
ভূমিকম্পপ্রবণ ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের চেনাব নদীর ওপর নির্মিত হয়েছে বিশ্বের সর্বোচ্চ রেলসেতু, যা প্রকৌশল জগতে এক নতুন মাইলফলক স্থাপন করেছে। 'উধমপুর-শ্রীনগর-বারামুল্লা রেল সংযোগ' প্রকল্পের অংশ হিসেবে নির্মিত এই সেতুটি সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উদ্বোধন করেছেন, যার ফলে কাশ্মীর উপত্যকা প্রথমবারের মতো ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে রেলপথে যুক্ত হলো।
এই প্রকল্পটি দুর্গম পাহাড়ি এলাকা এবং ভূতাত্ত্বিক জটিলতার কারণে বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল ভারত সরকারের কাছে। তবে চ্যালেঞ্জকে সফলভাবে মোকাবিলা করে প্রকল্পটির কাজ শেষ করা গেছে একজন নারী প্রকৌশলির অসামান্য অবদানের কারণে। যার নাম এখন গোটা ভারতজুড়ে আলোচনার তুঙ্গে। বিরল প্রতিভার অধিকারী ওই নারী প্রকৌশলির নাম অধ্যাপক জি. মাধবী লতা। বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স (IISc)-এর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এই অধ্যাপক চেনাব সেতুর মতো একটি বিশাল প্রকৌশল প্রকল্পে ১৭ বছর ধরে ভূ-প্রযুক্তিগত পরামর্শক (geotechnical consultant) হিসেবে কাজ করেছেন।
এনডিটিভি লিখেছে, এই সেতুটি ২৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ উধমপুর-শ্রীনগর-বারামুলা রেল লিংক প্রকল্পের অংশ, যার অনুমোদন হয়েছিল ২০২৩ সালে। এই সফল নির্মাণে যারা ভূমিকা রেখেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম জি মাধবী লতা।
বেঙ্গালুরুর ভারতীয় বিজ্ঞান সংস্থার (আইআইএসসি) অধ্যাপক মাধবী লতা ১৭ বছর ধরে এই প্রকল্পে ভূ-কারিগরি পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। সেতুটির নকশা, পরিকল্পনা ও নির্মাণে বিশেষ করে ভূ-প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তিনি ঠিকাদার কোম্পানি অ্যাফকন্সের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করেছেন।
ভারতীয় বিজ্ঞান সংস্থার (আইআইএসসি) অধ্যাপক মাধবী লতা ১৯৯২ সালে জওহরলাল নেহরু প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুরকৌশল বিষয়ে প্রথম বিভাগে স্নাতক সম্পন্ন করেন।
স্নাতকোত্তর করেন এনআইটি ওয়ারঙ্গলে, ভূ-কারিগরি প্রকৌশল বিষয়ে। মেধার অনন্য স্বাক্ষর দেখিয়ে সেখানে তিনি গোল্ড মেডেল পান। এরপর ২০০০ সালে আইআইটি মাদ্রাজ থেকে ভূ-কারিগরি প্রকৌশল বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। এর মধ্যে তিনি বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছেন। ২০২১ সালে ভারতীয় জিওটেকনিক্যাল সোসাইটির সেরা নারী গবেষক পুরস্কার পান। পরের বছর বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, শিল্প ও গণিতে ভারতের শীর্ষ ৭৫ নারীর তালিকায় স্থান পান।
চেনাব সেতু প্রকল্পে ভূমিকা
ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, বৈরী আবহাওয়া ও দুর্গম অবস্থানের কারণে চেনাব সেতুর নির্মাণ অত্যন্ত কঠিন ছিল। ড. লতা ও তার দল ‘ডিজাইন অ্যাস ইউ গো’পদ্ধতি ব্যবহার করেন, মানে ভূতাত্ত্বিক বাস্তবতা দেখে নকশা পরিবর্তন ও উদ্ভাবনী সমাধান বের করা প্রাথমিক সমীক্ষায় যেসব চ্যালেঞ্জ ধরা পড়েনি- যেমন ফাটলযুক্ত শিলাস্তর, গুপ্ত গুহা ও বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্ট্যের শিলা- সেগুলো মোকাবিলায় এই পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
নির্মাণের সময় শিলাস্তরের অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে দলটিকে জটিল গণনার পাশাপাশি নকশা সংশোধন করতে হয়। শিলাস্তরের স্থিতিশীলতা বাড়াতে ড. লতা রক অ্যাংকারের (শিলা-আটকানো বিশেষ যন্ত্র) নকশা ও তা স্থাপনের বিষয়ে পরামর্শ দেন।
অধ্যাপক লতা সম্প্রতি ‘ইন্ডিয়ান জিওটেকনিক্যাল জার্নাল’র বিশেষ নারী বিশেষ সংখ্যায় ‘ডিজাইন অ্যাজ ইউ গো: দ্য কেস স্টাডি অব চেনাব রেলওয়ে ব্রিজ’ শিরোনামে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন।
চেনাব সেতুর সামগ্রিক কাঠামো, অবস্থান ও ধরন ঠিক রেখে নকশা কীভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বদলেছে তা ওই গবেষণাপত্রে তিনি তুলে ধরেছেন।
১,৪৮৬ কোটি রুপি ব্যয়ে নির্মিত চেনাব সেতুকে ‘ভারতের সাম্প্রতিক রেল প্রকল্প ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং চ্যালেঞ্জে পড়া স্থাপনা’ হিসেবে বর্ণনা করছে দেশটির সরকার।
৩৫৯ মিটার উচ্চতার এই সেতুটি আইফেল টাওয়ারের চেয়ে ৩৫ মিটার বেশি উঁচু। কাশ্মীরের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে সেতুটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।