
আবার লাশের সারি। থরে থরে সাজানো লাশ। দেশপ্রেমী ফিলিস্তিনিদের লাশ। রক্তে ভিজে আছে লাশ বহনকারী ব্যাগ বা কাফনের কাপড়। এমন লাশের সারির মাঝে হতবিহ্বল, কিংকর্তব্যবিমূঢ় শিশু। অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গেছে তার। মানবিক অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছে তারা। অনেক শিশু এখন এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুকেই স্বাগত জানাতে চায়। গাজার নিরীহ মানুষের ওপর ইসরাইলের নতুন করে নৃশংস, বর্বর হামলার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিশ্বনেতারা। কিন্তু তাতে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কিছু এসে যায় না। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পেয়ে পূর্ণোদ্যমে নতুন করে যুদ্ধ শুরুর ঘোষণা দিয়েছেন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র খলিল আল দাকরান জানিয়েছেন ১৮ই মার্চ থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ইসরাইলের এই বর্বরতায় নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ৭১০ জন ফিলিস্তিনি। এ সংখ্যা শুধু যাদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে তাদের। এর বাইরে বহু মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন। তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
নিহতদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। তাদের শতকরা হার প্রায় ৭০ ভাগ। এ সময়ে আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৯০০ ফিলিস্তিনি। বহু মানুষ আহত হওয়ার পর জরুরি চিকিৎসার অভাবে মারা গেছেন। চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোতে মৌলিক সরঞ্জাম ও ওষুধের ভয়াবহ সংকট চলছে। এর ওপর গাজায় সব রকম সহায়তা বা ত্রাণ সরবরাহ নিষিদ্ধ করেছে ইসরাইল। গাজা থেকে আল জাজিরার সাংবাদিক বলছেন, গাজার উত্তর ও দক্ষিণে বৃহস্পতিবার খুব ভোরে ইসরাইল ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে। এতে কমপক্ষে ৭১ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এই হামলায় বিমান বাহিনীর সঙ্গে অংশ নেয় ইসরাইলের পদাতিক বাহিনী। গাজা উপত্যকায় হামাসের বিরুদ্ধে ভয়াবহ ও তীব্র যুদ্ধ শুরুর পাশাপাশি দখলীকৃত পশ্চিমতীরে বৃহত্তর এবং শক্তিশালী হামলার সতর্কতা দিয়েছেন নেতানিয়াহু। এ অবস্থায় গাজার দক্ষিণাঞ্চল থেকে উত্তরাঞ্চলের দিকে অধিবাসীদের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ইসরাইলি সেনাবাহিনী। তাদের এক মুখপাত্র আভিচাই আড্রাই গাজার সালাহ আল-দিন সড়কে ফিলিস্তিনিদের সফর করতে বারণ করেছেন। বলা হয়েছে, সেখানে ইসরাইলি সেনাবাহিনী স্থল অভিযান শুরু করেছে। তবে উপকূলবর্তী আল রশিদ সড়ক দিয়ে তারা চলাচল করতে পারে। এমন অবস্থায় নতুন করে বেসামরিক নিরস্ত্র লোকজনের বিরুদ্ধে হামলা শুরু করায় জয়েন্ট আরব-ইসলামিক এক্সট্রা অর্ডিনারি সামিট অন গাজার মিনিস্টেরিয়াল কমিটি কড়া নিন্দা জানিয়েছে।
ফিলিস্তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশিত এক বিবৃতি অনুযায়ী, এই কমিটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তাদের নৈতিক, আইনগত দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়েছে। একই সঙ্গে আগ্রাসন ও নিয়ম ভঙ্গ বন্ধ করতে ইসরাইলের ওপর চাপ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছে তারা। ২০২৩ সালের নভেম্বরে এই কমিটি গঠিত হয়েছে। এর সদস্য কাতার, সৌদি আরব, মিশর, জর্ডান, বাহরাইন, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়া, ফিলিস্তিনি, আরব লীগ ও ওআইসি। এরই মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার এবং জাতিসংঘের কর্মকর্তারা এই ভয়াবহতার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, অসহনীয় পর্যায়ের দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন গাজায় অবস্থানকারী ফিলিস্তিনিরা। অন্যদিকে ফিলিস্তিনি শরণার্থী বিষয়ক জাতিসংঘের এজেন্সির প্রধান ফিলিপ্পে লাজারিনি সতর্ক করে বলেছেন, এই যুদ্ধ পৃথিবীকে নরক বানিয়ে দিতে পারে। ইসরাইলের হামলাকে ভয়াবহ বলে বর্ণনা করে তা অবিলম্বে অবশ্যই বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান ভলকার তুর্ক। ফিলিস্তিনের দখলীকৃত অঞ্চলে জাতিসংঘের মানবিক সমন্বয়ক মুহান্নাদ হাদি ইসরাইলের এই নতুন হামলাকে কাণ্ডজ্ঞানহীনের কাজ বলে অভিহিত করেছেন। বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড লেমি সোমবার বলেছেন, গাজায় ত্রাণ বন্ধ করে দিয়ে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে ইসরাইল। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমারের মুখপাত্র হামলায় বেসামরিক জনগণের হতাহত হওয়াকে হতাশাজনক বলে মন্তব্য করেছেন। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ত্রাণ বিষয়ক কমিশনার হাদজা লাহবিব বলেন, গাজায় উত্তেজনা বৃদ্ধি ভয়াবহ। বেসামরিক জনগণ অকল্পনীয় দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। এটা অবশ্যই বন্ধ হতে হবে।
এমন অবস্থায় হামাস বলেছে, ইসরাইলের হামলা বন্ধ করার জন্য মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। হামাসের মুখপাত্র আবদুল লতিফ আল-কানৌ বলেন, আমাদের জনগণের বিরুদ্ধে স্থায়ী যুদ্ধ বন্ধ করতে মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে কাজ করছি। গাজা থেকে ইসরাইলিদের প্রত্যাহার নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে। ফিলিস্তিনিদের অনাহারে রাখা বন্ধ করতে এবং অবরোধ তুলে নেয়ার জন্য আরব লীগ ও ওআইসিকে জরুরি পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। ওদিকে হামাসের হাতে যেসব জিম্মি এখন আছেন, তাদের পরিবারের সদস্যরা ইসরাইলের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। বৃহস্পতিবার নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নেতানিয়াহু সরকার সেই বৈঠক মুলতবি করে। ফলে জিম্মিদের পরিণতি নিয়ে আত্মীয়দের মধ্যে হতাশা বৃদ্ধি পাচ্ছে।