
দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক কতটা শত্রুতাপূর্ণ হতে পারে, তার অন্যতম উদাহরণ ইসরায়েল ও ইরান। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশ দুটির মধ্যে চলেছে সংঘাত।
কখনো মধ্যপ্রাচ্যের আকাশ, আবার কখনো সাগরের জলরাশি, আবার কখনো বা সাইবার জগত হয়ে উঠেছে এই সংঘাতের মঞ্চ।
ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের গুপ্তহত্যা, গোপন অভিযান কিংবা সরাসরি হামলার ঘূর্ণিতে বারবার টালমাটাল হয়েছে গোটা অঞ্চল। আর পেছন থেকে ইন্ধন দিয়েছে বিশ্ব পরাশক্তিগুলো। তাদের অস্ত্র, পাশে থাকার অঙ্গীকার কিংবা গোপনে সহায়তায় দুই দেশের মধ্যে বিরোধের পারদ বাড়তে বাড়তে কখনো কখনো উপচেও পড়েছে।
দীর্ঘ এই সংঘাতের নতুন অধ্যায় শুরু হয় চলতি বছরের ১৩ জুন। এদিন ইসরায়েল ভয়াবহ বিমান হামলা চালায় ইরানের রাজধানী তেহরানে। সেদিন ড্রোন ও যুদ্ধবিমান দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনা। নিহত হন ইরানের শীর্ষ বিজ্ঞানী ও জেনারেলরা।
পরদিন থেকে ইরানের জ্বালানি অবকাঠামোর ওপর হামলা শুরু করে ইসরায়েল। পাল্টা জবাবে ইরান ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ছুড়ে ইসরায়েল আক্রমণ চালাতে থাকে। ১৫ জুন পর্যন্ত চলতে থাকা হামলা-পাল্টা হামলায় দুই দেশের মধ্যে রীতিমতো যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এখন দুই দেশেই সামরিক স্থাপনার পাশাপাশি আক্রান্ত হচ্ছে বেসামরিক এলাকা।
এই উত্তপ্ত পরিস্থিতি হঠাৎ সৃষ্টি হয়নি। এর শিকড় অনেক গভীরে।
১৯৭৯ সালের আগে এই দুই দেশ ছিল মিত্র। ওই বছর ইরানে ইসলামী বিপ্লব ঘটে এবং একটি ধর্মীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়, যা আদর্শগতভাবে ইসরায়েলের অস্তিত্বের বিরোধিতা করে। এরও আগে ১৯৬৭ সালে আমেরিকার অ্যাটমস ফর পিস কর্মসূচির অধীনে ইরান তেহরান রিসার্চ রিয়্যাক্টরের মালিকানা নেয়।
ইসলামী বিপ্লবের পর তৎকালীন শাসক শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি দেশ ছেড়ে পালান। বিপ্লবের পর ইরানের নতুন ইসলামী সরকার ইসরায়েলকে প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে। একই সময় বিপ্লবীরা মার্কিন দূতাবাস দখল করে এবং ৪৪৪ দিনের জিম্মি সংকটের সূচনা হয় (দূতাবাসে জিম্মি করা হয় মার্কিন কূটনীতিকদের)। তখন ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি আন্তর্জাতিক চাপের মুখে স্থবির হয়ে পড়ে।
এরপর ১৯৮২ সালে ইসরায়েল লেবাননে আগ্রাসন চালালে ইরানের নতুন শাসকগোষ্ঠী লেবাননে শিয়াদের নিয়ে হিজবুল্লাহ গঠনে সহায়তা করে। অর্থ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে তারা ওই সশস্ত্র গোষ্ঠীকে শক্তিশালী করে তোলে। এ ছাড়া ইরান গাজায় হামাস, ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহী এবং ইরাক ও সিরিয়ার আরও কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠীকে অর্থায়ন করে থাকে—যা মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দাবি।
২০০২ সালের আগস্টে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থা ও ইরানি বিরোধী দলগুলোর তথ্য ফাঁসের মাধ্যমে নাতানজের গোপন পারমাণবিক সমৃদ্ধিকরণ কেন্দ্রের অস্তিত্ব প্রকাশ পায়। এরপর ২০০৩ সালে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি ইরানের সঙ্গে আলোচনায় বসে এবং অক্টোবর মাসে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম স্থগিত করে।
২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাহমুদ আহমাদিনেজাদ প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ইরান আবার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শুরু করে এবং ইউরোপীয় দেশগুলো আলোচনায় থেকে সরে দাঁড়ায়। ২০০৯ সালের নির্বাচনে আহমাদিনেজাদ পুনরায় নির্বাচিত হন, যা ‘গ্রিন মুভমেন্ট’ আন্দোলনের জন্ম দেয়।
একই বছরের অক্টোবরে ওমানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান গোপনে বার্তা আদান-প্রদান শুরু করে। এরপর ২০১০ সালে ইরানের সেন্ট্রিফিউজ ধ্বংসকারী স্টাক্সনেট ভাইরাস আবিষ্কৃত হয়, যা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের যৌথ উদ্যোগে তৈরি বলে ধারণা করা হয়।
২০১৫ সালের ১৪ জুলাই, ইরান ও বিশ্বশক্তিগুলো একটি চুক্তিতে পৌঁছায়, যাতে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সীমিত করার বিনিময়ে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে। কিন্তু ২০১৮ সালে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু দাবি করেন, তারা প্রমাণ পেয়েছেন যে ইরান ২০১৫ সালের চুক্তির আগেও তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি গোপন রেখেছিল। এই বছরেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একতরফাভাবে ওই চুক্তি থেকে সরে যান। এরপর ২০২০ সালে ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে আক্রমণ জোরদার করে।
২০২০ সালের জুলাইয়ে নাতানজের একটি সেন্ট্রিফিউজ উৎপাদন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণ ঘটে, যার জন্য ইরান ইসরায়েলকে দায়ী করে। নভেম্বরে ইরানের শীর্ষ পারমাণবিক বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহকে তেহরানের বাইরে একটি গাড়িতে থাকা অবস্থায় রিমোট-কন্ট্রোল মেশিনগান দিয়ে হত্যা করা হয়।
২০২১ সালের এপ্রিলের ১১ তারিখে নাতানজের আন্ডারগ্রাউন্ড স্থাপনায় সাইবার হামলা হয়, যাতে বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটে। ১৬ এপ্রিল, ইরান ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শুরু করে, যা পরমাণু অস্ত্র তৈরির মাত্রার কাছাকাছি। পরে ২০২২ সালের জুনে ইরান দুই পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে বিষ প্রয়োগে হত্যার অভিযোগ তোলে, যদিও সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি।
মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর, যখন ফিলিস্তিনের সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে এক হাজার ২০০ জনকে হত্যা করে এবং ২৫০ জনকে জিম্মি করে। ইরান হামাসকে সমর্থন জানায়। ২০২৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ইসরায়েল ইরানের একটি প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইনে হামলা চালায়। পরে ১ এপ্রিল ইসরায়েল সিরিয়ার দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে বিমান হামলা চালিয়ে ১৬ জনকে হত্যা করে, যাদের মধ্যে দুই ইরানি জেনারেলও ছিলেন।
এর প্রতিশোধে ১৪ এপ্রিল ইরান ইসরায়েলে ৩০০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ছোড়ে, যদিও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোটের সহায়তায় বেশিরভাগ রুখে দেওয়া হয়। ১৯ এপ্রিল ইসরায়েল ইরানের ইস্পাহানের বিমানবন্দরের কাছে একটি বিমান প্রতিরক্ষা স্থাপনাকে লক্ষ্য করে হামলা চালায়।
৩১ জুলাই ইসরায়েলি বিমান হামলায় তেহরান সফররত হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়েহ নিহত হন। এরপর ২৭ সেপ্টেম্বর ইসরায়েল হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যা করে। ১ অক্টোবর ইরান ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দ্বিতীয়বারের মতো সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, যদিও সেগুলোর অধিকাংশই প্রতিহত করা হয়।
একই বছরের ১৬ অক্টোবর ইসরায়েল গাজায় হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে হত্যা করে। পরে ২৬ অক্টোবর ইসরায়েল প্রকাশ্যে ইরানে হামলা চালায় এবং তাদের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি ও বিমান প্রতিরক্ষা স্থাপনায় আঘাত হানে।
২০২৫ সালের ৩০ এপ্রিল ইরান এক ব্যক্তিকে ফাঁসি দেয়, যাকে তারা ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের হয়ে কাজ করার এবং ২০২২ সালের ২২ মে বিপ্লবী গার্ড কর্নেল হাসান সাইয়াদ খোদায়িকে হত্যায় সম্পৃক্ত বলে দাবি করে।
পরমাণু অস্ত্র তৈরির সন্দেহ থেকে ২০২৫ সালের ১৩ জুন ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক কাঠামোর ওপর ব্যাপক বিমান হামলা চালায়। আগে থেকেই চোরাপথে পাঠানো ড্রোন ব্যবহার করে শীর্ষ জেনারেল ও বিজ্ঞানীদের হত্যা করে। ১৪ জুন ইসরায়েল ইরানের জ্বালানি খাতকে লক্ষ্য করে হামলা আরও বাড়ায়। এর পাল্টা জবাবে ইরান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চলতে থাকে।
১৫ জুন তৃতীয় দিনের মতো ইসরায়েল ইরানজুড়ে বিমান হামলা চালায় এবং হুমকি দেয় আরও বড় হামলার। এদিন কিছু ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা পেরিয়ে দেশের কেন্দ্রস্থলে আঘাত হানে। ইসরায়েলের এই আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে ওমানে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নির্ধারিত পারমাণবিক আলোচনা বাতিল হয়ে যায়।
১৬ জুন ইসরায়েল ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ভবনে হামলা চালায়, এতে অনেক কর্মী নিহত ও আহত হন। ইসরায়েল দাবি করে, ভবনটি সামরিক কাজে ব্যবহার হচ্ছিল। হামলার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর তেহরানের অনেক বাসিন্দা শহর ছেড়ে চলে যেতে থাকেন। ১৭ জুনও টানা পঞ্চম দিনের মতো এই হামলা চলছে।