
Maskwaith Ahsan (মাস্কওয়াইথ আহসান)
কাশ্মীরের পেহেলগামে স্বামীর মৃতদেহের পাশে একজন সদ্য বিধবা স্ত্রীর স্থিরচিত্র; দক্ষিণ এশিয়ায় মানুষের জীবনের দাম সবচেয়ে কম সেটা আরেকবার মনে করিয়ে দেয়।
কলকাতার খ্যাতিমান চলচ্চিত্র পরিচালক সৃজিত ফেসবুকে লিখেছেন, এই সন্ত্রাসী ঘটনায় হত্যাকারীকে মুসলিম সন্ত্রাসী বলুন; নিহতকে শুধু পর্যটক না বলে হিন্দু পর্যটক বলুন।
সেই তো সন্ত্রাসীরও ধর্ম থাকে, নিহতেরও ধর্ম থাকে। এই ধর্মীয় আইডেন্টিটি পলিটিকসটি এই মুহূর্তে দক্ষিণ এশিয়া বিশেষত ভারতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কাকতালীয়ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ভ্যাটিক্যান ও ভারত এই দুই জায়গায় সফর করলেন; আর দুটো জায়গাতেই মৃত্যুর ছায়া নেমে এলো। আগামী চারবছর এমন কাকতাল আর না ঘটলেই বাঁচোয়া।
কাশ্মীরের স্বজন হারানো "হিন্দু" পর্যটকরা যা হারালেন তা আর কখনো ফিরে আসবে না । কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ফিরে এসেছেন নরেন্দ্র মোদির জীবনে।
কাশ্মীরের স্বশাসন বাতিল করে একে কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে আনার পর নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে রাখা হয়েছে একে। অল্পকিছুদিন আগে নির্বাচনের মাধ্যমে একটি স্থানীয় প্রশাসন নিযুক্ত হয়েছে। এটি মোদির বিজেপির প্রশাসন হলে নিশ্চয়ই আরো কার্যকর। এরপর কাশ্মীরের মানুষেরা যেন বিজেপিকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে কাশ্মীরের স্থানীয় প্রশাসনে। তাহলে তা নিশ্চিত ভূ-স্বর্গ হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশের ২০২৪-এর ৫ অগাস্ট পরিবর্তনের পর থেকে গতকাল অবধি ভারতীয় মিডিয়ায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে রিপোর্টিং-এ যে বস্তুনিষ্ঠতা ও পেশাদারিত্বের অবাক ফুল ফুটেছে; তার আলোকে কাশ্মীর ট্র্যাজেডি নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার রিপোর্টকে ক্রেডিবল মনে করলে, এই হামলা করেছে ইসলামি সন্ত্রাসবাদীরা; আর তাদের মদদ জুগিয়েছে পাকিস্তান।
প্রায় আটমাস পর ভারতের মিডিয়ায় পাকিস্তান ফিরে এলো; এটা বাংলাদেশের জন্য দুদণ্ড শান্তি এনে নেবে। কারণ এখন রিপাবলিক টিভি ও অন্যান্যরা বাংলাদেশকে নিষ্কৃতি দিয়ে পাকিস্তান নিয়ে ব্যস্ত থাকবে।
পাকিস্তান কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী লেলিয়ে দেয় আর ভারত বেলুচিস্তানে সন্ত্রাসবাদী লেলিয়ে দেয় না। এই বাক্যটাকে বিভিন্ন রাগে গাইতে হইতে হবে প্রহরে প্রহরে। অত্যন্ত শান্তি প্রিয় ভারত ওয়াকফ বিলে সামান্য পরিবর্তন এনেছে। এখন যেহেতু কাশ্মীরে প্রমাণ হয়ে গেলো মুসলিমরাই একমাত্র সন্ত্রাসী; তাই এসব ওয়াকফ সম্পত্তি একটু একটু রাষ্ট্রায়ত্ত্ব করে নিলে সন্ত্রাসবাদের প্রকোপ কমবে। যাই বলুন, মুসলমানদের আর ভারতে রাখা যাচ্ছে না মশয়। গুজরাট গণহত্যার ক্যানডিড ফটো নেই; উত্তর প্রদেশের ক্যানডিড ফটো নেই; এমনকি মুর্শিদাবাদের কোন ফটো নেই; এমনকি বেলুচিস্তানে হাই টেক ট্রেন হাইজ্যাকিং-এ নিহত স্বামীর পাশে শোকবিধুর স্ত্রীর ছবি নেই; যা ফেসবুকে দিয়ে সৃজিতের ভাষায় বলবো, হত্যাকারীকে হিন্দু হত্যাকারী বলুন আর নিহতকে মুসলমান বলুন।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড মনমোহন সিং পাকিস্তানের সেসময়ের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশাররফের সঙ্গে কাওয়ালি-উচ্চাঙ্গ সংগীত ও ক্রিকেট ডিপ্লোমেসির মাধ্যমে কাশ্মীর সংকটের চূড়ান্ত সমাধানের রুপরেখা প্রণয়ন করেছিলেন। পুরো কাশ্মীরকে স্বাধীনতা দিয়ে ভারত-পাকিস্তান কেবল সহযোগী ভূমিকায় রয়ে যাওয়ার এই সিদ্ধান্তটির নিতে বাধ সেধেছিলেন সেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি; যিনি ২০০৮ সালে জেনারেল মঈন উ আহমেদকে ঘোড়া উপহার দিয়ে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তী চূড়ান্ত করেছিলেন। আমাদের বাঙালি মহাপুরুষটি সাংঘাতিক করিতকর্মা ছিলেন। তিনি একই সঙ্গে পূর্ব ও পশ্চিমকে নাচাতে জানতেন।
কাশ্মীরে যারা স্বজন হারালেন, এই ব্যথা তারা একা বয়ে বেড়াবেন। অমিত শাহ কাশ্মীরে নিহতদের স্মরণে লাল কার্পেটে হেঁটে ফুলমাল্য অর্পণ করলে; আর নরেন্দ্র মোদি সৌদি আরব সফর সংক্ষিপ্ত করে ধীর পায়ে বিমান থেকে নেমে; শোক সন্তপ্ত পরিবারগুলোর সামনে অশ্রুজলে সিক্ত হলে; অপরাজেয় পশ্চিমবঙ্গ সামনে নির্বাচনে বিজেপির ছায়াতলে চলেও আসতে পারে। নিউটনের তৃতীয় সূত্রে প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে। মোদির প্রথম সূত্রে প্রতিটি ইসলামি সন্ত্রাসি হামলায় বিজেপির ভোট বাড়ে।
মোদি শুধু নিজের দিকটা দেখেন না; পাকিস্তানের শরিফ পরিবারের দিকটাও দেখেন। মোদি হঠাত বিমান ঘুরিয়ে লাহোরে নেমে নওয়াজ শরিফের ছেলের বিয়েতে কবজি ডুবিয়ে খেয়েছিলেন। আর আজ থেকে ভারতের মিডিয়ায় কাশ্মীর হামলার জন্য পুনঃ পুনঃ পাকিস্তানকে দায়ী করা হলে; পাকিস্তনের মিডিয়া ব্যস্ত হয়ে পড়বে ভারত ইস্যুতে। জনপ্রিয়তম নেতা ইমরান খানকে জেলে রেখে যে শরিফ প্রশাসন অজনপ্রিয় হয়ে উঠেছে; তা দেশপ্রেমের তেলে খানিকটা জনপ্রিয়তার পরোটা ভাজবে।
ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য ৭৮ বছর ধরে এমন ছদ্ম উত্তেজনার আয়োজন আছে। রাজনীতির খেলায় পাবলিককে ভেড়ার মতো জবাই করে রাজনীতিক ও সেনারা; আর তা নিয়ে মত্ত হয়ে পাবলিক ভেড়ার মতো শিং ঘষে। ওদের শত্রু পাকিস্তান কিংবা ভারতে নেই; ওদের শত্রু হিন্দু কিংবা মুসলমানে নেই; ওদের শত্রু আছে পাওয়ার করিডোরের লাশ কাটা ঘরে। কি করে ৭৮ বছর ধরে পাবলিককে বলি ও কুরবানি দিয়ে দেশলুন্ঠনের বার বি কিউ চলছে; তা বোঝার সক্ষমতা কজনের আছে। এমনকি সামান্য শিক্ষিত হলেও ভেতরে হিন্দু ও মুসলমানের কুঁচকুঁচানি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় শিং ঘষছে কত উপমানব।
একই চিত্রনাট্যে ৭৮ বছর; ভাবা যায় হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ ডিএনএ-এর মধ্যে এতোই কিলবিল করে যে; একই চিত্রনাট্যে হত্যাকাণ্ডের নাটক মঞ্চায়ন করে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে অনন্ত মাংসের কারবার।
উপায়হীন মানুষের এই বিষাদসিন্ধুতে স্বজনের মৃতদেহ নিয়ে সবহারানোর দুঃসহ কষ্ট নিয়ে আমরা পাথর চোখে তাকিয়ে থাকি। আমরা ক্যানিবাল পলিটিকসের খপ্পরে পাল্লায় পড়েছি। আমরা রক্তপিপাসু হায়নার জঙ্গলে আটকে গেছি। যে দিকে তাকাই হিন্দু-মুসলমান বিদ্বেষের ফাঁদ।