Image description

দীর্ঘ ৩৩ বছর পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনে ভোট গণনার ফল স্পষ্ট হওয়ার পর যে চিত্র উঠে এসেছে, তা ক্যাম্পাস রাজনীতির নতুন ভারসাম্যের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ‘সম্প্রীতি শিক্ষার্থী জোট’ নামে শিবির–সমর্থিত প্যানেল ২৬টি পদের মধ্যে ২৪টিতেই জয় পেয়েছে। অন্যদিকে ছাত্রদলের সমর্থিত প্রার্থীরা অনেক কেন্দ্রে এজেন্ট না বসানো, ফল ঘোষণায় অনুপস্থিত থাকা এবং রাতভর বিশৃঙ্খল আচরণের কারণে সমালোচনার মুখে পড়েছে।

ফল ঘোষণার সময় ভোর সাড়ে চারটার দিকে ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের অডিটোরিয়ামে উপস্থিত ছিলেন ‘সম্প্রীতি’ প্যানেলের সব প্রার্থী ও সমর্থকরা। তারা হাততালি, স্লোগান ও তসবিহ হাতে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বিজয় উদযাপন করেছেন। তবে সেখানে ছাত্রদলের কাউকেই দেখা যায়নি। নির্বাচনি কর্মকর্তারা জানান, ফল ঘোষণার আগে থেকেই ছাত্রদলের পক্ষে কেউ উপস্থিত ছিলেন না।

এর কিছুক্ষণ আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিনকে আইটি অনুষদ ভবনে প্রায় দুই ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখেন ছাত্রদলের নেতা–কর্মীরা। এ সময় ধাক্কাধাক্কির ঘটনাও ঘটে। প্রক্টরিয়াল বডি গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।

অন্যদিকে চাকসু প্রচারণা শুরুর পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একের পর এক আক্রমণাত্মক পোস্ট দিয়েছেন চবি ছাত্রদলের নেতারা। শিবিরকে ‘ছায়া সংগঠন’ 'বট সংগঠন' বলে অভিযুক্ত করে নানা মন্তব্যে সোশ্যাল মিডিয়া গরম রেখেছিলেন তারা। তবে ‘সম্প্রীতি’ প্যানেলের প্রার্থীরা এসবের কোনো প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে সরাসরি ক্লাসরুম, ডিপার্টমেন্ট, ডরমিটরি ঘুরে নিজেদের প্রতিশ্রুতি ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরেন। তাদের শান্ত ও ধৈর্যশীল প্রচারণা অনেক শিক্ষার্থীর কাছেই আস্থা তৈরি করেছে।

চবির কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে ফজরের নামাজ ও দোয়া মাহফিল শেষে শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম বলেন, আজকের এই বিজয় জুলাই যোদ্ধাদের বিজয়, শহীদদের বিজয়। শিক্ষার্থীরা আমাদের প্রতি যে আস্থা রেখেছে, সেই আস্থার প্রতিদান না দেওয়া পর্যন্ত আমরা থামব না।

তিনি আরও বলেন, যারা নির্বাচনে আমাদের বিরোধিতা করেছেন, বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটিয়েছেন, বিভেদ সৃষ্টি করেছেন আমরা সব ভুলে যাচ্ছি। কারও প্রতি আমাদের অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই। সবাইকে নিয়ে সামনে এগোতে চাই।

শিক্ষার্থীদের অনেকেই বলছেন, ছাত্রদলের আচরণই এবার তাদের প্রতি বিরূপ মনোভাব তৈরি করেছে। অন্যদিকে ‘সম্প্রীতি’ দীর্ঘ সময় আড়ালে থেকে সাংগঠনিকভাবে প্রস্তুত ছিল। ভোটের দিন তারা শৃঙ্খলাবদ্ধ আচরণ দেখিয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে।

ব্যবসা প্রশাসন অনুষদের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মেহজাবিন তানিয়া বলেন, নির্বাচনে কে জিতল, সেটা বড় বিষয় না। কিন্তু আমরা দেখেছি, ‘সম্প্রীতি’ প্যানেলের ছেলেরা প্রচারণার সময় হাসিমুখে কথা বলেছে, কারও সঙ্গে ঝামেলায় যায়নি। এই আচরণটাই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে।

সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রাকিবুল ইসলাম বলেন, ছাত্রদলের অনেক নেতাই ফেসবুকে এমনভাবে লিখেছে, যেন তারা আগে থেকেই ফল জানে। কিন্তু ভোটের দিন তারা কোথাও ছিল না। অন্যদিকে শিবিরের ছেলেরা একদম নীরবে ভোটের মাঠে ছিল।

ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী সামিহা সুলতানা বলেন, আমরা মেয়েরা ভোট দিতে গিয়ে দেখেছি, শিবির–সমর্থিত প্যানেলের মেয়েরা সারাদিন পাহারায় ছিল। তারা ভোটারদের সহযোগিতা করেছে, বিশৃঙ্খলা করেনি। এই জিনিসটাই অন্যদের থেকে আলাদা।

আইন অনুষদের শিক্ষার্থী ফারহান উদ্দিন রনি বলেন, এই নির্বাচনে ছাত্রদলের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল সংযম না থাকা। প্রোভিসির সঙ্গে এমন আচরণ শিক্ষার্থীদের মনোভাবকে আরও নেতিবাচক করেছে।

গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী মাহমুদা আক্তার লাবণী বলেন, শিবির এত বছর পর ফিরেছে এটা সবাই জানে। কিন্তু তারা এবার যেভাবে আচরণ করেছে, সেটা মনে হয়েছে পরিকল্পিত ও সংগঠিত। শিক্ষার্থীরাও সেটা বুঝেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনার পতনের পর গত এক বছরে ক্যাম্পাসে ইসলামি ছাত্রশিবিরের নীরব সংগঠিত প্রত্যাবর্তনের ইঙ্গিত এবার স্পষ্ট হয়েছে। তারা প্রশাসনের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে না গিয়ে দীর্ঘমেয়াদি সাংগঠনিক প্রস্তুতি নিয়েছিল।

এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যারা একসময় ভয় পেয়ে রাজনীতি করতেন না, তারা এখন প্রকাশ্যে ফিরে এসেছে। এই নির্বাচনে তাদের জয় শুধু সংগঠনের নয়, প্রভাব বিস্তারেরও সূচনা।