
গত শুক্রবার (১৩ জুন) ভোরে ইসরাইলের আক্রমণ শুরু হওয়ার পরপরই পুতিন ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান এবং ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু উভয়ের সাথেই কথা বলেন বলে জানায় ক্রেমলিন।
ক্রেমলিনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতি অনুযায়ী, রুশ নেতা ‘ইসরাইলি হামলায় অসংখ্য হতাহতের ঘটনায় ইরানের নেতৃত্ব ও জনগণের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন এবং জোর দিয়ে বলেন, রাশিয়া জাতিসংঘের সনদ ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ইসরাইলের কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানায়।’
পরদিন নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ মিত্র মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে ফোনে কথা বলার সময় পুতিন আবারও ইসরাইলের সামরিক আগ্রাসনের নিন্দা জানান। পুতিনের এ তৎপরতা প্রমাণ করে ইরানের সাথে রাশিয়ার গভীরতর মিত্রতা রয়েছে।
তবে ইসরাইলি আগ্রাসনের মুখে মস্কোর তার কৌশলগত অংশীদারকে সামরিক সহায়তা দেয়ার সম্ভাবনা কম বলেই মনে হচ্ছে। অন্তত সামরিক সহায়তা দেয়ার প্রশ্নে রুশ প্রেসিডেন্টের সবশেষ বক্তব্য থেকে সেটা স্পষ্ট।
বুধবার (১৮ জুন) সেন্ট পিটার্সবার্গে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠকে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাশিয়া কারও ওপর কোনোকিছু চাপিয়ে দিচ্ছে না। ইরানের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো সহযোগিতা চাওয়া হয়নি।
তেহরানের সাথে মস্কোর সুবর্ণ চুক্তি
রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্কের প্রেক্ষিতে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের উপর আক্রমণের কারণে পুতিনের ইসরাইলকে তিরস্কার করায় অবাক হওয়ার কিছু নেই।
ইরান দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ অংশীদার, বিশেষ করে যখন থেকে পশ্চিমা দেশগুলো উভয় দেশের উপর কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে শুরু করে।
ইরান সম্প্রতি বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক জোট ব্রিকসে যোগ দিয়েছে। জোটটি মূলত পশ্চিমাবিরোধী উদীয়মান অর্থনীতির কয়েকটি দেশ নিয়ে গঠিত যার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে রাশিয়া।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে পূর্ণ মাত্রায় আক্রমণ শুরু করার পর মস্কো-তেহরান সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়। পশ্চিমারা রাশিয়াকে সামরিক ড্রোন সরবরাহ করার অভিযোগে ইরানকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়।
মিডিয়া রিপোর্ট অনুসারে, মস্কো সম্ভবত ইরানি কোম্পানি সাহারা থান্ডারকে কমপক্ষে ১.৮ টন সোনার বার দিয়ে ড্রোনগুলোর অর্থ পরিশোধ করেছে। এছাড়া ইরান রাশিয়াকে তার পারমাণবিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়তা চেয়ে থাকতে পারে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, মস্কো এমন একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হারাতে চাইবে না। মিশরের মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক রুসলান সুলেমানভ যেমনটা বলছেন। তার কথায়, ‘ক্রেমলিন কুরআনের পুরনো একটি নীতি অনুসারে কাজ করছে: ‘লড়াই কর এবং যুদ্ধ কর, কিন্তু সীমালঙ্ঘন কর না।’
‘অন্য কথায়, মস্কো, যার মধ্যপ্রাচ্যে নিজস্ব স্বার্থ ও উপস্থিতি রয়েছে, তারা এই অঞ্চলে যেকোনো ধরণের অনিয়ন্ত্রিত বিশৃঙ্খলা এড়াতে চাইবে,’ যোগ করেন সুলেমানভ।
ইরানকে রাশিয়ার সামরিক সহায়তা দেয়ার সম্ভাবনা কেন কম?
ইরানে ইসরাইলের আক্রমণ শুরু হওয়ার পর ইরানের পার্লামেন্ট রাশিয়ার সাথে ব্যাপক কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি অনুমোদন করে। চুক্তিটি প্রাথমিকভাবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইরানি প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের মস্কো সফরকালে সই হয়। উভয় দেশের প্রেসিডেন্টই তাতে স্বাক্ষর করেন এবং এখন থেকে দুই মাস আগে রাশিয়ার পার্লামেন্টে এটি অনুমোদিত হয়।
উচ্চাভিলাষী নাম থাকা সত্ত্বেও চুক্তিটি পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এতে দুই দেশের কোনো একটি আক্রান্ত হলে একজন অপরকে সামরিক সহায়তা প্রদান করবে এমনটা বলা হয়নি। বরং একটি দেশ আক্রান্ত হলেও অন্য দেশ শত্রুপক্ষকে সহায়তা করা থেকে বিরত থাকবে এমন প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।
এই চুক্তি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক মারিয়ানা বেলাঙ্কায়া, যিনি ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রাশিয়া ছেড়ে এখন ইসরাইলে বসবাস করছেন, মনে করেন, মস্কো ইরানকে সরাসরি সামরিক সহায়তা দেবে এমন সম্ভাবনা খুবই কম।
বেলাঙ্কায়া মনে করেন, ‘এর কোনো প্রয়োজন নেই, বিশেষ করে যখন তারা ওয়াশিংটনের সাথে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার বা উন্নত করার চেষ্টা করছে। যদিও পর্দার আড়ালে কিছু থাকার সম্ভাবনা সম্পূর্ণভাবে উড়িয়ে দেয়া যায় না।’
ডয়চে ভেলের বিশ্লেষণ