Image description

অধ্যাপক ছাড়া শুধুমাত্র প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক নিয়েই চলছে জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (জাবিপ্রবি)। বিশ্ববিদ্যালয়টির সাতটি বিভাগের মধ্যে তিনটিতে এই দুই পদধারী শিক্ষকদের অধীনেই একাধিক ব্যাচের শিক্ষার্থীরা মাস্টার্স কোর্স সম্পন্ন করছে। এছাড়া, প্রতিষ্ঠানটিতে ছয়টি অনুষদের নাম ওয়েবসাইটে থাকলেও বাস্তবে নেই কার্যক্রম এবং নেই কোনো ডিনও।

শুধু অধ্যাপকের সংকটই নয়, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে দেখা গেছে সহযোগী অধ্যাপকেরও অভাব। এমনি এক বিভাগ হল ইলেক্ট্রনিক এবং ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই)। এ বিভাগটি পরিচালিত হচ্ছে শুধুমাত্র প্রভাষক দিয়ে। এমনকি বর্তমানে বিভাগটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করছেন একজন প্রভাষক।

এ বিষয়ে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদগণ হতাশা প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটিকে উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের সঙ্গে তুলনা করেন। তাদের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগ একজন অধ্যাপকের তত্ত্বাবধানে চালু হওয়া উচিৎ। না হলে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এর কোনো গুরুত্ব থাকে না।

সূত্র জানায়, বিগত প্রশাসনের সময়ে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) অভিন্ন নীতিমালা অনুযায়ী দু’দফা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। কিন্তু কঠোর শর্তের কারণে যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় অধ্যাপক এবং সহযোগী অধ্যাপক নিয়োগ প্রক্রিয়া ব্যর্থ হয়। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখনো পর্যন্ত ইউজিসির অভিন্ন নীতিমালা মেনে কোনো নিয়োগ সম্পন্ন হয়নি।

“এটা তো কোনো উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ না যে সেখানে মাস্টার্স পাশ শিক্ষার্থী দিয়ে পড়ানো হবে। মাস্টার্স পাশ শিক্ষার্থী দিয়ে বিশ্বের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় না এমনকি পিএইচডি ও যথেষ্ট নয়। দু-তিন বছরের পোস্ট ডক্টরেট থাকলে তখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার জন্য ম্যাচিউরড হয়।” - ড. কামরুল হাসান মামুন, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

অভিযোগ রয়েছে, বিগত প্রশাসনের সময়ে কিছু সিনিয়র শিক্ষক নিজেদের প্রোমোশন এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব না পাওয়ার শঙ্কায় অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগের বিরোধিতা করেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাবিপ্রবির সমাজকর্ম, ফিশারিজ, ব্যবস্থাপনা, গণিত, সিএসই এবং ভূতত্ত্ব এই ছয় বিভাগের চেয়ারম্যানের পদবীই সহকারী অধ্যাপক। আর ট্রিপল ই (ইইই) বিভাগের চেয়ারম্যান প্রভাষক। এ বিভাগটিতে সব শিক্ষকই প্রভাষক।

এছাড়া, ইঞ্জিনিয়ারিং, সায়েন্স, অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড সায়েন্স, আর্থ সায়েন্স, বিজনেস স্টাডিজ, সোশ্যাল সায়েন্স ফ্যাকাল্টির নাম ওয়েবসাইটে থাকলেও বাস্তবে এগুলোর কোনো অস্তিত্ব মেলেনি। এর বাইরে, প্রতিষ্ঠানটিতে কোনো ইনস্টিটিউট ও রিসার্চ সেন্টারও নেই।

জানা যায়, জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০১৭ সালে স্থাপিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি জামালপুর জেলা শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে মালঞ্চ বাজারের উপকণ্ঠে অবস্থিত। তৎকালীন বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম 'বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়' নামে একটি বিশেষায়িত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য পতিত সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট আবেদন করেন।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি মন্ত্রিসভায় জামালপুরে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের নীতি পাশ হয়। একই বছরের ২০ নভেম্বর জাতীয় সংসদে ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বিল-২০১৭’ সর্বসম্মতিক্রমে ও কণ্ঠভোটে পাস হয়। ২৮ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়টি গেজেটভুক্ত হয়।

এদিকে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর শেখ পরিবারের নামে থাকা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম পরিবর্তনের দাবি উঠলে এটির নাম পরিবর্তন করে ‘জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ করা হয়। ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স এবং ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে মাস্টার্স এর শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো অধ্যাপক এবং সহযোগী অধ্যাপক নিয়োগ দেওয়া হয়নি।

নাম-পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়টির মাস্টার্সের এক শিক্ষার্থী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বড় একটা আক্ষেপ হলো আমরা কোনো প্রফেসরের (অধ্যাপক) ক্লাস করতে পারলাম না। এমনকি মাস্টার্স প্রোগ্রামেও আমাদের প্রফেসর ছাড়া ক্লাস করতে হচ্ছে। যারা থিসিস করছে তাদের অন্তত একজন প্রফেসর প্রয়োজন ছিলো সুপারভাইজার হিসেবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, অনেককে লেকচারারের আন্ডারে থিসিস চয়েস দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ থাকবে যে, অবিলম্বে বিভাগগুলোতে একাধিক প্রফেসর নিয়োগ দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করে।

প্রতিষ্ঠানটির এমন বেহাল অবস্থা সম্পর্কে অভিমত জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স পাশ শিক্ষক দিয়ে মাস্টার্স কোর্স পড়ানো একদমই মানসম্মত নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ডিপার্টমেন্ট শুরু করতে হয় একজন খ্যাতিমান অধ্যাপককে নিয়োগ দিয়ে। তার অধীনে কারিকুলাম এবং কোন কোন কোর্স পড়ানো হবে এগুলো তৈরি হয়। এভাবে কয়েকজন লেকচারার নিয়োগ দিয়ে নাম দেওয়া হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৃত অর্থে এগুলো বিশ্ববিদ্যালয় না।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে উচ্চমাধ্যমিকের সঙ্গে তুলনা করে তিনি আরও বলেন, এটা তো কোনো উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ না যে সেখানে মাস্টার্স পাশ শিক্ষার্থী দিয়ে পড়ানো হবে। মাস্টার্স পাশ শিক্ষার্থী দিয়ে বিশ্বের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় না এমনকি পিএইচডি ও যথেষ্ট নয়। দু-তিন বছরের পোস্ট ডক্টরেট থাকলে তখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার জন্য ম্যাচিউরড হয়।

সার্বিক বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রোকনুজ্জামান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে সম্প্রতি বলেন, আমরা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিলাম এবং সেখানে অনেকে আবেদন করেছে। সেখানে আমাদের শর্তানুযায়ী যারা যোগ্য অধ্যাপক এবং সহযোগী অধ্যাপক নিয়োগ দেওয়া হবে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সিনিয়র সহকারী অধ্যাপকের পদন্নোতি নিয়ে আমরা চিন্তা করছি।