
ফিলিস্তিনিদের গাজা থেকে বিতাড়িত করার যে পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, তা প্রত্যাখ্যান করেছে মিসর, সৌদি আরব ও জর্ডান। তার জঘন্য বক্তব্যের ফলে এই তিন দেশের সরকার ও মিডিয়ার ভাষ্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। গাজায় ইসরাইলি গণহত্যার বিরোধিতা করার জন্য অনেকেই যে ঐকমত্যের আহ্বান জানিয়েছিলেন, এ ঘটনা দেশগুলোকে সে পথেই এগিয়ে নিয়ে গেছে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলি প্রস্তাবের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় সৌদি আরবের ভিন্ন সুর দেখা গেছে। বিশেষ করে যখন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বললেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট জায়গা সৌদি আরবে আছে।
কূটনীতিতে পরিবর্তন
গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উৎখাতের বিপক্ষে নিজেদের দৃঢ় অবস্থানের কথা জানিয়েছে জর্ডান। ট্রাম্পের সঙ্গে বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহর দুর্ভাগ্যজনক এক মন্তব্যের বিরুদ্ধে ব্যাপক আরব প্রতিক্রিয়ার পর আসে এ ঘোষণা।
ট্রাম্প ও আবদুল্লাহর বৈঠকের পর গত সপ্তাহে মিসর আনুষ্ঠানিক এক বিবৃতিতে ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক অস্থিতিশীল হওয়ার সম্ভাবনার কথা জানায়। এতে উল্লেখ করা হয়, ‘ফিলিস্তিনি সমস্যার সমাধানে যেকোনো দৃষ্টিভঙ্গিতে এই অঞ্চলে অর্জিত শান্তিকে বিপন্ন করা এড়িয়ে চলার কথা বিবেচনা করা উচিত।’ দেশটির প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসির ভাষণে ‘উৎখাত প্রস্তাব’ প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে এবং বাস্তুচ্যুত গাজাবাসীদের তাদের ভূমিতে ফিরে যাওয়ার প্রশংসা করা হয়েছে।
এমনকি উপসাগরীয় এবং মিসরীয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অসংখ্য জনপ্রিয় ব্যবহারকারী ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে নিজেদের সহানুভূতি দেখাচ্ছেন, যারা পূর্বে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সম্পর্কে নেতিবাচক এবং গণহত্যা নিয়ে অস্পষ্ট বার্তা ছড়িয়েছিলেন।
ট্রাম্পের প্রস্তাবের উল্টো ফল
সাম্প্রতিক দশকগুলোয় আরবদের অবস্থানের প্রেক্ষাপটে এ অঞ্চলে বর্তমানে একটি অস্বাভাবিক দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। এটি কেবল ফিলিস্তিনি জনগণের দৃঢ়তা এবং তাদের প্রতিরোধের কারণে নয়; বরং ট্রাম্পের প্রস্তাবের ‘আশীর্বাদের’ কারণে।
ট্রাম্পের প্রস্তাব স্পষ্টভাবে ইসরাইলি নেতাদের এবং বিশ্বব্যাপী ইহুদিবাদী লবির আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। বাইবেলের প্রতিশ্রুতির ওপর ভিত্তি করে তাদের স্বপ্ন ফিলিস্তিন খালি করা এবং আরবদের ইহুদিদের দ্বারা প্রতিস্থাপন করা।
মধ্যপ্রাচ্যের এসব জটিল হিসাব-নিকাশ সম্পর্কে ট্রাম্পের অজ্ঞতা পরিষ্কার। কিন্তু নেতানিয়াহু স্পষ্টভাবে বোঝেন যে, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সমীকরণ থেকে দুটি স্তরে ‘জনগণকে মুছে ফেলার’ মাধ্যমেই কেবল বাস্তুচ্যুতি সফল হতে পারে।
প্রথমটি হলো- লিকুদ পার্টি (ইসরাইলের প্রধান ডানপন্থি রাজনৈতিক দল) ফিলিস্তিনি জনগণ এবং আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের অধীন তাদের অবিচ্ছেদ্য অধিকারগুলো অবজ্ঞা করছে। পাশাপাশি আত্মনিয়ন্ত্রণ, জাতীয় স্বাধীনতা, ভূমির মালিকানা, নাগরিকত্ব, সার্বভৌমত্ব ও জীবন, বাসস্থান এবং চলাচলের অধিকারের মতো অ-হস্তান্তরযোগ্য অধিকারগুলোও ক্ষুণ্ণ করছে।
আরব অনৈক্য
দ্বিতীয় স্তর হলো- আরব শাসকদের নীতি এবং তাদের জনগণের ইসরাইলবিরোধী, স্বাভাবিকীকরণ বিরোধী অবস্থানের মধ্যে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতা।
আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, মিসর-ইসরাইল শান্তিচুক্তির পর থেকে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারের প্রচেষ্টা সফলভাবে প্রভাবশালী শাসনব্যবস্থা এবং ব্যক্তিত্বদের প্রভাবিত করেছে। এ প্রচার কিছু প্রতিষ্ঠানের মতবাদ পরিবর্তন করেছে এবং প্রভাবিত করেছে কিছু অভিজাত শ্রেণিকেও। এর লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনিদের স্বার্থকে অঞ্চলের জনগণের ভাগ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করা এবং সরকারি সম্পৃক্ততাকে হয় একটি কেন্দ্রীয় কিন্তু গুরুত্বহীন বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করা। ট্রাম্পের প্রস্তাবের পর আরব বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিতে বিলম্বই ইহুদিবাদী এবং মার্কিন প্রচেষ্টার সাফল্যের একটি দুঃখজনক প্রমাণ।
বাস্তুচ্যুতির বিরুদ্ধে আরব ঐক্য
বাস্তুচ্যুতি ঠেকাতে আরব সরকারগুলোকে- বিশেষ করে মিসর, সৌদি আরব, জর্ডান এবং কাতারকে তাদের জনগণের সর্বোচ্চ স্বার্থ এবং ভবিষ্যতের বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। ট্রাম্পের ব্ল্যাকমেইল এবং নেতানিয়াহুর উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে আরবদের একমাত্র সুরক্ষা হলো তাদের জনগণের সঙ্গে শাসনব্যবস্থার সমন্বয় সাধন। এটি অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক উন্মুক্ততা, বিরোধীদের সঙ্গে পুনর্মিলন এবং আঞ্চলিক অস্থিরতার বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ ফ্রন্টকে শক্তিশালী করতে স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব।
ট্রাম্পের হুমকি কঠোর পরীক্ষার আড়ালে একটি ‘শেষ সুযোগ’ নিয়ে এসেছে। সম্ভবত এটি আরবদের শাসক এবং শাসিত উভয়কেই আত্মতুষ্টি, স্বার্থপরতা, বিস্মৃতি এবং পরাধীনতা থেকে ধীরে ধীরে শুদ্ধ করতে বাধ্য করবে এবং তারা একদিন গণহত্যার বোঝা, বিশ্বাসঘাতকতা এবং অতীতের ভুল থেকে মুক্ত হয়ে জেগে উঠবে। তবেই আমরা সত্যিকারার্থে ভবিষ্যতের কথা বলতে পারব।