
গত ২১ মে থেকে ৩ জুন। এই ১৪ দিন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। তার অনুপস্থিতি ব্যাপক জল্পনা-কল্পনার জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে এ সময়ে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) অস্বাভাবিক তৎপরতা দেখা গেছে। এই পরিস্থিতে অনেকের প্রশ্ন, দেশটিতে নেতৃত্বে কী পরিবর্তন আসছে?
মনে রাখতে হবে, শি জিনপিং গত ১২ বছর ধরে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে রয়েছেন। করোনা ভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতিতে যে আঘাত হেনেছে, তার ক্ষত এখনও পুরোপুরি কাটেনি। বিশেষ করে চীনের অর্থনীতি যে শ্লথ প্রবৃদ্ধির কবলে পড়েছে, তা থেকে বের হতে পারছে না। এজন্য স্থানীয় সরকারের ঋণ, রিয়াল এস্টেট ব্যবসায় ধস, বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার মতো নানা কারণ দায়ী। এর সঙ্গে রয়েছে ভোক্তা চাহিদা কমে যাওয়া। বয়স্ক মানুষ বেড়ে যাওয়া। তাদের পেনশনের জন্য বিপুল ব্যয়। আর এদের হাত ধরে দেশটি উন্নয়নশীল অবস্থা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উন্নত হওয়ার আগেই নিরাময়অযোগ্য এক অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে দেশটি। সরকার অর্থনীতিতে গতি আনতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। কিন্তু সমস্যা কাটাতে পারছে না।
এরই মধ্যে শি জিনপিংয়ের এই লোকসমক্ষে না আসার ঘটনা। এ সময় একজন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ব্যক্তির রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটেছে। এসব দেখে সর্বোচ্চ স্তরে একটি সম্ভাব্য ক্ষমতার লড়াইয়ের ইঙ্গিত পাচ্ছেন চীনা রাজনীতির বিশ্লেষকরা।
এটা ঠিক, চীন কোন পথে যাবে- এর বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক প্রভাব রয়েছে। সিসিপি চলার পথ না পাল্টালে স্থানীয় ঋণ এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থার পতন কি অনিবার্য? অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে দৃষ্টি সরাতে যুদ্ধ বা অন্য কোনো কৌশল নিতে পারে কি? চীনের অভ্যন্তরে এমন অনেক ঘটনা ঘটছে, যা এই অঞ্চল, বিশেষ করে এশিয়াসহ বাকি বিশ্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। এসব নিয়েই জাপান ফরোওয়ার্ডের বিশ্লেষণী প্রতিবেদন।
শি জিনপিংয়ের অনুপস্থিতি নজিরবিহীন
শি জিনপিংয়ের সাম্প্রতিক ১৪ দিনের অনুপস্থিতি নজিরবিহীন ঘটনা। ২০১২ সালের মতো আগের অনুপস্থিতিগুলোর থেকে এটা ভিন্ন। তখন তিনি সাধারণ সম্পাদক হওয়ার জন্য ক্ষমতা সংহত করছিলেন। আবার ২০২৩ সালের মতোও নয়। তখন মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচার করায় পর্দার আড়ালে ছিলেন বলে খবর রটেছিল। এবার তার অনুপস্থিতি ক্ষমতার লড়াইয়ের ক্রমাগত গুঞ্জনের পরে ঘটেছে।
চীনের স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো জানায়, ২০২৪ সালের এপ্রিলেই প্রভাব হারিয়ে থাকতে পারেন শি। তার কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে সামরিক বাহিনীর অনুগত অংশ।
শির স্ত্রী পেং লিউয়ান সাম্প্রতিক বিদেশ সফরে তার সঙ্গী হননি। দেশের ভেতরে শির পরিষদবর্গের পদমর্যাদা কমান হয়েছে। উপপ্রধানমন্ত্রী হে লাইফেংয়ের মতো নিম্নপদস্থ কর্মকর্তারা সিসিপির দপ্তর সম্পাদক কাই কির মতো সিনিয়র ব্যক্তিদের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন।
সিসিপির কেন্দ্র থেকে অস্বাভাবিক সংকেত
সিসিপির কার্যক্রমেও অনিয়ম দেখা গেছে। পলিটিক্যাল ব্যুরো নিয়মিত মাসিক বৈঠক করে। তারা গত মে মাসের শেষে বৈঠক করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর আগের বৈঠকে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল, শি-কে ক্ষমতাচ্যুত করা হতে পারে।
রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম পিপলস ডেইলি গত ২ থেকে ৪ জুন প্রথম পাতায় শি জিনপিং এবং অন্যান্য শীর্ষ নেতার খবর ছাপেনি। তারা কার্বন হ্রাস এবং আঞ্চলিক উন্নয়নের মতো বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে। একে অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন স্থানীয় সাংবাদিকরা।
লিবারেশন আর্মি ডেইলি গত ৩০ মে একটি নিবন্ধের শিরোনাম করেছে, ‘জনগণের ক্ষমতা অবশ্যই জনগণের সেবা করবে’। এতে শি-কে সমালোচনা করে ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সতর্ক করা হয়েছে। এই খবরটি অন্যান্য সরকারি মাধ্যমগুলোও প্রচার করে। এই ব্যতিক্রমগুলো শির নেতৃত্ব থেকে ইচ্ছাকৃত দূরত্বের ইঙ্গিত বহন করে।
জু কিলিয়াংয়ের রহস্যজনক মৃত্যু
কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান জু কিলিয়াংয়ের মৃত্যু এই জল্পনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তিনি শির ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন।
এই মৃত্যুর খবর আনুষ্ঠানিকভাবে ৩ জুনে ঘোষণা করা হয়। এর পাঁচ দিন আগে জুর মৃত্যুর খবর প্রাক্তন চীনা সাংবাদিক ঝাও লানজিয়ান জানিয়েছিলেন। তিনি দাবি করেন, জু তীব্র চাপের মধ্যে ‘ভয়ে মারা গেছেন’।
১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে এবং ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে শির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন জু। শির সামরিক সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তার এই মৃত্যুর কোনো স্পষ্ট কারণ প্রকাশ করা হয়নি। এছাড়া হে ওয়েইডং এবং মিয়াও হুয়ার মতো অন্যান্য সামরিক অনুগতরা সম্প্রতি শির কাছ থেকে দূরে সরে গেছেন।
প্রাদেশিক পর্যায়ে নীরব রদবদল
শির এই অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে বেশ কয়েকটি উচ্চ-পর্যায়ের পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। গত ৩০ মে ঝেং ইয়ানক্সিয়ংকে হংকংয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের যোগাযোগ অফিসের পরিচালক পদ থেকে অপসারণ করা হয়। কেউ কেউ এই পদক্ষেপটিকে ওয়াং ইয়াং-এর সম্ভাব্য উত্থানের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। তিনি সংস্কারপন্থী নেতা হিসেবে পরিচিত। শির উত্তরসূরি বলে তাকে পরিচিত করানো হচ্ছে।
ওয়াং ২০১১ সালের উকান গ্রামের বিক্ষোভে মধ্যপন্থী ব্যবস্থাপনার জন্য পরিচিত। শির কঠোর নীতির সঙ্গে এ ঘটনা বৈসাদৃশ্যপূর্ণ। তিনি ২০১৬ সালে উকানের গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ওপর দমনপীড়ন চালিয়েছিলেন।
অন্যান্য প্রাদেশিক এবং মন্ত্রী পর্যায়ের কর্মকর্তা পদে রদবদল আনা হয়েছে। এসবই ক্ষমতা পরিবর্তনের একটি চলমান প্রক্রিয়ার ইঙ্গিত দিতে পারে।
মিলে যাচ্ছে অতীতের ক্ষমতা পরিবর্তনের সঙ্গে
ইতিহাস বলছে, নেতারা ক্ষমতা হারালে তা বিলম্বে ঘোষণা করে সিসিপি। দেং জিয়াওপিংয়ের সংস্কার কার্যক্রমের সমালোচনার পর ১৯৭৮ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত (প্রায় তিন বছর) আড়ালে ছিলেন মাও সেতুংয়ের উত্তরসূরি হুয়া গুওফেং।
১৯৮৭ সালের জানুয়ারিতে সাধারণ সম্পাদক পদ ছাড়েন হু ইয়াওবাং। এর নয় মাস পরে অক্টোবরে নিশ্চিত করা হয়েছিল ঘটনাটি।
১৯৮৯ সালের মে মাসে ছাত্র বিক্ষোভকারীদের প্রতি সহানুভূতি দেখানোয় ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন ঝাও জিয়াং। আনুষ্ঠানিক অপসারণ হওয়ার আগেই তিয়ানআনমেন স্কোয়ারে ভাষণ দিতে এসেছিলেন তিনি। এ ঘটনাগুলো থেকে বোঝা যায়, শি হয়তো নামমাত্র নেতা হিসেবে রয়েছেন। এমনকি তার ক্ষমতা কমানো হয়ে থাকলেও সিসিপি ঐক্যের মুখোশ খুলবে না।
সামাজিক অস্থিরতা এবং উদ্বেগ
তৃণমূল পর্যায়ে উত্তেজনা সুস্পষ্ট। গত ২০ মে ৮০০ আরএমবি (১১১ মার্কিন ডলার) মজুরি না পাওয়ায় টেক্সটাইল কারখানায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ আগুন ৩৭ ঘণ্টা ধরে জ্বলে এবং উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি হয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনসাধারণের সহানুভূতি ছিল বেতন না পাওয়া কর্মীর পক্ষে। এটা পদ্ধতিগত বৈষম্যের প্রতি গভীর হতাশার প্রতিফলন।
চীনা রাজনীতির বিশ্লেষক ইউয়ান হংবিং জানিয়েছেন, মধ্য ও নিম্ন-স্তরের সিসিপি নেতারা পরিবর্তনের প্রত্যাশায় সামরিক, রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িক জোট তৈরি করছেন। এটা চীনা সমাজে বিরাজমান উদ্বেগের প্রতিফলন।
চীন কি ক্ষমতার সড়কের মোড়ে দাঁড়িয়ে?
চীন এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে। আগামী আগস্টে সিসিপির আসন্ন চতুর্থ পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন। সেখানে হয়তো শি জিনপিংয়ের ভাগ্য নির্ধারণ হতে পারে। সেটাই বলে দেবে কোন পথে যাবে চীন। নতুন নেতারা কি পার্টির স্বৈরাচারী মডেল ত্যাগ করবেন? নাকি তারা শি-কে বলির পাঠা বানিয়ে ব্যবস্থাটি টিকিয়ে রাখবেন? আপাতত গুজব ডালপালা মেলছে। ইতিহাসের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ। পরিস্থিতি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বিশ্ব। আপাতত, শি-কে ঘিরে অস্বাভাবিক ঘটনা এবং সিসিপির মুখোশের ফাটলগুলো চীনের ভবিষ্যৎ গতিপথ সম্পর্কে একটি গভীর অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত দেয়।