
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলে দেশের তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে। ভিন্ন ভিন্ন দাবিতে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট), বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় (ববি) ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (জবি) এই অস্থিরতা বিরাজ করছে।
এরমধ্যে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিনের অপসারণের দাবিতে সর্বশেষ আজ রবিবার (১১ মে) অনির্দিষ্টকালের জন্য একাডেমিক শাটডাউন ঘোষণা করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ভিসি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাছুদের পদত্যাগের পরও কুয়েট শিক্ষক সমিতির গ্যাঁড়াকলে পড়ছেন শিক্ষার্থীরা। সেখানকার শিক্ষকরা তাদের সহকর্মীদের লাঞ্ছনার বিচার চেয়ে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেছেন। তাছাড়া আবাসন সুবিধা, ভাতা নিশ্চিতসহ ৪ দফা দাবিতে শিগগির আন্দোলনে নামছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে দূরত্ব না কমায় এই সমস্যাগুলো রয়ে গেছে। বিশেষ করে, ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর শিক্ষার্থীরা অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলছেন। আন্দোলনে নামছেন। তাই এই অস্থিরতা বিরাজ করছে।
সংকট কাটেনি কুয়েটে
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে বহিরাগতরা। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারায় শিক্ষার্থীদের জেরার মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা। এসময় শিক্ষার্থীদের হাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ শিক্ষকরা লাঞ্ছিত হন। পরে ৩৭ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের ঘটনায় ভিসির অপসারণ চেয়ে একদফা দাবিতে আন্দোলন করে শিক্ষার্থীরা। সরকার গত ২৪ এপ্রিল ভিসিসহ প্রো-ভিসিকে অপসারণ করে গত ১ মে অধ্যাপক ড. মো. হযরত আলীকে অন্তবর্তীকালীন সময়ে ভিসির দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে গত ৪ মে শিক্ষকদের ক্লাসে ফেরার কথা থাকলেও সহকর্মীদের লাঞ্ছনার বিচার না হওয়া পর্যন্ত তারা ক্লাসে ফিরবে না বলে জানিয়েছে শিক্ষক সমিতি। ফলে ভিসি অপসারণ হলেও কার্যত অচল অবস্থায় রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।
জানা গেছে, এই লাঞ্ছনার ঘটনায় ভিসি বিরোধী আন্দোলনকারীরা শিক্ষকদের কাছে প্রেস ব্রিফিং করে ক্ষমা চেয়েছেন। এছাড়াও ব্যক্তিগত পর্যায়েও শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন শিক্ষার্থীরা। তবুও শিক্ষকরা ক্লাসে ফিরে না যাওয়ায় কুয়েটের সংকট আরও দীর্ঘ হলো বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের।
এদিকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি অংশ বলছেন, শিক্ষক সমিতির কোনো নির্বাচন হয়নি। এটি সাবেক ভিসি অধ্যাপক মাছুদের হাতে গড়া একটি শিক্ষক সমিতি। তার পরামর্শেই কমিটির সভাপতি-সাধারণ থেকে শুরু করে বাকি পদগুলোতে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। ফলে শিক্ষক সমিতি গঠনের ক্ষেত্রে কোনো নির্বাচনের প্রয়োজন পড়েনি। ফলে সংকট এখনও কাটেনি।
এ বিষয়ে কুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক আতাউর রহমান জানান, ‘‘এখানে যারা ভিসি হয়ে আসে তাদের লেজুড়ভিত্তি করতে পারবে সেরকম শিক্ষক সমিতিই সবাই তাদের কাছে চায়। এবারও তাই হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কেউ দাঁড়ায়নি। নামকাওয়াস্তে নির্বাচন হয় না। তাদের সিলেকশন হয়ে গেছে।’’
তিনি আরও জানান, ‘‘আমিও বিশ্বাস করি শিক্ষকরা যদি ক্লাসে ফিরে যায় তাহলে সংকট এখানেই শেষ। তাদের অনেক কিছুই মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। আর তাদের যে দাবি দাওয়া, সেটাতো চারশ শিক্ষককে উপস্থাপন করে না। তাদের মিটিংয়ে হয় একশ থেকে ১১০ জন শিক্ষক। এতে তো কোরাম গঠন হয় না। আর অধিকাংশ শিক্ষক তো ক্লাস না করানোর বিরুদ্ধে মত দেয়নি। তারা তারা একটা রেজ্যুলেশন পাশ করে তারা চালিয়ে দিচ্ছে। এক অনলাইন ভোটে ১৩২ জন শিক্ষক ভোট দিয়েছে তারা ক্লাসে ফিরতে চাই না। তাহলে বাকি যারা আছে তারা তো ক্লাসে ফিরতে চাই। তারা অনলাইনে ভোট নেওয়ার কে?’’
তিনি আরও জানান, ‘‘কোনো একটা বিষয় পাশ করাতে গেলে ন্যূনতম ওয়ান থার্ড লোকজন প্রয়োজন হয়। কিন্তু তারা তো সেটা করে না। অনেক শিক্ষকই সেখানে যান না। অনেক সময় ৩০ জন শিক্ষক নিয়েও মিটিও হয়েছে। সেটাও রেজ্যুলেশন আকারে দেওয়া হয়েছে। আমি প্রতিবার বলে এসেছি, কতজন শিক্ষক এ সকল মিটিংয়ে উপস্থিত ছিল তা প্রকাশ করতে হবে। কিন্তু রেজ্যুলেশনের সাথে তারা এটা প্রকাশ করে না।’’
হিউম্যানিটিস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মারিয়া ভূঁইয়া বলেন, ‘‘সব সময় আমরা নির্বাচনে ভোট দিয়েছি। এবার ভোট দেইনি। আমরা একটা শিক্ষক কমিউনিটি মেইনটেইন করি, তাই আমরা এখনো ক্লাসে ফিরিনি।’’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুয়েট শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফারুক হোসেন বলেন, ‘‘আমাদের দাবির বিষয়ে সিদ্ধান্ত না আসার পর্যন্ত আমরা ক্লাসে ফিরে যাব না। ভিসি মিটিং করেছেন, কমিটি কাজ করছে। আমাদের দাবি পূরণ হলে আমরা ক্লাসে ফিরে যাব।’’
শিক্ষক সমিতি গঠন ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘এখানে ভিসির কোনো হাত নেই। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু না। এটা শিক্ষকদের পেশাজীবী সংগঠন। যারা আপনাদের কাছে এসব বিষয়ে মন্তব্য করেছেন নিউজে তাদের নাম উল্লেখ্য করবেন তাহলে বুঝব আপনাদের নিউজ ঠিক আছে।’’
কোরাম গঠনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘এটা দেখার জন্য লোক আছে। আপনার সাথে এ বিষয়ে আমি কোনো কথা বলব না।’’ পরে তিনি প্রতিবেদককে আবার কল দিয়ে বলেন, ‘‘আমাদের মিটিংয়ে ৮০ শতাংশ উপস্থিত ছিলেন।’’ তবে শিক্ষকদের উপস্থিতির তথ্য চাইলে তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের অফিস থেকে চিঠি পাঠাতে বলেন।
এদিকে কুয়েটের অন্তর্বর্তী সময়ে ভিসির দায়িত্ব পালন করা অধ্যাপক ড. হয়রত আলীকে একাধিকবার কল দিয়েও পাওয়া যায়নি।
অনির্দিষ্টকালের জন্য একাডেমিক শাটডাউন ঘোষণা ববিতে
কুয়েটের এই ঘটনা যেতে না যেতেই ভিসি অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিনের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের মধ্যে গত বৃহস্পতিবার (৮ মে) তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও। সর্বশেষ আজ রবিবার (১১ মে) অনির্দিষ্টকালের জন্য একাডেমিক শাটডাউন ঘোষণা করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
জানা গেছে, গত ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর ২৩ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থি শিক্ষক অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিনকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা এবং প্রশাসনিক দুর্বলতার অভিযোগ উঠে। এসব অভিযোগ তুলে শিক্ষার্থীরা গত এক মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন।
এছাড়াও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহের সিন্ডিকেটে এই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে বলে অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। এর ফলে কলিমুল্লাহ স্টাইলে ক্যাম্পাসে না গিয়ে অধিকাংশ সময় ঢাকায় থাকেন বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি রেজিস্ট্রারের অপসারণ দাবিতে আন্দোলন করায় শিক্ষার্থীদের নাম মামলা করেছেন ভিসি। ফলে ভিসিবিরোধী আন্দোলনে তুঙ্গে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। এ ঘটনায় ভিসির বাসভবনসহ ও প্রশাসনিক ভবনে তালা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলনে শিক্ষকদের সরাসরি অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে এখন এটি এক নতুন মোড় নিয়েছে। এছাড়া দুইজন হল প্রভোস্টসহ মোট তিনজন প্রশাসনিক পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক শরমিনের দাবি, ‘‘শিক্ষার্থীরা অনেক সময়ই ভুল বুঝে। তাদের ভুল বুঝানো হয় এবং শিক্ষার্থীদের জন্য আমি সবসময় সহমর্মী ফিল করি। তারা অনেক কিছু বুঝে, না বুঝেই করে ফেলে। আন্দোলনকারীদের বিষয়গুলো সাধারণ শিক্ষার্থীরা পছন্দ করে না। শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ৩৫ থেকে আজকে ১৫ হয়ে গেছে। আগামীকাল তারাও থাকবে কি না-আমার মনে হয় না।’’ এছাড়াও তার বিরুদ্ধে উঠা বিভিন্ন অভিযোগের ভিন্ন ব্যাখ্যা দেন প্রতিবেদককে।
কঠোর আন্দোলনের পথে জবি শিক্ষার্থীরা
বিগত বছরগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) বৈষম্যমূলক নীতির অভিযোগসহ-আবাসন ভাতা, হল নির্মাণসহ চার দফা দাবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) প্রশাসনিক ভবনে তালা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, কুয়েট ও বরিশালের মতো করে এই আন্দোলনও ধীরে ধীরে বড় হতে পারে। গত বৃহস্পতিবার (৮ মে) বেলা ১২টার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা।
আন্দোলনকারীরা বলছেন, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বিভাগের সংখ্যা, শিক্ষক সংখ্যা, ইত্যাদি দিক থেকে আমরা তৃতীয়। কিন্তু সে অনুযায়ী ইউজিসি আমাদেরকে অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে না। ইউজিসি আমাদের বলছে আমাদের আবাসিক হল নেই তাই আমাদের বাজেট কম হয়। কিন্তু আরও অনেক খাতে তো বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেখানে তারা কেন নজর দিচ্ছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যদি আবাসন ভাতা পায়, আমরাও সেই অর্থের দাবিদার। আসন্ন বাজেটে ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য আবাসন ভাতা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
তারা আরও বলেন, দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ, পুরান ঢাকায় ড. হাবিবুর রহমান হল ও বাণী ভবনের নির্মাণকাজ আগামী ১০ মে এর অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং কাজের অগ্রগতি ১৫দিন পরপর শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে ব্রিফ করতে হবে। এছাড়া আগামী ১৫ মের মধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জকসু) নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে এসব সমস্যার সমাধান না করলে এই আন্দোলন আরও বেগবান হবে।
ইউজিসির বক্তব্য
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা নিয়ে ইউজিসির একাধিক সদস্যের সাথে কথা হয় দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের সাথে। তারা জানান, একজন শিক্ষক ভিসি হওয়ার পর তিনি নিজেকে প্রশাসক হিসেবে নিজেকে বেশি জাহির করতে চান। ফলে প্রশাসনের সাথে শিক্ষার্থীদের একটা দূরত্ব তৈরি হয়। আর ভিসিরা আগের ভিসিদের মনমানসিকতা এখনও লালন করছে। যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমস্যা আরও প্রকট হচ্ছে।
কুয়েটের সমস্যার বিষয়ে জানান, সেখানকার শিক্ষক সমিতির যারা আছেন তারা সাবেক ভিসির লোক। ফলে সমস্যাটি সেখানে এখনও রয়ে গেছে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে জানান, সেখানে ভিসি নিয়োগের পর থেকেই অনেক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এগুলোর ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠিও দেয়া হয়েছে। সেই চিঠির ব্যাখ্যা সন্তুষ্টমূলক না। শিক্ষার্থীরা প্রথম থেকেই আন্দোলন করছে। ভিসির উচিত ছিল শিক্ষার্থীদের সাথে একদিন বসা। কিন্তু সেটা করেননি ভিসি। যার ফলে সমস্যাটা আরও বাড়ছে।
এ বিষয়ে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন জানান, গণঅভ্যুত্থানের পর শিক্ষার্থীরা অনেক বিষয়ে কথা বলছে। যেটা আগে বলা সম্ভব হতো না তাদের পক্ষে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে সমস্যাগুলো দেখা দিয়েছে।