![Image description](https://content.bdtoday.net/files/img/202502/fedc7f3f9ccd369b64df8b6993736eba.png)
‘হীরে আর জহরতে আগাগোড়া মোড়া সে, গাড়ি-বাড়ি সবকিছু দামি তাঁর’– প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী মান্না দে’র জনপ্রিয় এই গানে হীরাকে প্রতিপত্তি বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে। গত শতকের আশির দশকে লাখ টাকা থাকলেই দামি রত্নালংকারে সাজানো যেত প্রিয়জনকে। কিন্তু বর্তমান মূল্যস্ফীতির বাজারে কোটি টাকায়ও সেই শখ পূরণ করা কঠিন। তবে কঠিনকে সহজ করতে বিকল্পেরও অভাব নেই প্রযুক্তির এই যুগে।
বর্তমান সময়ে কৃত্রিম পণ্যে বাজার সয়লাভ। গয়নার বাজারও এর বাইরে নয়। ফলে প্রতিপত্তি দেখাতে স্বর্ণালংকার-রত্নালংকার অনেকটাই জৌলুস হারিয়েছে। তাই আসছে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবসে প্রিয় মানুষটিকে হীরার আংটি বা কানের দুল দিয়ে তাক লাগানোর পরিকল্পনা থাকলে দ্বিতীয়বার ভাবুন।
প্রেমের প্রস্তাব কিংবা বাগদানের জন্য হীরার আংটি জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে ‘ডি বিয়ার্সের’ বড় ভূমিকা আছে। লন্ডনভিত্তিক বিশ্বখ্যাত এই হীরার কোম্পানির চল্লিশের দশকে একটি বিজ্ঞাপন বেশ সাড়া ফেলে। বিজ্ঞাপনে প্রচার করা হয়– ‘আ ডায়মন্ড ইজ ফরএভার’ অর্থাৎ হীরা আজীবনের সঙ্গী। তাদের এই বিজ্ঞাপন তরুণ-তরুণীদের ভীষণ আকৃষ্ট করেছিল। এই বিজ্ঞাপনে হীরাকে দাম্পত্য জীবনের ভালোবাসা ও অঙ্গীকারের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল।
কিন্তু গত কয়েক দশকে অনেক কিছু বদলেছে। ল্যাবে উৎপাদিত হীরায় ছেয়ে গেছে বাজার। প্রাকৃতিক ও ল্যাবের হীরা আলাদা করাও বেশ কঠিন। পরীক্ষার যন্ত্রপাতি না থাকলে রত্নবিদের পক্ষেও দুটোতে তফাৎ করা দুরূহ।
যুক্তরাষ্ট্রের হীরার দাম নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠান র্যাপাপোর্টের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মার্টিন র্যাপাপোর্ট বলেন, ‘এক দশক আগেও বাজারে ল্যাবে উৎপাদিত হীরা ছিল হাতেগোনো। এখন আমেরিকার হীরার মার্কেটের প্রায় অর্ধেকেই দখল করে নিয়েছে ল্যাবে তৈরি হীরা।’
আমেরিকার গয়না বিক্রেতাদের তথ্য অনুযায়ী, তাদের বিক্রি হওয়া খোলা হীরা অর্থাৎ আংটি বা গয়নাতে বসানো হয়নি এমন হীরার অর্ধেকের বেশি ল্যাবে উৎপাদিত। অথচ ২০২০ সালের শুরুর দিকে বিক্রি হওয়া খোলা হীরার প্রতি দশটিতে ল্যাবের ছিল মাত্র একটি।
প্রযুক্তির কারণে গত কয়েক বছরে খনি থেকে হীরা উত্তোলনের চেয়ে ল্যাবে উৎপাদন অনেক বেশি সহজ হয়েছে। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে মূল্যের ওপর। বিশ্বের কোনো প্রথম সারির গয়নার দোকান ৫ হাজার ডলারে ল্যাবে উৎপাদিত যে হীরা দিতে পারে, তা প্রায় সমান গুণমানের খনির হীরার চেয়ে চারগুণ বড়।
ল্যাবে উৎপাদিত হীরা তাই কম রোজগারের যুগলদের জন্য আশীর্বাদ বলা যায়। তুলনামূলক কম দামে পেয়ে যাচ্ছে বড় আকৃতি, ভালো ফিনিশিংয়ের সুন্দুর হীরার আংটি। ভালোবাসার মানুষটির খুশির পাশাপাশি বড় হীরার কারণে সামাজিক মর্যাদাও বাড়ে!
ল্যাবে উৎপাদিত হীরায় ছেয়ে গেছে বাজার। ছবি: রয়টার্সযুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রতি একটি চোখে পড়ার মতো ঘটনা ঘটছে। দেশটি গড় আকৃতির হীরার আংটি কেনার হার বাড়লেও, অর্থের পরিমাণ কম পড়ছে। এর অর্থ হলো হীরা উৎপাদনকারীর সংখ্যা বাড়ায় ব্যবসায় প্রতিযোগিতা বেড়েছে, ফলে কমছে দাম। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, মূল্যস্ফীতির কারণে সব কিছুর দাম বাড়ায় পকেটে টান পড়ছে, তাই মানুষ কম খরচে আনুষ্ঠানিকতা সারছে।
এমন পরিস্থিতিতে ল্যাবে তৈরি হীরা বিক্রেতাদের পৌষ মাস চলছে, আর সর্বনাশ হচ্ছে খনির হীরা বিক্রেতাদের। র্যাপাপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ল্যাবে উৎপাদিত হীরা ক্রয় করে যুক্তরাষ্ট্র। ২০২২ ও ২৪ সালের মধ্যে দেশটির কাট অ্যান্ড পলিশড বা প্রাকৃতিক হীরের আমাদানি প্রায় অর্ধেক কমেছে। ডি বিয়ার্সের রাজস্ব কমেছে প্রায় এক তৃতীয়াংশ। তাই ভবিষ্যতের গয়নার বাজার ল্যাবে তৈরি হীরার দখলে যাবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
বাগদান বা বিয়ের আংটি প্রত্যেকের কাছেই বিশেষ। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে মধুর স্মৃতি, অনেক প্রত্যাশা। হীরা এক সময় দুষ্প্রাপ্য ও ব্যয়বহুল থাকায় জীবনের বিশেষ মুহূর্তকে এই রত্ন দিয়ে স্মরণীয় করতে চাইতেন যুগলেরা। কিন্তু কৃত্রিমতার ভীড়ে সেই অরা বা দ্যুতি হারিয়ে ফেলছে হীরা। তাছাড়া প্রিয় মানুষটিকে প্রাকৃতিক হীরা দেবেন, নাকি ল্যাবে বানানো হীরার দেবেন তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কতটা ভালোবেসে দিচ্ছেন।