসা কি এখনও আগের মতোই মূল্যবান?’

বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ প্রজন্ম, যারা সোশ্যাল মিডিয়া দেখে বড় হয়েছে, তারা অনেকেই এখন ফিলিস্তিনের পাশে। এটা ভবিষ্যতে মার্কিন নীতিতে বড় পরিবর্তন আনতে পারে বলেও ধারণা করছেন অনেকেই।

 

আমেরিকা আর ইসরায়েলের এ সম্পর্ক অনেকটা প্রেমের মতো হলেও মোটেও প্রেমটা আদর্শিক নয়। বরং এটা একটি কৌশলগত, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমঝোতা, যার শুরু ১৯৪৮-এ, কিন্তু যার পরিণতি এখনও অনিশ্চিত।