
পাঁচ বছর আগে যে ভাইরাসটি কোভিড-১৯ মহামারি সৃষ্টি করে, তার জন্য বিজ্ঞানীরা ‘র্যাকুন কুকুর’কে দায়ী করেছেন। বিজ্ঞানীদের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস ছড়ানোর পেছনে এই ‘র্যাকুন কুকুর’ (Raccoon Dogs) প্রাণীটিই বেশি অপরাধী।
বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী ‘ন্যাচার’-এর এক গবেষণা নিবন্ধে এই তথ্য উঠে এসেছে। বিজ্ঞানীদের এক ডজনের বেশি গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এই নিবন্ধ তৈরি হয়। এতে বলা হয়, চীনের উহানের হোয়ানান সিফুড মার্কেট হলো কোভিড-১৯ ছড়ানোর উৎসস্থল বা প্রাদুর্ভাবের কেন্দ্রস্থল। এই মার্কেট থেকে বিক্রি হওয়া ‘র্যাকুন কুকুর’ থেকে ভাইরাসটি প্রথমে মানুষের শরীরে যায়। ক্যালিফোর্নিয়ার লা জোলায় অবস্থিত স্ক্রিপস রিসার্চের বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানী ক্রিস্টিয়ান অ্যান্ডারসেন বলেন, ‘র্যাকুন কুকুর’ই মূল কালপ্রিট। আমরা একেই বড় করে ফোকাস করছি। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজিস্ট অ্যাডওয়ার্ড হোমসসহ কিছু বিজ্ঞানী এর আগে ‘র্যাকুন কুকুর’ দায়ী বলে আসছিলেন। বর্তমান গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে তাদের বক্তব্য প্রমাণিত হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারিতে ২০২৪ সালের ১৩ এপ্রিল ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্যমতে ৭০ লাখ ১০ হাজার ৬৮১ জন মারা যান। আক্রান্তের সংখ্যা ৭০ কোটি ৪৭ লাখ ৫৩ হাজার ৮৯০ জন। কোভিড-১৯ সংক্রমণের প্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ‘বৈশ্বিক মহামারি’ ঘোষণা করে। সেই সঙ্গে দেশগুলোকে করোনা মোকাবিলায় জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। করোনার বেশ কয়েকটি কার্যকর টিকা আবিষ্কৃত হয় এবং এই টিকা মহামারির লাগাম টেনে ধরে।
‘What sparked the COVID Pandamic? Mounting evidence points to raccon dogs’ শীর্ষক ন্যাচারের নিবন্ধে বলা হয়, দক্ষিণ চীনে বসবাসকারী ‘হর্সশু বাদুড়’ থেকে ভাইরাসটি মধ্যবর্তী প্রাণী ‘র্যাকুন কুকুর’কে সংক্রামিত করেছে এবং এ কুকুরই মানুষের মধ্যে তা ছড়িয়ে দিয়েছে। র্যাকুন কুকুর খুব সাধারণ ভাইরাল হোস্ট। উহানের হোয়ানান সিফুড মার্কেটে ‘র্যাকুন কুকুর’ বিক্রি হতো। প্রতি মাসে এই বাজার থেকে ৩৮টি র্যাকুন কুকুর বিক্রি হয়। ওখানে সাতটি স্টলে র্যাকুন কুকুর বিক্রির জন্য রাখা হয়। হোয়ানান বাজারে ডিসেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত বিক্রির রেকর্ডে প্রতি মাসে গড়ে ৩৩২টি জীবন্ত প্রাণী ছিল। বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখেছেন, র্যাকুন কুকুর সার্স-কোভ-২ (SARS-CoV-2) দ্বারা সংক্রামিত এবং নিজেরা অসুস্থ না হওয়া সত্ত্বেও মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীতে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। চীন বিশেষ করে উহানের নাগরিকরা খাদ্য হিসেবে র্যাকুন কুকুরের মাংস খান এবং তারা র্যাকুন কুকুরের পশমও ব্যবহার করেন।
২০০৩ সালে চীনের গুয়াংডংয়ের একটি জীবন্ত প্রাণী বাজারে বেশ কয়েকটি সিভেট এবং র্যাকুন কুকুরের মধ্যে যে ভাইরাসের উপস্থিতি গবেষকরা পেয়েছিলেন, তার সঙ্গে করোনাভাইরাসের মিল খুঁজে পাওয়া যায়, যা গুরুতর তীব্র শ্বাসযন্ত্রে সিনড্রোম (SARS) সৃষ্টি করে। এই আবিষ্কার গবেষকদের সার্স-কোভ-২-এর এই র্যাকুন কুকুরের সংবেদনশীলতা অনুসন্ধান করতে সহযোগিতা করে। উহানের বাজারগুলোয় বন্য র্যাকুন কুকুর দেখা যায় এবং প্রায়ই অনেক ভাইরাস দ্বারা এগুলো সংক্রামিত। কোভিড-১৯ মহামারির প্রেক্ষিতে উহানের জীবন্ত প্রাণী বিক্রির বাজারটি বন্ধ করে দেওয়া হয়, যেখানে পশমের জন্য এবং খাদ্য হিসেবে র্যাকুন কুকুর বিক্রি হতো। গবেষকরা বলেন, হোয়ানান বাজারে থাকা প্রাণীদের মধ্যে র্যাকুন কুকুর, সিভেট, বাঁশের ইঁদুর এবং বৃহত্তর হগ ব্যাজারের পরিসর বাদুড়ের সঙ্গে ওভারল্যাপ করেছে, অর্থাৎ করোনাভাইরাস বহন করেছে।
করোনাভাইরাসের উৎস সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা মহামারির শুরু থেকে গবেষণা চালিয়ে আসছেন। ভাইরাসটির উৎস প্রাণী না ‘ল্যাব লিক’-এ নিয়ে বিতর্ক চলেছে বিগত দিনগুলোয়। তবে বিজ্ঞানীরা মোটামুটি একমত হয়েছেন, কোভিড-১৯-এর উৎপত্তি প্রাকৃতিকভাবেই হয়েছে। বর্তমান গবেষণায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, হর্সশু বাদুড় থেকে মধ্যবর্তী প্রাণী হিসেবে র্যাকুন কুকুরের শরীরে প্রথম এসেছে করোনাভাইরাস। এরপর এটি ছড়িয়েছে উহানের মানুষের মধ্যে। সেখান থেকে কোভিড-১৯ সৃষ্টিকারী ভাইরাসটি বিশ্বজুড়ে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল।
মহামারির শুরুতেই বিজ্ঞানীরা ‘হর্সশু বাদুড়’কে করোনাভাইরাসের জন্য সন্দেহ করেছিলেন; কারণ এর আগে ২০০২ সালে সার্স ভাইরাসের জিনের গঠনও হর্সশু বাদুড়ে থাকা ভাইরাসের জিনের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। বর্তমানে সার্স-কোভ-২ ভাইরাস অর্থাৎ করোনাভাইরাসের জিনের গঠনের সঙ্গে হর্সশু বাদুড়ের জিনের গঠনের মিল পাওয়া গেছে। তবে বিজ্ঞানীরা বলেন, হর্সশু বাদুড় সরাসরি মানুষের মধ্যে ভাইরাসটি ছড়িয়ে দেয়নি। মানুষ ও বাদুড় দুইয়ের মাঝখানে আরেকটি প্রাণী এটি ছড়িয়েছে।
প্রথমদিকে বিজ্ঞানীরা সেটি প্যাংগোলিন (বাংলাদেশে ‘বনরুই’ নামে পরিচিত) বলে সন্দেহ করেছিলেন। এবার তারা র্যাকুন কুকুরই সেই প্রাণী হিসেবে প্রমাণ পেয়েছেন। ভাইরাসের উৎস যে বাদুড় এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত। কারণ ঝুঁকিপূর্ণ রোগগুলোর বাহক হিসেবে যেসব প্রাণীকে মনে করা হয়, বাদুড় এর মধ্যে অন্যতম। একমাত্র অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ ছাড়া বিশ্বের সর্বত্রই বাদুড় আছে এবং এর প্রজাতির সংখ্যা ১৪ হাজারের বেশি। স্তন্যপায়ীদের মধ্যে বাদুড়ের সংখ্যাই ২০ শতাংশ। নিরীহ মনে হলেও নভেল করোনাভাইরাস, সার্স, মার্স, মারবার্গ, ইলোনা, হেন্দ্রা, নিপাহর মতো প্রাণঘাতী ভাইরাসসহ অন্তত ১৩০টির বেশি প্রজাতির ভাইরাস বহন করে বাদুড়। এর মধ্যে হর্সশু বাদুড়ের দেহেই এসব প্রাণঘাতী ভাইরাস বেশি পাওয়া যায়। হর্সশু বাদুড় নামের কারণÑএ শ্রেণির বাদুড়ের নাকের ওপরটা ঘোড়ার খুরের আকৃতির।
বাদুড় গবেষকদের কথা
বাদুড় নিয়ে গবেষণার জন্য চীনের শীর্ষস্থানীয় ভাইরোলজিস্ট শি ঝেংলি বিশ্বজুড়ে এরই মধ্যে ‘ব্যাট ওম্যান’ বা ‘বাদুড় মানবী’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। তিনি বাদুড়ের শরীর থেকে অজানা অসংখ্য ভাইরাসের সন্ধান করে আসছেন। তিনি উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির প্রধান। এ প্রতিষ্ঠানই কোভিড-১৯ বিতর্কের শীর্ষে রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে উহানের এ প্রতিষ্ঠান থেকেই করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে, যাকে ‘ল্যাব লিক’ হিসেবে বলা হচ্ছে। কারণ এ প্রতিষ্ঠানে ‘হর্সশু বাদুড়’ থেকে করোনাভাইরাসের জীবাণু নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। এ গবেষণাগার সম্পর্কে শি ঝেংলি বলেন, তাদের গবেষণা খুবই সতর্কতার সঙ্গে করা হয়। তা ছাড়া গবেষকদের পরীক্ষা করেও দেখা গেছে, সবাই করোনাভাইরাস নেগেটিভ। সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক টাইমসের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারেও ঝেংলি বলেন, ল্যাব লিক ঘটনার কোনো প্রমাণ নেই, বিশ্ব কী করে তা প্রমাণ করতে চায়? কীভাবে একজন নিরপরাধ বিজ্ঞানীকে এমন দোষে দোষী বলে বলা হচ্ছে?
ফরাসি প্রতিষ্ঠান সিরাডের জন্য ভাইরাস অনুসন্ধানীর কাজ করেন ড. ম্যাথিউ বুরওসায়েল। তিনিও একজন বাদুড় গবেষক।
আফ্রিকার জিম্বাবুয়ের বাদুড়ের গুহায় তিনি গবেষণার কাজে গিয়েছিলেন। সেখানকার প্রধানদের অনুমতি নিয়ে তিনি গুহায় ঢুকেছিলেন মাস্কে মুখ ঢেকে, কাপড়ে গা ঢেকে ও তিন পরতের দস্তানা পরে। গুহাটিতে সর্বত্র বাদুড়ের দুর্গন্ধ। এতই বিষ্ঠা যে, বিষ্ঠার পরত ভেঙে তাকে অগ্রসর হতে হয়। এ সময় বাদুড়গুলোর ঘুম ভেঙে যায় এবং ডানা ঝাপটাতে থাকে। জিম্বাবুয়েতে মানুষ বাদুড়কে ‘ডানাওয়ালা ড্রাগন’, উড়ন্ত ‘ইঁদুর’ বা শুধু ‘শয়তান’ নামে ডাকে। বিবিসির রিপোর্টে বলা হয়, ড. বুরওসায়েল গুহা থেকে বিষ্ঠা অন্যান্য নমুনা ও বাদুড় সংগ্রহ করে এনে বাদুড়ের ভাইরাস জিন আলাদা করেন। তিনি ওই জিনের গঠন ও প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করে এরই মধ্যে বিভিন্ন ধরনের করোনাভাইরাস চিহ্নিত করেন। এর মধ্যে সার্স এবং সার্স-কোভ-২ ভাইরাসও রয়েছে।
চীনে ভাইরোলজিস্টদের একটি দল ২০১৭ সালে চীনের ইউনান প্রদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গুহার ভেতরে ‘হর্সশু ব্যাট’ নামে বিশেষ প্রজাতির বাদুড়ের আস্তানায় গিয়ে যে ভাইরাস সংগ্রহ করেন, তাতেও সার্স ভাইরাসের জিন পাওয়া গিয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস টেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাদুড় নিয়ে ডক্টরেট করছেন ইরোরা তানিশি। এই গবেষক বাদুড়ের ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। তিনি বলেন, বাদুড় এক অসাধারণ সৃষ্টি। বাদুড়ের কথা উঠলেই তার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘আমি বহু গুহা, জঙ্গল, পাহাড় পর্বত এবং তৃণভূমি অনুসন্ধান করেছি। দেখেছি বাদুড় প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য চমৎকারভাবে বিবর্তিত হয়েছে। বাদুড়ের দেহে উন্নত রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা আছে, যা রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীবকে সহ্য করতে পারে।’
ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের অধ্যাপক লিন-ফা ওয়াংয়ের নেতৃত্বে একদল বাদুড় গবেষক থাইল্যান্ডের একটি কৃত্রিম বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে হর্সশু প্রজাতির বাদুড়ের মধ্যে সার্স-কোভ-২-এর কাছাকাছি ভাইরাস শনাক্ত করেন। ‘র্যাকসিএস-২০৩’ নামে ভাইরাসটির সঙ্গে সার্স-কোভ-২-এর জিনের গঠনের মিল রয়েছে। তেমনি আরেকটি ‘আরএমওয়াইএন-০২’ ভাইরাসের সঙ্গেও কোভিড-১৯-এর জিনগত মিল পাওয়া যায়।