Image description

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচন হয়েছে মোট তিনবার, যেগুলোর দুটিতেই দলীয় প্যানেল দেয় ছাত্রশিবির। তবে এর কোনোটিতেই উল্লেখযোগ্য সাফল্য পায়নি এই সংগঠনটি। এ সময়ে হল সংসদ ব্যতীত কেন্দ্রীয় সংসদে কোনো পদ পাওয়ার নজির নেই তাদের। এমন প্রেক্ষাপটে রাকসুতে নিজেদের ইতিহাস ছাপিয়ে নতুন করে ইতিহাস লেখার স্বপ্ন দেখছেন তারা।

এরই মধ্যে সেই স্বপ্ন নিয়ে নিজেদের প্যানেল ঘোষণা করেছে সংগঠনটি। তাদের দাবি, এ প্যানেল ‘ইনক্লুসিভ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক’ হয়েছে। কারণ, এতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সম্মুখসারিতে থাকা এবং জুলাই যুদ্ধে আহত শিক্ষার্থী রয়েছেন, তেমনি ভিন্ন মতাদর্শ ও সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীসহ ‘ক্লিন ইমেজের’ প্রার্থীদের এই প্যানেলে রাখা হয়েছে।

জানা যায়, এর আগে রাকসুর অন্তত দুটিতে নির্বাচনে প্রকাশ্যে প্রার্থী ঘোষণা ও নির্বাচনি প্রচার চালিয়েছে ছাত্রশিবির, যে নির্বাচনগুলো হয় ১৯৮৯ ও ১৯৯০ সালে। এর মধ্যে সর্বশেষ ১৯৯০ সালের নির্বাচনে ছাত্রশিবির থেকে সহ সভাপতি পদে নির্বাচন করেন মো. আব্দুল লতিফ ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে নির্বাচন করেন মো. রফিকুল ইসলাম খান এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে নির্বাচন করেন মো. সাইফুল ইসলাম। ওই নির্বাচনে রাকসুতে কেন্দ্রীয় পদে ছাত্রশিবিরের কোনো প্রার্থী নির্বাচিত হননি। তবে হল সংসদের শহীদ শামসুজ্জোহা হলে সবকটিতে জয় লাভ করেছিলেন ছাত্রশিবিরের প্রার্থীরা।

ছাত্রশিবির নেতাকর্মীরা বলছেন, সংগঠনের বাইরের দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষার্থীদের প্রার্থী করেছেন তারা। এ বৈচিত্র্যই তাদের প্যানেলকে ইনক্লুসিভ (অন্তর্ভুক্তিমূলক) করেছে। এটাই তাদের শক্তির জায়গা।

রাকসুতে এবার শিবিরের ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’ নামে এই প্যানেলে সহসভাপতি (ভিপি) পদে রয়েছেন ছাত্রশিবিরের রাবি শাখার সভাপতি মোস্তাকুর রহমান জাহিদ এবং সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে প্রার্থী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাবির সাবেক সমন্বয়ক ফাহিম রেজা। সোচ্চার স্টুডেন্ট নেটওয়ার্ক রাবি শাখার সভাপতি এস এম সালমান সাব্বির লড়বেন সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে।

এই প্যানেলে ব্যতিক্রম হিসেবে জুলাইয়ে চোখ হারানো দ্বীপ মাহবুব ও সনাতন ধর্মাবলম্বী সুজন চন্দ্রকে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। প্যানেলে নারী প্রার্থী রয়েছেন তিনজন। নির্ধারিত দুই নারী পদ ছাড়াও সহ সমাজসেবা সম্পাদক পদে লড়বেন একজন নারী।

এ বিষয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘শিবির এবার অন্তত নতুন কিছু করার চেষ্টা করেছে। বিশেষ করে নারী ও সংখ্যালঘু প্রার্থী রাখা ইতিবাচক উদ্যোগ। এতে বোঝা যায়, তারা ভিন্নধারার রাজনীতি নিয়ে ভাবছে।’

বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী নিশাত তাবাসসুম বলেন, শিবিরের ইমেজ অনেক শিক্ষার্থীর কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। তবে এবারের বৈচিত্র্যময় প্যানেল হয়তো সেই ভাবমূর্তি বদলাতে সাহায্য করতে পারে।

ইতিহাস বিভাগের ছাত্র অনিন্দ্য রায় বলেন, দলীয় রাজনীতির বাইরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রার্থী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা প্রশংসনীয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের অবস্থান কতটা স্বাধীন থাকবে, সেটাই দেখার বিষয়।

শিক্ষার্থীদের এই ভিন্নমুখী প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই শিবির তাদের নতুন কৌশল নিয়ে নির্বাচনি মাঠে নামছে। সংগঠনটির নেতাদের প্রত্যাশা, এবার তাদের ইনক্লুসিভ প্যানেলই রাকসু নির্বাচনে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য এনে দেবে।

শিবির সমর্থিত প্যানেল থেকে নির্বাচন করার বিষয়ে দ্বীপ মাহবুব বলেন, ছাত্র সংসদ মূলত শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের প্ল্যাটফরম। ছাত্রশিবির তাদের প্যানেল সাজিয়েছে সবাইকে নিয়ে। জুলাই পরবর্তীকালে ছাত্রশিবিরকে আমার কাছ থেকে দেখার ও জানার সুযোগ হয়, তারই পরিপ্রেক্ষিতে তাদের সাংগঠনিক ও আদর্শিক কাঠামো, কার্যকলাপ আমাকে আকৃষ্ট করে।

তিনি আরও বলেন, জুলাইয়ের আহত যোদ্ধা হিসেবে যখন তারা আমাকে রাখার জন্য প্রস্তাব দেন, তখন আমি তাদের প্যানেল দেখি এবং সেখানে আমার মনে হয়েছে একটি ইনক্লুসিভ প্যানেল হয়েছে, আর আমি এখানে থাকতে পারি। জুলাইয়ে আমার একটি চোখ হারিয়েছি, মস্তিষ্কে এখনো গুলির অংশ নিয়ে বেঁচে রয়েছি। আমি যদি নির্বাচিত হই, তাহলে জুলাই বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।

প্যানেল থেকে নির্বাচিত হলে শিক্ষার্থীদের জন্য একনিষ্ঠভাবে কাজ করবেন জানিয়ে সুজন চন্দ্র বলেন, আমি যদি নির্বাচিত হতে পারি আমার প্রথম কাজ হবে শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর হয়ে রাকসুতে আওয়াজে তোলা। এই অধিকার আদায়ের প্ল্যাটফরমে শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়েই সোচ্চার থাকবো। ক্যাম্পাসে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ ও শিক্ষার্থীদের মতের প্রতিফলন করাই হবে আমার অন্যতম প্রধান কাজ।

ছাত্রশিবিরের প্যানেলে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে সাবেক সমন্বয়ক মো. ফাহিম রেজা বলেন, স্বতন্ত্রভাবে জিএস পদে নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষা ছিল। পরে ইসলামী ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে ইনক্লুসিভ প্যানেল করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে আমি ছাত্রশিবিরের প্যানেলে নির্বাচন করার সম্মতি দিই। আমার বিশ্বাস শিক্ষার্থীরা আমাদের পাশে থাকবে।

ছাত্রশিবিরের ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেল থেকে ভিপি পদে নির্বাচন করছেন মোস্তাকুর রহমান জাহিদ। তিনি বলেন, ছাত্রশিবির যাত্রা শুরুর পর রাকসুতে ২টি নির্বাচনে নিজস্ব প্যানেলে অংশগ্রহণ করে। তখন সংগঠনের যাত্রার শুরু সময়, আমাদের জনপ্রিয়তা খুব একটা ছিল না, কর্মীর সংখ্যাও সীমিত ছিল। তাই বড় পদে জয় পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে সর্বশেষ রাকসু নির্বাচনে শহীদ শামসুজ্জোহা হলসহ বেশ কয়েকটি হলে বিভিন্ন পদে জয়ী হয়েছিলাম। তবে এবারের রাকসু নির্বাচনে 'সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোটের সর্বোচ্চ সাফল্য নিয়ে আমরা আশাবাদী।

তিনি বলেন, আমাদের প্যানেলের শক্তি ‘ইনক্লুসিভিটি’(অন্তর্ভুক্তিমূলক)। আমরা যাকে-তাকে বা শুধু শিবির করার কারণে রাখিনি। শিবির করুক বা না করুক, একজনের যেন দক্ষতা ও যোগ্যতা থাকে, নেতৃত্বগুণ দেখেই প্যানেলে জায়গা দেওয়া হয়েছে।