
তেরো মাস আগে যুদ্ধের মধ্যেই প্রথম সন্তানের জন্ম দেন আফনান আল-গানাম। তখন তার পরিবার গাজা উপত্যকায় নিজেদের বাড়িতে বাস করতেন। চলতি বসন্তে তিনি দ্বিতীয়বার সন্তানসম্ভবা হয়েছেন। এই সময়ে তারা একটি দারিদ্র্যপীড়িত তাঁবুর নিচে বাস করতেন। পনেরো মাস যুদ্ধ শেষে একটি নাজুক যুদ্ধবিরতি তাদের মধ্যে কিছুটা প্রশান্তি এনেছিল।
কিন্তু মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর (আইডিএফ) বিমান হামলায় তাদের তাঁবুটি মাটিতে মিশে যায়। সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা আফনান আল-গানাম ও তাদের প্রথম সন্তান মোহাম্মদ- দুজনেই নিহত হয়েছেন।
সেদিন সেহরির সময় আকস্মিকভাবে ঝাঁকে ঝাঁকে যুদ্ধবিমান এসে গাজায় বোমা ফেলতে শুরু করে। এতে চার শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। ভূখণ্ডটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এমন তথ্য নিশ্চিত করেছে। পণবন্দীদের ছেড়ে দিতে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসকে বাধ্য করতে গাজায় হামলা করা হচ্ছে বলে দাবি করেছে ইসরাইল।
‘তারা আমাদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে,’ বলেন আফনানের স্বামী আলা আবু হেলাল। দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খান ইউনিসে নাসের হাসপাতালে কাপড় দিয়ে ঢাকা ছোট্ট মোহাম্মদের লাশ নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি।
আবু হেলাল বলেন, ‘যুদ্ধের এক কঠিন সময়ে সে জন্ম নিয়েছে, যুদ্ধেই শহীদ হয়েছে।’
কথা বলার সময় চোখের পানি ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছিল এই ফিলিস্তিনি তরুণের। তিনি বলেন, ‘তাদের লক্ষ্যবস্তু নিষ্পাপরা। তারা খুব কমই জীবন দেখেছে।’
গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রাফায় পারিবারিক বসতি দেখতে গিয়েছিলেন আবু হেলাল। ঠিক তখনই মাওসিতে তাদের তাঁবুতে বিমান হামলা চালায় ইসরাইল। খান ইউনিসের বিস্তৃত এলাকাজুড়ে উদ্বাস্তু পরিবারগুলোর তাঁবু এই মাউসি এলাকায় অবস্থিত।
যুদ্ধের সময় রাফায় তাদের বাড়িটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখান থেকে কোনো কিছু লুট হয়েছে কিনা তা দেখতে যান তিনি। ২০ বছর বয়সী এই তরুণ বলছিলেন, ‘আমাকে একা রেখে তারা সবাই চলে গেছে। অনাগত শিশুটিও নিহত হয়েছে।’
গেল বছরের মে মাসে আবু হেলালের পরিবারকে রাফা ছাড়তে বাধ্য করে ইসরাইলি বাহিনী। তার কিছুদিন আগে জন্ম নেয় তার প্রথম সন্তান মোহাম্মদ। যুদ্ধে রাফাহ অঞ্চলের বেশিভাগ বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
‘পরিবার ও শিশুদের নিরাপদ রাখতে আমরা পালিয়ে গেলাম। কিন্তু তারপরও তারা নিহত হলো,’ বলেন ফিলিস্তিনি এই তরুণ।
এদিকে গাজা উপত্যকার নেতজারিম করিডোরের একটি অংশ ফের দখলে নেয়ার পর ভয়াবহ হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছে ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাৎজ। গাজায় এমন তীব্র হামলা চালানো হবে যা আগে কেউ কখনো দেখেনি বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
স্থানীয় সময় বুধবার (১৯ মার্চ) উত্তর ও দক্ষিণ গাজাকে বিভক্তকারী কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলটিতে সেনা মোতায়নের তথ্য নিশ্চিত করেছে ইসরাইল প্রশাসন। নেতজারিম করিডোর ইসরাইলি সীমান্ত থেকে উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত।
করিডোরটি দখলে নেয়ার পর বুধবার এ সংক্রান্ত এক বিবৃতিতে আইডিএফ জানায়, জানুয়ারিতে যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম ধাপ কার্যকর হলে এই অঞ্চলটি থেকে সেনাপ্রত্যাহার করা হয়েছিল। কিন্তু ফের সেখানে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া যুদ্ধে প্রায় ৪ মাইল দীর্ঘ এই করিডোরটিকে একটি সামরিক অঞ্চল হিসেবে ব্যবহার করেছে ইসরাইল।
যুদ্ধকালীর উত্তর গাজার অনেকেই পালিয়ে দক্ষিণ গাজায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। পনেরো মাসের সংঘাত শেষে করিডোর থেকে আইডিএফ সেনারা সরে গেলে অনেকেই উত্তর গাজায় ফিরে যান।
নেতজারিম করিডোর দখলের পর অঞ্চলটি থেকে সব ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে দেয়ার কথা জানিয়েছে ইসরায়েল কাৎজ। তিনি জানান, মঙ্গলবারের বিমান হামলা তো কেবল শুরু।
কাৎজ বলেন, ‘হামাস যদি পণবন্দীদের মুক্তি না দেয়, তাহলে এমন ভয়াবহ হামলা চালানো হবে, যা আগে কেউ কখনো দেখেনি।’
সূত্র : ইউএনবি