Image description

দেশের মাদরাসাগুলোতে বাড়ছে শিক্ষার্থী সংখ্যা। মাদরাসাপড়ুয়ারা অনেক ক্ষেত্রে দারুণ সফলতাও দেখাচ্ছেন। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে তাদের সাফল্য উল্লেখযোগ্য। মাদরাসা শিক্ষা-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগের চেয়ে মাদরাসা শিক্ষা অনেকটা এগিয়েছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষাকেও ছাড়িয়ে গেছে।

মাদরাসা শিক্ষার নানান দিক নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিঞা মো. নূরুল হক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক আল-আমিন হাসান আদিব

জাগো নিউজ: একসময় সাধারণ শিক্ষা ও মাদরাসার মধ্যে বিস্তর তফাৎ ছিল। এখনো মাদরাসার শিক্ষার্থীদের কিছুটা অবজ্ঞা করা হয়। কিন্তু আপনি সম্প্রতি একটি সেমিনারে বলেছেন যে, সাধারণ শিক্ষার চেয়ে এখন মাদরাসা শিক্ষা ভালো। তাহলে কি মাদরাসা শিক্ষা অনেক এগিয়েছে?

অধ্যাপক মিঞা মো. নূরুল হক: যে যাই বলুক, মানুষ কোয়ালিটিপূর্ণ (মানসম্মত) শিক্ষা চায়। একসময় হয়তো মাদরাসায় সেটা অনুপস্থিত ছিল বা পরিকল্পিতভাবে সেই পথে মাদরাসাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। তাতে এখন পরিবর্তন এসেছে। মাদরাসার শিক্ষা অবশ্যই এগিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষার ধারা মাদরাসাগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম ছাড়িয়ে গেছে।

 

কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করা শিক্ষার্থীর সঙ্গে একই প্রশ্নে পরীক্ষা দিচ্ছে মাদরাসা থেকে আলিম পাস করা শিক্ষার্থীরা। তারা কলেজের ছাত্রদের টপকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গা করে নিচ্ছে। তাদের কোয়ালিটি আছে, সেটা তো স্বীকার করা উচিত

জাগো নিউজ: প্রায় চার দশক আগে দাখিল-আলিমকে এসএসসি-এইচএসসির সমমান দেওয়া হয়েছে। প্রকৃত অর্থে সমমান অর্জন করতে পেরেছে কি না?

অধ্যাপক মিঞা মো. নুরুল হক: যতদূর মনে পড়ছে, ১৯৮৫ সালে দাখিলকে এসএসসির সমমান ও ১৯৮৭ সালে আলিমকে এইচএসসির সমমান দেওয়া হয়। সেটা ২০১০ সালের দিকে সমমান অর্জন করে ফেলেছে বলে আমি মনে করি। তবে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার মাদরাসা শিক্ষাকে ধ্বংসের পাঁয়তারা করেছিল। সেজন্য পরিকল্পিতভাবে মাদরাসা শিক্ষার যে নির্যাস; ঈমান-আকিদা ও মূল্যবোধ তা শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল।

কিন্তু তাতে তারা সফল হতে পারেনি। এখন মাদরাসা শিক্ষাটা আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। সমমান তো বটেই, আগামী দিনে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় মাদরাসা শিক্ষার অবদান সবচেয়ে বেশি থাকবে বলে মনে করি। অভিভাবকরাও মাদরাসামুখী হচ্ছেন এবং হবেন।

জাগো নিউজ: মান বেড়েছে বলেই কি মাদরাসার দিকে ঝুঁকছেন অভিভাবকরা? নাকি ধর্মীয় মূল্যবোধ বড় কারণ?

অধ্যাপক মিঞা মো. নূরুল হক: দেখুন, বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ বুঝতে হবে। তারা চান সন্তানকে নৈতিকভাবে গড়ে তুলতে, তারা চান যেন মরার পর অন্তত বাবা-মায়ের জানাজাটা সন্তান পড়াতে পারে। সে স্কুলে পড়ুক বা কলেজে পড়ুক। কিন্তু ধর্মের মৌলিক শিক্ষাটা সবাই সন্তানকে দিতে চায়। সেজন্য তারাও মাদরাসার দিকে ঝুঁকছেন।

আমরা পাঠ্যবইয়ে থাকা কিছু কনটেন্ট, ছবি চিহ্নিত করেছি, যেগুলো ইসলামি বিধি-বিধানের বিপরীতে যায় এমন কনটেন্টে পরিবর্তন আনার বিষয়ে কাজ করছি

পাশাপাশি এখন নূরানি মাদরাসা, ক্যাডেট মাদরাসা চালু হচ্ছে। সেখানে প্রাথমিক স্তর থেকে স্পোকেন ইংলিশ কোর্স করানো হয়। আবার আরবি স্পোকেন কোর্সও রয়েছে। তাহলে একসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ দুটি ভাষা শিখছে মাদরাসার শিক্ষার্থীরা। আবার নৈতিক শিক্ষাও পাচ্ছে। এই যে একের ভেতরে তিন ধরনের শিক্ষা- এটা সাধারণ শিক্ষায় অনুপস্থিত। ফলে মাদরাসায় ঝোঁক বাড়াটা স্বাভাবিক।

জাগো নিউজ: অনেকে বলেন ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, রাজশাহীর মতো বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় নাকি এখন মাদরাসায় পরিণত হয়েছে। চিন্তা-চেতনায় তারা মাদরাসার শিক্ষার্থীদের মতো হয়ে পড়ছে! এ ধরনের বাঁকা মন্তব্যকে কীভাবে দেখেন?

অধ্যাপক মিঞা মো. নূরুল হক: বিভিন্ন পক্ষ নয়। এটা বলে বেড়াচ্ছে পতিত স্বৈরাচার পক্ষ। এখন আমি যদি বলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাদরাসায় পরিণত হচ্ছে; সেখানে কি মাদরাসার ছাত্রদের জন্য কোটা আছে? তারা কি বিশেষ সুবিধা নিয়ে ভর্তি হচ্ছে? কোন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়ে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে?

কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করা শিক্ষার্থীর সঙ্গে একই প্রশ্নে পরীক্ষা দিচ্ছে মাদরাসা থেকে আলিম পাস করা শিক্ষার্থীরা। তারা কলেজের ছাত্রদের টপকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গা করে নিচ্ছে। তাদের কোয়ালিটি আছে, সেটা তো স্বীকার করা উচিত। তা নয়, উল্টো বলা হচ্ছে—কেন মাদরাসার ছাত্র ঢাবিতে চান্স পেলো? এটা কোন ধরনের যুক্তি?

জাগো নিউজ: মাদরাসার ছাত্র-ছাত্রীরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার ক্ষেত্রে ভালো অবস্থানে। এটার কারণ কী?

অধ্যাপক মিঞা মো. নূরুল হক: স্কুল-কলেজে পড়াশোনা ঠিকমতো হচ্ছে না, মাদরাসায় ভালো পড়াচ্ছে বলেই তো শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করছে। এটাই তো হওয়ার কথা। তাছাড়া এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই না। দেখুন, শুধু যে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাচ্ছে, তা তো নয়। এই যে ডাকসু নির্বাচন হলো—সেখানে ভিপি, জিএস, এজিএস—সবাই মাদরাসার। এমনকি যারা ফেল করেছে তাদের ভিপি প্রার্থীও মাদরাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের। তারাও যোগ্য। প্রত্যেকে খুব ভালো নেতৃত্বগুণেরও অধিকারী। এটার পেছনে নিশ্চয়ই তার দাখিল-আলিমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেটা মাদরাসা ছিল; তাদেরও অবদান আছে। তাদের যোগ্য করে গড়ে তুলেছে তো তারাই।

বাংলায় কিছু ছবি ব্যবহার করা হয়েছে, যেগুলোতে পর্দার যে বিধান তা সমুন্নত নেই। সেগুলোতে পরিবর্তন আনতে হবে। ইসলামি মূল্যবোধের সঙ্গে বা বিধি-বিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য—এমন ছবি ব্যবহার করার জন্য কাজ করছি আমরা। যেমন—অষ্টম শ্রেণির ইংরেজি বইয়ে মেয়েদের স্কার্ট পরা ছবি আছে। আমরা বলেছি, সেখানে ছবিতে জামাটা একটু বড় করে দিতে হবে

জাগো নিউজ: মাদরাসা শিক্ষার সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার তফাৎ এখন কতটা? পাঠ্যবই, সিলেবাস, পরীক্ষার ধরন বিষয়গুলোতে কতটা ফারাক আছে?

অধ্যাপক মিঞা মো. নূরুল হক: স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা যে পাঠ্যবই পড়ে, মাদরাসায়ও সেগুলোই পড়ানো হয়। বইয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বাংলা, ইংরেজি, গণিত, রসায়ন, পদার্থ, উচ্চতর গণিত সবই একই রকম। স্কুল-কলেজের বইয়ের মলাটে লেখা থাকে ‘নবম-দশম, মাধ্যমিক’, আর মাদারাসার বইয়ের মলাটের ওপর লেখা থাকে ‘নবম-দশম, দাখিল’, পার্থক্য যদি বলেন সেটা এতটুকুই।

উল্টো সাধারণ শিক্ষা বা স্কুল-কলেজে যে বইগুলো পড়ানো হয়, সেগুলো পড়ে অতিরিক্ত আরও কয়েকটি বিষয় মাদরাসা ছাত্র-ছাত্রীদের পড়তে হয়। এইচএসসিতে বিজ্ঞানে ১৩শ নম্বরের পরীক্ষা হয়। আর মাদরাসার বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের আলিমে ১৭শ নম্বরের পরীক্ষা। দাখিলেও এসএসসির চেয়েও বেশি নম্বরের পরীক্ষা দিতে হয়।

জাগো নিউজ: তারপরও যেহেতু মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। এখন কী ধরনের সংস্কার করলে তা আরও ‍যুগোপযোগী হবে বলে মনে করেন?

অধ্যাপক মিঞা মো. নূরুল হক: সংস্কার মানে শুধু সাধারণ শিক্ষার পেছনে ছোটা নয়। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। আর মাদরাসার শিক্ষার্থীদের অবশ্যই মানসম্মত-যুগোপযোগী শিক্ষার সঙ্গে ইসলামি জ্ঞানার্জন করতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা পাঠ্যবইয়ে থাকা কিছু কনটেন্ট, ছবি চিহ্নিত করেছি, যেগুলো ইসলামি বিধি-বিধানের বিপরীতে যায় এমন কনটেন্টে পরিবর্তন আনার বিষয়ে কাজ করছি।

যেমন—মাদরাসার গণিত বইয়ে সুদের হিসাব আছে। সেটি মুনাফা বা লাভ হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে। কারণ সুদ ইসলামে হারাম। ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে, অথচ সুদ লেখা হচ্ছে, সুদের হিসাব কষতে হচ্ছে, এটা গ্রহণযোগ্য নয়।

জাগো নিউজ: কিন্তু অনেকে তো এটা নিয়ে বেশ ঠাট্টা-মশকরা করেন। সুদ-লাভ-মুনাফাকে একই বলে প্রচার করা হয়। ইসলাম এটাকে কীভাবে দেখে?

অধ্যাপক মিঞা মো. নূরুল হক: যারা জেনে-বুঝে বলেন সুদ ও লাভ বা মুনাফা এক জিনিস, তারা তো কাফের। দেখুন, সুদ হলো ঝুঁকিমুক্ত। আপনি ঝুঁকিমুক্তভাবে টাকা দিলেন, সেখান থেকে নির্ধারিত সময় পর অতিরিক্ত টাকা পাবেনই। আর মুনাফা বা লাভ হলো—ব্যবসায় আপনি বিনিয়োগ করলেন, সেখানে লোকসানের ঝুঁকিও আছে; সেটা থেকে যখন লাভ হবে সেটা ইসলামে বৈধ। এখানে মাদরাসার বইয়ে পরিবর্তন আনাটা জরুরি। ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমরা বইগুলো সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছি।

জাগো নিউজ: অন্য কোনো বিষয়ে আপত্তিকর কিছু আছে কি না?

 

 

অধ্যাপক মিঞা মো. নূরুল হক: হ্যাঁ, বাংলায় কিছু ছবি ব্যবহার করা হয়েছে, যেগুলোতে পর্দার যে বিধান তা সমুন্নত নেই। সেগুলোতে পরিবর্তন আনতে হবে। ইসলামি মূল্যবোধের সঙ্গে বা বিধি-বিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য—এমন ছবি ব্যবহার করার জন্য কাজ করছি আমরা। যেমন—অষ্টম শ্রেণির ইংরেজি বইয়ে মেয়েদের স্কার্ট পরা ছবি আছে। আমরা বলেছি, সেখানে ছবিতে জামাটা একটু বড় করে দিতে হবে। তাছাড়া অনেক অমুসলিম লেখকের লেখার আধিক্য রয়েছে। সেটাও কমিয়ে আনার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া উচিত হবে বলে আমি মনে করি।