Image description
ইরানের পাল্টা হামলায় তছনছ তেলআবিব প্রতিরক্ষা সদর দফতরসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হানা ইরানের আরো ২ জেনারেল ও ৩ বিজ্ঞানী নিহত তেহরানে আবাসিক ভবনে হামলায় নিহত ৬০

নজিরবিহীন হামলার জবাবে শুক্রবার মধ্যরাত থেকে ইসরাইলে ব্যাপক পাল্টা আক্রমণ শুরু করেছে ইরান। ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরাইলের তেলআবিব, জেরুসালেমসহ বিভিন্ন শহরে মুহুর্মুহু বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। ইসরাইলি গণমাধ্যমের বিভিন্ন ছবি ও ভিডিওতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির চিত্র দেখা গেছে। এতে দেখা যায়, গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনাসহ বহু ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে। এর মধ্যে ইসরাইলের আয়রন ডোম বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ব্যর্থ করে তেলআবিবে অবস্থিত প্রতিরক্ষা সদর দফতরে হামলা চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়ার দাবি করেছে ইরান। সংবাদ সংস্থা আনাদোলুসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ইরানি হামলায় ইসরাইলের গর্ব অত্যাধুনিক তিনটি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্মিত এই ফিফথ জেনারেশনের ফাইটার জেট এ প্রথমবারের মতো ভূপাতিতের ঘটনা ঘটেছে। শুধু তাই নয়, নারীসহ দুই পাইলটও ইরানি সেনাদের হাতে ধরা পড়েছে বলে দাবি করছে তেহরান। অন্যদিকে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু আত্মরক্ষায় দেশ ছেড়ে গ্রিসের অজ্ঞাতস্থানে আশ্রয় নিয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে বলা হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ওমানে আজ রোববারের নির্ধারিত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পারমাণবিক আলোচনা বাতিল করেছে ক্ষুব্ধ ইরান। সবমিলিয়ে চিরবৈরী দেশ দুটোর পাল্টাপাল্টি হামলায় মধ্যপ্রাচ্যে নতুন মোড় নিয়েছে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি।

মূলত ইসরাইলের ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ অভিযানের বিপরীতে ইরান ‘অপারেশন ট্রুু প্রমিস-৩’ শুরু করে। এরই অংশ হিসেবে তেহরানের প্রতিশোধমূলক হামলায় ইসরাইলের তিনটি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয়েছে বলে দাবি করেছে দেশটির আধা-সরকারি সংবাদ সংস্থা ‘মেহের নিউজ’। তাসনিম নিউজের বরাতে জানা গেছে, ভূপাতিত যুদ্ধবিমানগুলোর দুটির পাইলটকে আটক করা হয়েছে। অন্যদিকে ইসরাইলের বেন গুরিয়ন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল শনিবার বিমানবন্দরের মুখপাত্র লিসা ডাইভার বলেন, বিমানবন্দরটি কবে বা কোন দিনে আবার চালু হবে, সে বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।

এদিকে তেহরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরাইলের রিশন লেজিওন ও আশপাশের এলাকায় মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েছে। জরুরি উদ্ধারকারী বাহিনী ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছে। অপর দিকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় গুরুতর আহত এক ইসরাইলি নারী গতকাল শনিবার ভোরে মারা গেছেন। তেহরানের চতুর্থ দফা হামলার পর আরেকজনের মৃত্যুর ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এছাড়া আবাসিক এলাকায় হামলায় দু’জন নিহত হয়েছে। ইসরাইলের দুই দফা হামলার জবাবে শুক্রবার রাতে শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। এরপর ইসরাইলের গুশ দান এলাকায় ১০২ জরুরি হটলাইনে অসংখ্য কল আসার কথা জানিয়েছে দেশটির ফায়ার অ্যান্ড রেসকিউ অথরিটি। এর মধ্যে গতকাল ইরানের রাজধানী তেহরানের একটি আবাসিক কমপ্লেক্সে ইসরাইলি হামলায় ২০ শিশুসহ প্রায় ৬০ জন নিহত হয়েছেন। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের বরাতে এ খবর দিয়েছে সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা। এছাড়া ইসরাইলের হামলায় ইরানের আরো দুজন সিনিয়র জেনারেল ও তিনজন পরমাণু বিজ্ঞানি নিহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। শনিবার এক বিবৃতিতে ইরানের সশস্ত্রবাহিনীর জেনারেল স্টাফ এ তথ্য জানান।

জেরুসালেম পোস্ট লিখেছে, তেল আবিব ও রামাত গানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় আগুন লাগার খবর পাওয়ার পর ফায়ার ফাইটার দলগুলোকে এ দুই স্থানে পাঠানো হয়। ফায়ার অ্যান্ড রেসকিউ অথরিটি জানিয়েছে, তেল আবিবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং আটকে পড়া মানুষজন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। রামাত গানে ভবনের কাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে এবং সেখানেও আটকে পড়া মানুষজন রয়েছে। জাতীয় জরুরি সেবা সংস্থা মাগেন ডেভিড অ্যাডম ৬৩ জন আহতকে চিকিৎসা দিয়েছে। জেরুসালেম পোস্ট লিখেছে, ২৬ জনকে শেবা মেডিক্যাল সেন্টারে নেয়া হয়েছে, যাদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক এবং দুইজন মোটামুটি আহত। ১৩ জনকে বেলিনসন হাসপাতালে নেয়া হয়েছে, যাদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক এবং দুজন মোটামুটি আহত। ১৯ জনকে ইচিলভ মেডিক্যাল সেন্টারে নেয়া হয়েছে। এমডিএ’র উদ্ধারকারী দল আহতের খবর পাওয়া গেছে, গুশ দান এলাকার এমন সাত স্থানে অনুসন্ধান চালাচ্ছে।

শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা : ইসরাইলের দিকে ইরান ১৫০টিরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার পর ইহুদি দেশটিতে সাইরেন বাজতে শুরু করে। এরপর ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী-আইডিএফ জনতাকে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য প্রাথমিক সতর্কবার্তা জারি করে। জেরুসালেম পোস্ট লিখেছে, প্রাথমিক প্রতিরক্ষা মূল্যায়নে জানা গেছে, ইরান ইসরাইলের ভূখণ্ডের দিকে অন্তত কয়েক ডজন ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। আইডিএফ জানায়, প্রথম হামলার কিছুক্ষণের মধ্যেই ইরান আরেক দফা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, তারা ইসরাইলের আকাশে ক্ষেপণাস্ত্র মোকাবেলার দৃশ্য দেখেছেন। ইরানে শুক্রবার ভোররাতে বিভিন্ন স্থানে দফায় দফায় হামলার পরদিন দুপুরে ইসরাইল দেশটিতে দ্বিতীয়বারের মতো কয়েক দফা হামলা চালায়। রয়টার্স জানিয়েছে, জাতিসঙ্ঘে ইরানের প্রতিনিধি বলেছে ইসরাইলের হামলায় জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাসহ ৭৮ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ৩২০ জন, যাদের বেশির ভাগ বেসামরিক ব্যক্তি।

তিনটি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত : ইরানের হামলায় ইসরাইলের তিনটি অত্যাধুনিক এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করা হয়েছে বলে দাবি করেছে দেশটির আধা-সরকারি সংবাদ সংস্থা ‘মেহের নিউজ’। তেহরান টাইমসের খবরে সেনাবাহিনীর বিবৃতির বরাতে দাবি করা হয়েছে, সর্বশেষ শনিবার ভূপাতিত করা হয়েছে একটি যুদ্ধবিমান। এ ছাড়া শুক্রবার দু’টি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করা হয়। তিন যুদ্ধবিমানের পাইলটদের মধ্যে একজন নিহত হয়েছেন বলে ধারণা করা হয়। অন্য দু’জন ইরানের হেফাজতে রয়েছে। তবে ইসরাইলি সেনাবাহিনী এই দাবি অস্বীকার করেছে। তারা বলছে, তাদের কোনো বিমান ভূপাতিত হয়নি এবং কোনো সেনাসদস্য নিখোঁজ বা বন্দী হননি।

তেলআবিবে প্রতিরক্ষা সদর দফতর বিধ্বস্ত : পাল্টা হামলায় ইসরাইলের আয়রন ডোম বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ব্যর্থ করে তেলআবিবে অবস্থিত প্রতিরক্ষা সদর দফতরে হামলা চালিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইরান। শনিবার ভোরে ইসরাইলি ভূখণ্ড লক্ষ্য করে ইরান বেশ কয়েকটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। যেসব স্থানে আঘাত হানা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে তেলআবিবের কিরিয়া এলাকা, যেখানে ইসরাইলের সামরিক সদর দফতর এবং ইসরাইলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় অবস্থিত।

মধ্য ইসরাইলের বিভিন্ন অংশে ইরানের একাধিক ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত হানে। এতে বেসামরিক হতাহত এবং দৃশ্যমান ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটেছে। ১৯ সেকেন্ডের ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, ইসরাইলের আয়রন ডোম একটি ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করছে। তবে ক্ষেপণাস্ত্রটি ওই আয়রন ডোম ভেঙে চোখের পলকে প্রতিরক্ষা সদর দফতরে আঘাত হানে। ক্লিপটি শুরু হয় বিকট শব্দে বেরিয়ে আসা প্রজেক্টাইল দিয়ে। তারপর আলোর ঝলক এবং আগুনের একটি গোলা বিকট শব্দে ভবনটিতে আঘাত করে। এর পেছনে তেলআবিবের কিরিয়া এলাকার মার্গানিট টাওয়ারটি দেখা যায়, যা আইডিএফ সদর দফতরের কাছে শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত।

পশ্চিমাদের ঘাঁটিতে হামলার হুমকি : ইসরাইলের ওপর ইরানের হামলা ঠেকাতে সহায়তা করলে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের ঘাঁটি ও জাহাজে হামলা চালানোর হুঁশিয়ারি দিয়েছে তেহরান। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে বিবিসি এ কথা জানিয়েছে। বলা হয়েছে, ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামলা ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা ফ্রান্স হস্তক্ষেপ করলে, এসব দেশের আঞ্চলিক সামরিক ঘাঁটি ও নৌবাহিনীর জাহাজগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করা হবে- এমন হুঁশিয়ারি দিয়েছে তেহরান। যুক্তরাজ্য এ বিষয়ে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।

তেহরানে নিহত ৬০ : ইরানের রাজধানী তেহরানের একটি আবাসিক কমপ্লেক্সে ইসরাইলি হামলায় ২০ শিশুসহ প্রায় ৬০ জন নিহত হয়েছেন। শনিবার ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের খবরে এ তথ্য জানানো হয়েছে। আলজাজিরার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শুক্রবার ভোররাতে শুরু হওয়া এই হামলা ছিল ইসরাইলের পক্ষ থেকে ইরানের ওপর তৃতীয় দফা আক্রমণ।

তেহরানে একাধিক বিস্ফোরণ : ইরানে শুক্রবার ভোররাতে একাধিক স্থানে হামলার পর দিনের বেলায় আবার নতুন করে দফায় দফায় হামলা চালায় ইসরাইল। ইসরাইলের বিমানবাহিনী এক্সে এক পোস্টে বলেছে, তারা ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণস্থল ও অবকাঠামোগুলোতে হামলা অব্যাহত রেখেছে। তেহরানে স্থানীয় সময় দুপুর প্রায় সাড়ে ৩টার দিকে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভিতে বলা হয়েছে, তেহরানের আবাসিক এলাকায় হামলা হয়েছে। তেহরানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলেও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। গত কয়েক ঘণ্টায় ইসরাইল ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’-এর অংশ হিসেবে ইরানজুড়ে এ হামলা চালিয়েছে। ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় তাবরিজ শহরে ইসরাইল একটি সামরিক বিমান ঘাঁটিতে আঘাত হেনেছে বলে জানিয়েছে ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডস সংশ্লিষ্ট একটি বার্তা সংস্থা।

হামলা অব্যাহত রাখবে ইরান : ইসরাইলের বিরুদ্ধে ইরানের হামলা অব্যাহত থাকবে বলে শনিবার উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে ইরানের ফার্স নিউজ এজেন্সি জানিয়েছে, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিগুলোও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে। সামরিক কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ফার্স আরো জানিয়েছে, ‘গত রাতের সীমিত অভিযানে এই সংঘর্ষ শেষ হবে না। ইরানের হামলা অব্যাহত থাকবে। এ পদক্ষেপ আগ্রাসীদের জন্য অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক ও অনুশোচনীয় হবে।’ সামরিক কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ‘এই যুদ্ধ আগামী দিনগুলোতে ইসরাইলি শাসনব্যবস্থার দখলকৃত সব অঞ্চল এবং অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে ছড়িয়ে পড়বে।’

নতুন সেনাপ্রধান হাতেমি : ইরানের সেনাবাহিনীর প্রধান কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন মেজর জেনারেল আমির হাতেমি। তাকে নিয়োগ দিয়েছেন দেশটির সশস্ত্রবাহিনীর সর্বোচ্চ প্রধান ও ইসলামী বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। শুক্রবার এক সরকারি ডিক্রির মাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। জেনারেল হাতেমি ২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নিয়োগসংক্রান্ত আনুষ্ঠানিক আদেশে আয়াতুল্লাহ খামেনি জেনারেল হাতেমির ‘নিষ্ঠা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা’কে ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করেন এবং তার নেতৃত্বে সেনাবাহিনীতে ‘একটি রূপান্তরমূলক ও বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গির’ আহ্বান জানান।

আকাশসীমা খুলে দিলো জর্দান : ইরান-ইসরাইল পাল্টাপাল্টি হামলাকে কেন্দ্র করে নিজেদের আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছিল জর্দান। তবে সেটি এখন খুলে দেয়া হয়েছে। জর্দানের বেসামরিক উড়োজাহাজ চলাচল কর্তৃপক্ষ বলেছে, শনিবার স্থানীয় সময় সকাল ৭টা ৩০ মিনিটের দিকে আকাশসীমা আবার উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। ইসরাইল-ইরান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে ফ্লাইট স্থগিত করার এক দিন পর জর্দানের বেসামরিক উড়োজাহাজ চলাচল কর্তৃপক্ষ এ ঘোষণা দিলো।

আগেই ইরানে ঢুকে হামলার ক্ষেত্র গড়ে মোসাদ : ইসরাইলের যুদ্ধবিমানগুলো শুক্রবার যখন ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনার দিকে উড়ে যাচ্ছিল, তখন ইরানের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা মোসাদের ছদ্মবেশী সশস্ত্র গোয়েন্দা দল, একঝাঁক সশস্ত্র ড্রোন এবং সাধারণ যানবাহনের মধ্যে লুকিয়ে রাখা বিস্ফোরক খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে। এসব অস্ত্র ইরানের ঘুমন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও স্থাপনার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ইরানে সামরিক কমান্ডার, পরমাণুবিজ্ঞানী এবং অভিজাত বাহিনী ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) নেতারা ছিলেন হামলার লক্ষ্যবস্তু। তাদের অনেকেই তখনো ‘নিজের বিছানায়, নিজের বাড়িতে’ ছিলেন বলে জানিয়েছেন এক ইসরাইলি নিরাপত্তা কর্মকর্তা, এ অভিযানের বিষয়ে তিনি সরাসরি অবগত। তিনি ওয়াশিংটন পোস্টকে অভিযানসংক্রান্ত অপ্রকাশিত বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন।

আরেক জ্যেষ্ঠ ইসরাইলি নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানান, এই হত্যাকাণ্ডগুলো ছিল বহুস্তরবিশিষ্ট একটি অভিযানের অংশ। এর নেতৃত্বে ছিল ইসরাইলের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এই অভিযান গতি পেলেও দীর্ঘ সময় ধরে এর ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হচ্ছিল।

ইসরাইলি ও পশ্চিমা নিরাপত্তা কর্মকর্তা এবং ইরান সরকারের বিভিন্ন বিবৃতিতে বলা হয়, ভোর হওয়ার আগেই ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ঘনিষ্ঠ বলয়ের বিভিন্ন সদস্য এবং পারমাণবিক কর্মসূচির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা নিহত হন। ইসরাইলি ও পশ্চিমা নিরাপত্তা কর্মকর্তারা এবং সরকারপক্ষের দেয়া তথ্যে বলা হয়েছে, তাদের অনেকেই বিস্ফোরকভর্তি ড্রোন কিংবা অন্যান্য যন্ত্রের আঘাতে নিহত হন। এসব বিস্ফোরক তেহরানের কেন্দ্রস্থলে আবাসিক ভবন ও অন্যান্য স্থাপনার পাশে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে গর্তের সৃষ্টি করেছে।

আরেক জ্যেষ্ঠ ইসরাইলি নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানান, এই হত্যাকাণ্ডগুলো ছিল বহুস্তরবিশিষ্ট একটি অভিযানের অংশ। এর নেতৃত্বে ছিল ইসরাইলের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এই অভিযান গতি পেলেও দীর্ঘ সময় ধরে এর ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হচ্ছিল। অভিযান সফল করতে সাহসী ও সুপরিকল্পিত পরিকল্পনার পাশাপাশি বিভ্রান্তিমূলক কর্মকৌশলও ব্যবহার করা হয়েছে।

অন্য দিকে দ্বিতীয় এক ইসরাইলি নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, অতি সম্প্রতি ইহুদিবাদী রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ইউনিটগুলো ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা অকার্যকর করার উদ্দেশ্যে খোলা জায়গায় নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে সক্ষম অস্ত্র স্থাপন করে। বিশেষ করে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যাটারি কাছাকাছি এসব অস্ত্র বসানো হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল, হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নিষ্ক্রিয় করে ফেলা। মোসাদ আরো আগে থেকেই ইরানের ভেতরে বিস্ফোরক ড্রোনের একটি ঘাঁটি গড়ে তোলে। ওই কর্মকর্তা বলেন, হামলার আগে এসব ড্রোন সক্রিয় করা হয় এবং সেগুলো তেহরানের কাছাকাছি এসফাজাবাদে ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ কেন্দ্রের দিকে পাঠানো হয়। ইসরাইলি যুদ্ধবিমানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতে পারে- এমন অন্যান্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিষ্ক্রিয় করতে সাধারণ যানবাহনের ভেতরে বিস্ফোরক ও উন্নত প্রযুক্তি লুকিয়ে রেখেছিল মোসাদ। দূর থেকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এসব বিস্ফোরক দিয়ে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস কিংবা বিপর্যস্ত করা যায়।

এ দিকে ইসরাইলি এই হামলার কৌশলগত প্রভাব নির্ণয় করতে আরো কিছুদিন বা কয়েক সপ্তাহ লাগবে বলে জানিয়েছেন পশ্চিমা নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা। তাঁরা বলেন, এই হামলা ইরানের কথিত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রয়াসে বড় ধরনের ধাক্কা দিলেও তা স্থায়ী হবে কি না- এখনই বলা যাচ্ছে না। ইরান অবশ্য বরাবরই দাবি করে আসছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পরিচালিত।

ইরানের প্রতি ‘পূর্ণ সংহতি’ পাকিস্তানের : পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ শনিবার ইরানের প্রতি ‘পূর্ণ সংহতি’ প্রকাশ করেছেন, যখন তেহরান ও ইসরাইলের মধ্যে তীব্র ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা চলছে। তার এই অবস্থান ইরানের প্রতি পাকিস্তানের কূটনৈতিক সমর্থনের বার্তা বহন করে।

পিটিভি নিউজ জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. মাসউদ পেজেশকিয়ানের সাথে টেলিফোনে কথা বলেন এবং তাকে জানান যে, ইসরাইলের উসকাবিহীন ও অন্যায্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পাকিস্তান ইরানের ভ্রাতৃপ্রতিম জনগণের সাথে সম্পূর্ণ সংহতি প্রকাশ করছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনি (শাহবাজ শরিফ) ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইলের হামলাকে কঠোরভাবে নিন্দা জানিয়েছেন, যা ইরানের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার লঙ্ঘন এবং জাতিসঙ্ঘ সনদ ও আন্তর্জাতিক আইনের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন। প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, জাতিসঙ্ঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ইরানের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও জাতিসঙ্ঘকে ইসরাইলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ‘তাৎক্ষণিক ও বিশ্বাসযোগ্য পদক্ষেপ’ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, পাকিস্তান আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় সম্পূর্ণরূপে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

ড. মাসউদ পেজেশকিয়ান প্রধানমন্ত্রীকে পাকিস্তানের সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জানান এবং বলেন, এটি দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ ও ভ্রাতৃসুলভ সম্পর্কের প্রতিফলন।

এ দিকে পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো-জারদারি বলেছেন, ইরানে যে সঙ্ঘাত চলছে, তা যদি ইরাক ২.০-তে বা বিশ্বযুদ্ধের রূপ নেয়, তাহলে পাকিস্তান তার খেসারত দিতে পারবে না। এর মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, একটি দীর্ঘস্থায়ী ও বহিরাগতভাবে উসকানো যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে পারে। ব্রাসেলসে এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিলাওয়াল ভুট্টো-জারদারি বলেন, আমরা অবশ্যই আমাদের এই সীমান্তে (ইরানের সাথে) কোনো যুদ্ধ চাই না। গত কয়েক দিনে আমাদের প্রতিবেশী দেশের ওপর যেসব হামলা হয়েছে, পাকিস্তান তা স্পষ্টভাবে নিন্দা করেছে।

মার্কিন মদদে হামলা বলছে ইরান : মার্কিন মদদে ইসলামিক রিপাবলিকে ইসরাইল বিমান হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ইরান। তবে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত ওই অভিযোগকে খারিজ করে দিয়ে বরং পাল্টা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়, পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে সমঝোতা করাই হবে তাদের জন্য এখন বুদ্ধিমানের কাজ।

নিরাপত্তা পরিষদের উদ্দেশে ইরানি স্থায়ী প্রতিনিধি আমির সাইয়েদ ইরাভানি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ যারা ইসরাইলকে সমর্থম করে, তাদের বোঝা উচিত, তারা সবাই (গতকালের হামলায়) সহযোগী। সহায়তা এবং সমর্থনের মাধ্যমে তারা পরিণতিরও সমান ভাগিদার।

হামলার আগে ইসরাইলকে হেলফায়ার পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র : মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-ইসরাইলের মধ্যে চলমান সঙ্ঘাতের আগে গোপনে ইসরাইলকে কয়েক শ’ অত্যাধুনিক হেলফায়ার ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। একই সাথে ইসরাইলের দিকে ছোড়া ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করতে সহায়তা করেছে মার্কিন সেনাবাহিনী। শুক্রবার রাতে প্রকাশিত মিডল ইস্ট আইয়ের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

ইসরাইল আগে থেকেই বড় পরিসরে অস্ত্র ও গোলাবারুদ মজুদ করছে। এরই অংশ হিসেবে ইরানে হামলার আগে গত ১০ জুন গোপনে ইসরাইলে প্রায় ৩০০টি হেলফায়ার ক্ষেপণাস্ত্র পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র। যদিও ট্রাম্প প্রশাসন বলছিল, তারা ইরানের সাথে পারমাণবিক ইস্যু নিয়ে আলোচনায় আগ্রহী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুই মার্কিন কর্মকর্তা মিডল ইস্ট আইকে বলেন, এত বিপুল পরিমাণ হেলফায়ার ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহের বিষয়টি ইঙ্গিত দেয় যে ট্রাম্প প্রশাসন ইরানে ইসরাইলের আক্রমণের পরিকল্পনা সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত ছিল।

শুক্রবার ইরানে হামলার আগে যুক্তরাষ্ট্র যে ইসরাইলে বিপুল পরিমাণে হেলফায়ারসহ অন্যান্য অস্ত্র সরবরাহ করেছে, সে খবর এত দিন প্রকাশিত হয়নি। গত শুক্রবার রয়টার্সকে দুই মার্কিন কর্মকর্তা জানান, ইসরাইলের দিকে ছোড়া ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করতে মার্কিন সেনাবাহিনী সহায়তা করেছে।

হেলফায়ার হলো লেজারনিয়ন্ত্রিত আকাশ থেকে স্থলে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বিস্ফোরণ ঘটাতে এ ক্ষেপণাস্ত্র বিশেষভাবে উপযোগী নয়। তবে নির্ভুলভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার জন্য এটি কার্যকর। শুক্রবারের হামলায় ইসরাইলি সামরিক বাহিনী ১০০টির বেশি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করেছে।