Image description
 
 

শিশুটির ডান পা সামনে, আরেক পা পেছনে, মাটি থেকে আলগা। হাত দুটি পাখির মতো উড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে আধো-প্রসারিত। আতঙ্ক ও যন্ত্রণায় মুখ ‘হাঁ’ হয়ে আছে, চোখ দুটি প্রায় বন্ধ। সারা শরীরে কোনো কাপড়চোপড় নেই। নাপাম বোমার হামলা থেকে বাঁচতে আরও কয়েকটি শিশু-কিশোরের সঙ্গে দৌড়াচ্ছে ৯ বছর বয়সী ফ্যান থি কিম ফুক। পেছনে কয়েকজন সেনাও রয়েছেন, আছেন দুজন চিত্রগ্রাহকও।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের এই আলোকচিত্র নানা কারণে প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছে। যুদ্ধের ভয়াবহতার প্রতীকে পরিণত হওয়া এই আলোকচিত্র নিয়ে এখন পর্যন্ত অজস্র লেখালেখি হয়েছে। চলতি বছরের শুরুতে তৈরি হয়েছে একটি প্রামাণ্যচিত্র। এতে দাবি করা হয়েছে, আলোকচিত্রটি অ্যাসোসিয়েট প্রেসের (এপি) তৎকালীন আলোকচিত্রী নিক উত তোলেননি!

‘দ্য স্ট্রিংগার’ নামের এই তথ্যচিত্র গত জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের সানডেন্স ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেখানো হয়। এতে দাবি করা হয়, নিক উতে নয়, আলোকচিত্রটি ক্যামেরাবন্দী করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সম্প্রচারমাধ্যম এনবিসির গাড়িচালক গুয়েন থান নগে। গাড়ি চালানোর পাশাপাশি তিনি ফ্রিল্যান্সার আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করতেন। ফ্রিল্যান্সার আলোকচিত্রী হিসেবে তিনি এপির কাছে অনেক ছবি বিক্রি করেছিলেন। কিন্তু এপির কর্মী না হওয়ায় আলোকচিত্রী হিসেবে থান নগের নামের পরিবর্তে নিক উতের নাম ছাপা হয়েছিল।

 

বিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত একটি আলোকচিত্র নিয়ে ‘দ্য স্ট্রিংগার’ প্রামাণ্যচিত্রে এমন দাবি রীতিমতো ঝড় তুলেছে। ১৯৭২ সালের ৮ জুন তোলা ছবিটি পরের বছর ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটোর বর্ষসেরা পুরস্কার পায়। পরে পুলিৎজার পুরস্কারও জেতে। এর মধ্য দিয়ে উত একজন বরেণ্য ফটোসাংবাদিকে পরিণত হন।

২১ বছর বয়সী নিক উত ১৯৭২ সালে ভিয়েতনামের সাইগন শহরে এপির কার্যালয়ে কাজ করতেন। ৮ জুন দক্ষিণ ভিয়েতনামের ত্রাং ব্যাংয় গ্রামে মার্কিন সেনাদের বোমা হামলার সময় তিনি ঘটনাস্থলের কাছাকাছি ছিলেন। এত দিন পর্যন্ত মানুষ জেনে এসেছে, ছবিটি তোলার পর তিনি আহত কিম ফুককে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। ফলে প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন কিম ফুক।

‘নাপাম গার্ল’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করলেও ছবিটির কেতাবি নাম ‘দ্য টেরর অব ওয়ার’ বা যুদ্ধের বিভীষিকা। পরদিন ছবিটি বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ছাপানো হয়। ১৯৭২ সালের ৯ জুন সকালে ছবিটি দেখে বিশ্ববাসী হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। মানুষের কাছে তা ছিল বিশাল একটি ধাক্কা।

বর্তমানে কানাডার নাগরিক তখনকার সেই শিশুমেয়েটি কিম ফুকের সঙ্গে পরে নিক উতের সুসম্পর্ক তৈরি হয়। ২০২৩ সালে ছবিটির ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে নিউইয়র্ক টাইমসে এক নিবন্ধে কিম ফুক লিখেছিলেন, ‘এই স্মরণীয় ছবিটির মাধ্যমে আলোকচিত্রী নিক আমার জীবন স্থায়ীভাবেই বদলে দিলেন। কিন্তু তিনি আমার জীবনও বাঁচিয়েছেন। ছবি তোলার পর তিনি তাঁর ক্যামেরা নামিয়ে রাখেন। আমাকে একটি কম্বল দিয়ে জড়িয়ে দেন এবং দ্রুত আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। এ জন্য তাঁর প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ।’

কিন্তু দ্য স্ট্রিংগারের দাবির পর ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসে। শুরু করে তদন্ত। তদন্তের ফল গতকাল শুক্রবার জানানো হয়। এতে বলা হয়, চলচ্চিত্রটি ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটোকে ‘গভীর আত্মসমালোচনার’ দিকে ঠেলে দিয়েছে। আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখার সিদ্ধান্ত নিই। জানুয়ারিতে তদন্ত শুরু হয়ে মে মাসের শুরুর দিকে শেষ হয়। ‘সেই দিনের ঘটনাস্থল, দূরত্ব ও ব্যবহৃত ক্যামেরা বিশ্লেষণের ভিত্তিতে’ আমাদের সিদ্ধান্ত হলো, আলোকচিত্রী গুয়েন থান নগে ও হুইন কং ফুক ছবিটি তোলার জন্য নিক উতের চেয়ে ভালো অবস্থানে ছিলেন।

 

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছবিটির আলোকচিত্রী হিসেবে নিক উতের নাম স্থগিত করেছে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো। এখন থেকে ছবিটির আলোকচিত্রীর নাম আমরা ‘অজানা’ বলে উল্লেখ করব। তবে বর্ষসেরা পুরস্কার বাতিল করা হবে না। কারণ, আলোকচিত্রী যিনিই হোন না কেন, এটি যে গত শতকের একটি অন্যতম শক্তিশালী ছবি, তা নিয়ে কারও কোনো দ্বিধা নেই।

দ্য স্ট্রিংগার প্রামাণ্যচিত্রের প্রদর্শনীর পর ছবিটি নিয়ে গত চার মাসে দুটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বার্তা সংস্থা এপি। চলতি মাসের শুরুতে ৯৬ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছবিটির আলোকচিত্রীর নাম পরিবর্তনের পক্ষে ‘কোনো চূড়ান্ত প্রমাণ’ আমরা পাইনি।

স্ট্রিংগারের পরিচালক বাও নগুয়েন প্রামাণ্যচিত্রে অনেকের জবানবন্দি নিয়েছেন। তাঁরা দাবি করেছেন, গুয়েন নগে ছবিটি সাইগনের এপি ব্যুরোর প্রধান হর্স্ট ফাসের কাছে ২০ ডলারে বিক্রি করেছিলেন। সাক্ষীদের মধ্যে ছিলেন গুয়েন নগের ভাই। তাঁর দাবি, তিনি ছবির ফিল্মটি এপি কার্যালয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সাইগনে থাকা এপির দীর্ঘদিনের ফটোসম্পাদক কার্ল রবিনসনও প্রামাণ্যচিত্রে কথা বলেছেন। তাঁর সাবেক অনেক ফটোসাংবাদিক সহকর্মীও সেখানে কথা বলেছেন।

ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো ফরেনসিক তদন্তের জন্য ফরাসি এনজিও ইনডেক্সের সহায়তা নেয়। ইনডেক্স জানায়, ‘এপি ১৯৭২ সালের ৮ জুনের যেসব ছবি নিক উতের নামে ছেপেছিল, আমরা সেগুলোর নানান দিক বিশ্লেষণ করেছি। তাতে আমাদের মনে হয়েছে, ছবিটি “খুব সম্ভবত” উতে তোলেননি।’

 

এপিও ফরেনসিক তদন্ত চালিয়েছে। এতে ফ্রেম, আলো, ছায়া, কোণসহ আলোকচিত্রটির নানা দিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কিন্তু তাঁরা আলোকচিত্রটি যে নিক উতের নয়, কিংবা এটি যে থান নগের—কোনো বিষয়েই সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ পাননি। এই পরিস্থিতিতে আলোকচিত্রটি নিক উতের তোলা বলার পক্ষে নিজেদের অবস্থানে অটল থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মার্কিন বার্তা সংস্থাটি।

সানডেন্স ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে গুয়েন থান নগে ছবিটি নিজের বলে দাবি করেন। তবে নিক উতও ছবিটির স্বত্ব ছাড়তে রাজি নন। সম্প্রতি তিনি এপিকে বলেছেন, ‘এই বিতর্ক আমার জন্য খুব পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছে। এতে আমি গভীরভাবে কষ্ট পেয়েছি।’

ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটোর মতে, বিখ্যাত অনেক ছবির মতো আরেকটি ছবির আলোকচিত্রী নিয়ে বিতর্ক উঠল। এই ছবির প্রকৃত আলোকচিত্রী কে, তা হয়তো কখনো নিশ্চিত হওয়া যাবে না। যা–ই হোক, যত দিন না আরও প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত এই ছবির আলোকচিত্রীর স্বীকৃতি স্থগিত থাকছে।