
প্রতি একজন ইসরায়েলির মৃত্যুর জন্য বিবিসি ফিলিস্তিনিদের তুলনায় ৩৩গুণ বেশি কাভারেজ দিয়েছে বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে। বিবিসির ৩৫ হাজারেরও বেশি সংবাদ ও কনটেন্ট পর্যবেক্ষণ করে এ ফলাফল পেয়েছে সেন্টার ফর মিডিয়া মনিটরিং (CfMM)। গাজার ওপর ইসরায়েলের গণহত্যামূলক যুদ্ধে বিবিসির সংবাদ কাভারেজে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড পক্ষপাতিত্ব রয়েছে এবং এটি নিরপেক্ষতার মানদণ্ড রক্ষা করতে পারেনি বলে দাবি করেছে তারা।
গবেষণার ফলাফলে দেখা গিয়েছে ব্রডকাস্ট এবং অনলাইন, দুই জায়গাতেই এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের উদাহরণ পাওয়া গেছে। বিবিসির কনটেন্টগুলোতে বারবার ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলিদের গণহত্যার অভিযোগও খারিজ করা হয়েছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ৬ অক্টোবর পর্যন্ত বিবিসির ৩,৮৭৩টি অনলাইন আর্টিকেল এবং ৩২,০৯২টি টিভি সেগমেন্ট বিশ্লেষণ করেছে CfMM। একইসাথে ইউক্রেন যুদ্ধ সংক্রান্ত ৭,৭৪৮টি আর্টিকেলের তুলনামূলক বিশ্লেষণ চালিয়েছে তারা। এই ১২ মাসে ৪২,০১০ জন ফিলিস্তিনি এবং ১,২৪৬ জন ইসরায়েলি নিহত হয়েছেন; অনুপাত হিসেবে এ হিসাব ৩৪:১।
CfMM-এর গবেষণায় উঠে এসেছে, বিবিসি brutal, atrocities, slaughter, barbaric, deadly–এর মতো শব্দগুলো ইসরায়েলি ভুক্তভোগীদের ক্ষেত্রে চারগুণ বেশি ব্যবহার করেছে। massacre শব্দটি ইসরায়েলিদের জন্য ১৮ গুণ বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। ইসরায়েলিদের ক্ষেত্রে ২২০ বার murder বলা হয়েছে, যেখানে ফিলিস্তিনিদের জন্য বলা হয়েছে মাত্র একবার। butchered, butcher এবং butchering-এর মতো শব্দগুলো কেবল ইসরায়েলিদের জন্যই ব্যবহৃত হয়েছে।
গাজায় মৃত্যুর সংখ্যা ৩৪ গুণ বেশি হওয়া সত্ত্বেও বিবিসি দুই পক্ষের প্রোফাইল সংবাদগুলো প্রায় সমান সংখ্যায় প্রকাশ করেছে। তাছাড়া তারা প্রায় প্রতিবারই ফিলিস্তিনি মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখ করার সময় সূত্র হিসেবে ‘হামাস-চালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়’ উল্লেখ করেছে।
বিবিসি তাদের রিপোর্টিংয়ে ঐতিহাসিক ও সমসাময়িক প্রেক্ষাপটও উপেক্ষা করেছে এবং CfMM-এর দাবি অনুযায়ী, এটি বিবিসির একটি ‘প্রাতিষ্ঠানিক’ প্রবণতা।
বিবিসির অনলাইন কনটেন্টের অন্তত ৪০ শতাংশে ৭ অক্টোবরের হামলার ঘটনা উল্লেখ ছিল, কিন্তু এর আগের দশক দশক ধরে চলা ইসরায়েলিদের সহিংসতা ও দখল বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র ০.৫ শতাংশ নিবন্ধে।
৭ অক্টোবর প্রসঙ্গে occupation ০.৩%, blockade ০.০৮%, এবং settlement শব্দটি ০.০৩% রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। টিভি এবং রেডিওতেও একই প্রবণতা দেখা গেছে। ‘দাহিয়া ডকট্রিন’ (যুদ্ধের অংশ হিসেবে বেসামরিক অবকাঠামো ধ্বংস করা) বা ‘হ্যানিব্যাল ডিরেকটিভ’ (আইডিএফ সদস্যকে বন্দি না হতে দেওয়ার জন্য হত্যা করার অনুমোদন)-এর মতো ইসরায়েলি সামরিক নীতিমালার কোনোকিছুই বিবিসির প্রতিবেদনে উপস্থিত ছিল না।
এছাড়াও ৭ অক্টোবর হামলা নিয়ে বিবিসি ৩৮ জন সাক্ষাৎকারদাতাকে হামাসের নিন্দা করার ব্যাপারে প্রশ্ন করলেও ইসরায়েলের হামলা নিয়ে কাউকে প্রশ্ন করা হয়নি।
CfMM আরও দেখতে পায় যে গাজা ও ইউক্রেন যুদ্ধের কাভারেজে বিবিসির আচরণে প্রবল দ্বিমুখী আচরণ করেছে। বিবিসির প্রতিবেদনগুলোতে ইউক্রেনে ঘটা যুদ্ধাপরাধের কথা গাজার তুলনায় ২.৬ গুণ বেশিবার বলেছে। ইসরায়েলিদের সামরিক অভিযানের যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়েছে ৭৫% কেসে, যেখানে রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি ১৭%।
ইউক্রেনে নিহত সাংবাদিকদের ৬২ শতাংশের ওপর বিবিসি রিপোর্ট করেছে, যেখানে গাজার ক্ষেত্রে মাত্র ৬ শতাংশ নিহত সাংবাদিকদেরকে নিয়ে প্রতিবেদন করা হয়েছে। গাজায় অন্তত ২৩২ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, যা প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভিয়েতনাম, যুগোশ্লাভিয়া ও আফগানিস্তান যুদ্ধের সম্মিলিত সাংবাদিক মৃত্যুর চেয়েও বেশি। সাংবাদিকদের জন্য গাজা এখন বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান।
বিবিসির আরেকটি ডাবল স্ট্যান্ডার্ড প্রকাশ পায় ‘আটক ব্যক্তিদের’ বিবরণে। ফিলিস্তিনিদেরকে ‘prisoner’ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও হামাসের হাতে আটক ইসরায়েলিদের উল্লেখ করা হয়েছে ‘hostage’ হিসেবে। এমনকি বিনা অভিযোগে আটক ফিলিস্তিনিদেরকেও কখনোই ‘hostage’ বলা হয়নি একবার ছাড়া, সেটিও পরে সরিয়ে ফেলা হয়।
বিনা অভিযোগে ফিলিস্তিনিদেরকে আটক করার নীতি ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ডিটেনশন’ উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র ৬টি প্রতিবেদনে। বর্তমানে ইসরায়েল ১০,০০০-এরও বেশি ফিলিস্তিনিকে বন্দি করে রেখেছে, যাদের মধ্যে ৩,৫০০ জনের বিরুদ্ধেই কোনো অভিযোগ নেই এবং এদের মধ্যে ৪০০ জনের বেশি শিশু।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে বন্দি বিনিময়ের সময় ৯০ জন ফিলিস্তিনি মুক্তির বিপরীতে মাত্র ৩ জন ইসরায়েলি মুক্তি পায়। তবুও বিবিসির ৭০ শতাংশ রিপোর্ট ইসরায়েলিদের ওপর কেন্দ্রীভূত ছিল। বিবিসি টিভি ও রেডিওতে ইসরায়েলিদেরকে নিয়ে মানবিক গল্প প্রচার করলেও ফিলিস্তিনিদের কোনো নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি এবং তাদের নিয়ে সেই মানবিক গল্পগুলোও প্রচার করেনি।
মূল: হ্যারিয়েট উইলিয়ামসন | নোভারা মিডিয়া