
২০২৪ সালের ঐতিহাসিক ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের হয়। রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর ওই বছরের ২৭ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ৩০তম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান। তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি যখন দায়িত্ব নেন, তখন পুরো বিশ্ববিদ্যালয় অচল ছিল, ক্লাস-পরীক্ষা ছিল টানা বন্ধ ছিল; ঢাবি প্রশাসন ছিল অভিভাবকহীন। তিনি দায়িত্ব নিয়ে সবকিছু যেন শূন্য থেকে শুরু করেন। তার ভাষ্য, ‘ঢাবির প্রশাসনের প্রত্যেকটা কাজ প্রথম থেকে শুরু করতে হয়েছে।’
বৃহস্পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খানের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের ৬ মাস পূর্ণ হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে একান্ত সাক্ষাৎকার দেন। এতে তিনি নিজের অভিজ্ঞতা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা-প্রাপ্তি, ডাকসু সচল নিয়ে প্রশাসনের অবস্থান ইত্যাদি বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন। পাশাপাশি তুলে ধরেন তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। আজ শনিবার সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব প্রকাশিত হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইরফান এইচ সায়েম—
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: উপাচার্যের দায়িত্ব কতটুকু উপভোগ করছেন?
ড. নিয়াজ আহমদ খান: উপাচার্যের দায়িত্ব নেওয়ার পর আমার ব্যক্তিগত জীবন বলতে কিছু নেই। প্রতিদিন ১৪ থেকে সাড়ে ১৪ ঘণ্টার বেশি কাজ করা হয় আমার। ভোর ৪টার পর আমার দিন শুরু হয় এবং একান্ত যদি আমার শরীর অচল না হয়ে যায় অন্তত রাত ৯টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত কাজ করি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর চাইতেও বেশি হয়। শুক্র-শনিবার কিছুই বিবেচনায় থাকছে না। আমার অফিস সবার জন্য সব সময়ই খোলা।
শুরুতে আমার জন্য কোনো কিছুই রুটিন না, প্রত্যেকটা কাজ শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছে। অন্য প্রশাসনের জন্য রুটিন ছিল। আমার প্রত্যেকটা কাজ প্রথম থেকে করতে হয়েছে। এই যে ভর্তি পরীক্ষা রান করা, এর জন্য নতুন করে কমিটি করতে হয়েছে। কাঠামোগতভাবে আমি অনেক মানুষকে আনতে পারছি না, যাদের আনা যেত। এখনকার রাজনৈতিক বাস্তবতা, ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী স্পিরিটের যে বিষয় আছে; কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইমোশনাল ক্ষোভ বা রাগ অযৌক্তিকভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আমরা সবাইকে নিয়ে যেভাবে প্রশাসন চালানোর চেষ্টা করছি, এরপর আসলে বিকল্প নেই। এককভাবে চালানোর কোনো সুযোগ নেই।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বিশ্ববিদ্যালয়ের আগের প্রশাসনকে স্বৈরাচার বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন অনেকেই। গণঅভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব নেওয়া আপনার প্রশাসনের অবস্থান কেমন?
ড. নিয়াজ আহমদ খান: আমি পরিষ্কারভাবে বলে দিতে চাই, আমার এই পদে ক্ষমতায় আঁকড়ে পড়ে থাকার কোনোরকম ইচ্ছে নেই। আমি রাজনীতি করি না, তাই রাজনৈতিক বলয় আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। অতএব, আমি লম্বা সময় থাকতে চাই না, আমি যেটা চাই ভালো উদাহরণ তৈরি করে একটা ক্রিটিক্যাল ম্যাস সাপোর্ট তৈরি করা; যাতে চেষ্টা করলেও কেউ এটাকে রাতারাতি বদলিয়ে ফেলতে পারবে না। অংশীদারিত্বভিত্তিক একটা ডেমোক্রেটিক ফাউন্ডেশন তৈরি হয়ে গেলে একরকম স্থিতিশীলতা চলে আসবে। ছাত্ররা তাদের পাওনা বুঝে পাবে, অভিভাবকরা তাদের পাওনা বুঝে পাবেন।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইচ্ছা করলেই তখন আর স্বৈরাচারী হতে পারবে না। ওই ক্ষেত্রটা আমি তৈরি করে যাওয়ার চেষ্টা করছি। বিশ্ববিদ্যালয় একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার যে গতিময়তা ওই ফাউন্ডেশনটুকু তৈরি হলে তার নিজস্ব গতিতে চলতে পারবে। এটাই আমার আশা।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার রাজনৈতিক রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে অনেকেই আলোচনা-সমালোচনা করেন কেন?
ড. নিয়াজ আহমদ খান: আমি রাজনীতি করি না। আগামীতেও কোনো রাজনীতিতে জড়িত হওয়ার ইচ্ছে নেই, যেটি আগেও বারবার বলেছি। তাই আমার পেছনে কোনো সরকার সমর্থক দল নেই, নেই কোনো পুলিশও। ফলে আমাকেই নির্ভর করতে হবে সবার সাথে। এটাই আমার শক্তি। মনে রাখতে হবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক অর্থে বাংলাদেশের প্রতিফলন। এটা এতই গুরুত্বপূর্ণ একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান যে এটা ওই অর্থে সর্বজনতার প্রতিষ্ঠান। অতএব, আমাকে সবাইকে নিয়েই চলতে হবে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের এপ্রোচটা সব সময় একটা গণতান্ত্রিক, অংশীদারিত্বমূলক ফলো করার চেষ্টা করছি।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বিগত সময়ে যেসব শিক্ষকরা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন, তাদের নিয়ে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে?
ড. নিয়াজ আহমদ খান: বৈষম্যবিরোধীর স্পিরিটকে ধারণ করার জন্য আমরা তিনটি কমিটি করে দিয়েছি। যারা মনে করেন, বিগত সময়ে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন তাদের জন্য (শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এবং শিক্ষার্থী) আলাদা আলাদা কমিটি করে দিয়েছি। যাদের প্রতি ভয়ানক অবিচার হয়েছে বলে মনে করছেন, তাদের সেই বিষয়টি আমরা দেখব। প্রয়োজনে আইনগতভাবে সহযোগিতা করব। একটি উদাহরণ তৈরি করছি যেন ভবিষ্যতে এ জায়গাটা নিয়ে আরও কাজ করার সুযোগ হয়।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: জুলাই আন্দোলনে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের হামলার বিচারপ্রক্রিয়া কতটুকু শেষ হয়েছে?
ড. নিয়াজ আহমদ খান: আমরা জুলাই-আগস্টের ঘটনার একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি করেছি। কমিটির রিপোর্ট দ্রুতই সবার সামনে আনার চেষ্টা করছি। এজন্য কমিটির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। আশা করছি, কমিটির রিপোর্ট হাতে পেলে দ্রুতই ব্যবস্থা নিতে পারব।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোনো হুমকি পেয়েছেন কিনা?
ড. নিয়াজ আহমদ খান: আমি সাধারণ মানুষ। আমি ও আমার পরিবার কিংবা আমার স্টাফদের ওপর কোনো থ্রেট আসলে ভয় পাই। তবে আমাকে ভয় দেখিয়ে বিচ্যুত করা যাবে না। এই ভয় নিয়েই আমি দায়িত্ব পালন করতে থাকব।
আমার দায়িত্বটি একটি আমানতস্বরূপ। আমি মনে করি, বৃহত্তর মানুষের সমর্থন আমার প্রতি আছে। তাদের সমর্থন নিয়েই আমি এখানে এসেছি। আমাকে ভয় দেখিয়ে কাজ করানো যাবে না। আমাকে ভয় দেখিয়ে বিচ্যুত করা যাবে না।
দ্যা ডেইল ক্যাম্পাস: গবেষণা ও অ্যাকাডেমিক কাজে কতটুকু মনোনিবেশ করতে পেরেছেন?
ড. নিয়াজ আহমদ খান: আমরা বেশি কাজ একসাথে নিচ্ছি না। অল্প অল্প কাজ নিয়ে একটু একটু করে অর্জন করে পরবর্তী স্টেজে যাচ্ছি। আমরা ছয়মাসের বেশি কোনো পরিকল্পনা করছি না। অ্যাকাডেমিক ফ্রন্টে আমরা শিক্ষকদের জন্য ফাউন্ডেশন ট্রেনিং কোর্স প্রথমবারের মতো চালু করেছি। আমার উদ্দেশ্য এটাকে আমরা নিয়মিত প্রত্যেক শিক্ষকের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে করতে হবে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাব।
রিসার্চ কোলাবরেশন যেন বাড়ে আমরা এর মধ্যে অনেক নতুন এমওইউ করেছি। শিক্ষকদের মধ্যে দল-মত নির্বিশেষে কোনোরকম রাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়া যারা ভালো রিসার্চার, তাদের আমরা অফিশিয়ালি সম্মাননা জানাচ্ছি। আমাদের সীমিত বাজেটের মধ্যেও পাবলিকেশনের খরচ বহন করার চেষ্টা করছি। ভালো জায়গায় পাবলিশ করলে তার খরচটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দিচ্ছি।
আমি অ্যাকাডেমিক বিষয়গুলোতে আরও বেশি সময় দিতে পারলে আরও স্বস্তিবোধ করতাম। সেটা আমি পারছি না, কারণ আমার বহুমুখী জটিলতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এর সবগুলো অ্যাকাডেমিক ন্যাচারের না। আমি যে এপ্রোচের সাথে যেতে চাচ্ছি, সবাইকে নিয়ে তাতে আমার গতি কমে যাচ্ছে। আমার গতি বাড়ত যদি আমি এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতাম। কিন্তু আমি ইচ্ছা করেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না।
আন্তর্জাতিক কোলাবরেশন তুলনামূলক বেড়েছে। আমাদের যেসব ট্রাস্ট ফান্ড রয়েছে গত ৬ মাসে সবগুলোর অর্থের পরিমাণ এবং ফান্ডের সংখ্যা বেড়েছে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: গণঅভ্যুত্থানকে উপজীব্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘জুলাই স্মৃতি সংগ্রহশালা’ প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেটির অগ্রগতি কতটুকু?
ড. নিয়াজ আহমদ খান: জুলাই স্মৃতি সংগ্রহশালার কাজ এগিয়ে চলছে। কাঠামো প্রায় শেষের দিকে। ইতোমধ্যেই গণঅভ্যুত্থানের অত্যন্ত দুর্লভ বেশকিছু সরঞ্জাম আমরা পেয়েছি। আবু সাঈদসহ বিভিন্ন শহীদ পরিবারের কাছ থেকে স্মারক সংগ্রহ পেয়েছি। এটা আমাদের জন্য পরম পাওয়া। এটা শুধু একটি স্মৃতি বা সংগ্রহশালার বিষয় না। এর মধ্যে এই শহীদ পরিবারগুলোর সাথে যে আত্মিক যোগাযোগ এবং ঋণ স্বীকার করার যে একটি সুযোগ, সেটিকে আমরা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। চারুকলা অনুষদকে দায়িত্ব দিয়েছি এই সংগ্রহশালার নান্দনিক বিষয়টি দেখার জন্য। আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ কাজ করছে এর কাঠামোটি তৈরি করার জন্য।
এর বাইরেও আমরা একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির জন্য জায়গা নির্ধারণ করে ফেলেছি। বড় পরিসরে কাজ করার জন্য আমরা অপেক্ষা করছি, পাবলিক কম্পিটিশনের মাধ্যমে আমরা এর ডিজাইন নির্বাচন করব। কম্পিটিশনের জন্য সমস্ত প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে এবং ইতিমধ্যে জায়গা নির্ধারণও হয়ে গেছে। ডিজাইনটা আসার সাথে সাথে আমরা কাজ শুরু করে দেব। এখানে একটি বিষয় আছে সেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ফান্ড থেকে করার সুযোগ না হয়, তাহলে আমরা সমাজের মাধ্যমে মোবিলাইজ করা যায় সে চেষ্টা করছি।
এর জন্য তিনটা জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর একটা অংশ নির্ভর করবে ডিজাইনের উপর। এটি তৈরির টিমে বুয়েট থেকে একজন বিশেষজ্ঞ রেখেছি।
তাছাড়া গণঅভ্যুত্থান নিয়ে গবেষণার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে কোলাবরেশন হিসেবে আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারা এসব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, ভিয়েতনাম যুদ্ধসহ এ ধরনের গণ-অভ্যুত্থান তারাও অতিক্রম করেছেন। যেহেতু জুলাই অভ্যুত্থানের সঙ্গে প্রেক্ষাপট মিল রয়েছে ওই অনুযায়ী তারা অ্যাকাডেমিক গবেষণা করেছে আমরা সেটা চালু রাখতে চাই। পাশাপাশি গণঅভ্যুত্থান নিয়ে অনেকগুলো জাতীয় পর্যায়ে সভা-সেমিনার হয়েছে। আমরা গত ছয়মাসে অংশীজনদের নিয়ে ন্যূনতম দশটি বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় অনুষ্ঠান করেছি। (সমাপ্ত)