
প্রথম দিনে মনোনয়ন ফরম নিলেন ২৮ জন
পাহাড় আর সবুজে ঘেরা চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে এখন ভোটের হাওয়া বইছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ছাত্র রাজনীতি সরগরম হয়ে উঠেছে। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের অন্তত আটটি প্যানেল ভোটের লড়াইয়ে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। গতকাল রোববার মনোনয়নপত্র বিতরণের প্রথম দিন ২৮জন মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। যাদের মধ্যে ২৬ জন চাকসুর বিভিন্ন পদে প্রার্থী এবং দুই জন হল সংসদের প্রার্থী হিসেবে এ মনোনয়ন সংগ্রহ করেছেন।
গতকালই চাকসু নির্বাচনের চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন। এ তালিকায় নতুন করে এক হাজার ৭৬৮ শিক্ষার্থী যুক্ত হচ্ছেন। এ হিসাবে বর্তমানে চাকসুতে মোট ভোটার ২৭ হাজার ৬৩৪ জন। প্রশাসনের তরফে নির্বাচনকে উৎসবমুখর করতে নানা প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রার্থীদের জন্য ১৭টি নির্বাচনী আচরণবিধি ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচনে প্রার্থীদের ডোপ টেস্ট (মাদক পরীক্ষা) বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যাদের মাদকের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে তাদের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হবে।
দীর্ঘ ৩৫ বছর পর আগামী ১২ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে চাকসু নির্বাচন। এই নির্বাচনে বিজয় ছিনিয়ে আনতে ছাত্র সংগঠনগুলো কোমর বেধে মাঠে নামছে। ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে বিজয়ের পর চাকসুতেও বিজয়ের প্রত্যাশা করছে ছাত্রশিবির। তারা যোগ্য প্রার্থীদের সমন্বয়ে প্যানেল তৈরির প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছে। তবে পিছিয়ে নেই ছাত্রদলও। তারা ডাকসু ও জাকসুর ফলাফল বিবেচনায় রেখে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নেতাদের সমন্বয়ে একটি প্যানেল দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। এ লক্ষ্যে দলের জেলা এবং কেন্দ্রীয় নেতারা নানামুখী সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া বাগছাস, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র মৈত্রী, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র মজলিসসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমন্বয়ে আলাদা প্যানেল ভোটের লড়াইয়ে নামছে বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রাম মহানগরীর ২০ কিলোমিটার দূরে পাহাড় ঘেরা চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের ভোটের হাওয়া এখানকার রাজনীতিতেও প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করছে। বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নজর এখন ক্যাম্পাসের দিকে। সেই সাথে রাজনৈতিক সচেতন মহলও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন সার্বিক পরিস্থিতি। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় নানা বৈচিত্র্যে ভরা। পাহাড়ি বাঙালিসহ দেশের নানা প্রান্ত থেকে এ বিদ্যাপীঠে পড়তে আসা শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে দীর্ঘদিন ধরে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান বজায় রেখেছে। তাদের প্রত্যাশা, নির্বাচনকে ঘিরে ক্যাম্পাসের পরিবেশ থাকবে শান্তিপূর্ণ এবং উৎসবমুখর। জুলাই আন্দোলনে এ বিশ^বিদ্যালয়ের দুইজন শিক্ষার্থী জীবন দিয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো অনেকে।
ফ্যাসিবাদমুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশে নির্বাচনের আয়োজন চলছে। এর মধ্যে গ্রামবাসীর সাথে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে নির্বাচন প্রস্তুতিতে কিছুটা ছন্দপতন ঘটে। তবে পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক রয়েছে। নির্বাচনকে ঘিরে আর যাতে কোনো অপ্রীতিকর কিছু না ঘটে সে ব্যাপারে সতর্ক প্রশাসনসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতারা। ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর ১৯৮১ সালে প্রথমবারের মতো চাকসুতে পূর্ণ প্যানেলে বিজয়ী হয় ছাত্রশিবির। আর এ কারণেই চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় থেকে শিবিরের উত্থান ঘটেছে বলে বলা হয়। ওই নির্বাচনের পর বিশ^বিদ্যালয়ে শিবিরের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৬ সালে তৎকালীন জাতীয় ছাত্রসমাজের কুখ্যাত হামিদ বাহিনীর প্রধান আবদুল হামিদের কবজি কর্তনের মধ্যদিয়ে ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসীদের মূলোৎপাটন করে ছাত্রশিবির। শিবিরের ওই ভ‚মিকায় তৎকালীন বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা স্বস্তি প্রকাশ করলেও সারাদেশে শিবিরের ভয়ঙ্কর রূপ প্রকাশ পায়। এরপর ১৯৯০ সালের সর্বশেষ চাকসু নির্বাচন ছাত্রশিবিরের মোকাবেলায় ছাত্রদল, ছাত্রলীগ, বাম ছাত্রসংগঠনসহ সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের প্যানেল দেওয়া হয়। ওই নির্বাচনে এফ রহমান হল ছাড়া চাকসুর সবকয়টি পদে ছাত্রশিবির পরাজিত হয়। তারা এ পরাজয় মেনে নিলেও তৎকালীন ভিসি প্রফেসর আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে লাগাতার আন্দোলনের মাধ্যমে দীর্ঘ এক বছর বিশ^বিদ্যালয় অচল করে রাখে।
ফলে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের নির্বাচিত চাকসুর নেতারা কোনো কর্মকাÐই পরিচালনা করতে পারেননি। এবারের নির্বাচনে এসব বিষয় ঘুরেফিরে আলোচনায় আসছে। ছাত্রশিবির চবি ক্যাম্পাসে তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে ছাত্রলীগ, ছাত্রদলসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে রক্তাক্ত সংঘাতে জড়িয়েছে। এতে ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা যেমন জীবন দিয়েছে তেমনি ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের কর্মীরাও খুন হয়েছে। তবে ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে ক্যাম্পাসে কোনো তৎপরতা চালাতে পারেনি ছাত্রশিবির। ছাত্রলীগের হাতে তাদের কয়েকজন কর্মী খুন হন। বাধ্য হয়ে গোপনেই তারা সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। ছাত্রদল সবসময় ক্যাম্পাসে সক্রিয় ছিল। আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসনামলে ছাত্রদলও ক্যাম্পাসে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে পারেনি। তবে ক্যাম্পাসের বাহিরে এবং চট্টগ্রাম শহরে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে রাজপথে সোচ্চার ছিলেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। বিশেষ করে জুলাই আন্দোলনে তাদের ভ‚মিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। জুলাই আন্দোলনে যারা সামনের কাতারে ছিলেন ছাত্রদল এবার তাদের নির্বাচনে প্রার্থী করছেন বলে জানা গেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সামনের কাতারে থাকা নেতারাও আলাদা প্যানেলে নির্বাচন করছেন।
এদিকে গতকাল মনোনয়নপত্র বিতরণের প্রথম দিন শেষে বিকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনির উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, চাকসু নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যথেষ্ঠ উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে। প্রথমদিন তাদের আশাতীত ফরম বিক্রি হয়েছে। আমরা ভালো একটা নির্বাচনী আমেজ দেখতে পাচ্ছি। তিনি বলেন, চাকসু নির্বাচনে ২৬টি পদে এবং হলের ১৫টি পদে প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে পারবেন। এ মনোয়নপত্র বিতরণ ও জমাদন চলবে বুধবার বিকাল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত। বিভিন্ন সময়ে চাকসু নির্বাচন নিয়ে কথা উঠেলেও ভোটের আয়োজন হয়নি। দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গত ২৮ অগাস্ট চাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়।
এর আগে চাকসুর সবশেষ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রæয়ারি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ১৪টি হল ও একটি হোস্টেল রয়েছে। যার মধ্যে পাঁচটি ছাত্রীদের এবং ১০টি ছাত্রদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৯টি বিভাগ ও পাঁচটি ইনস্টিটিউটের ২৭ হাজার ৬৩৪ শিক্ষার্থীর তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে চাকসু নির্বাচনের ওয়েবসাইটে। তবে সেখানে হল ভিত্তিক তালিকা এখনও প্রকাশ করা হয়নি। এ শিক্ষার্থীরা নির্বাচনে ভোট দিয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থী নির্বাচিত করবেন।
ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, ১৮ সেপ্টেম্বর মনোনয়পত্র বিতরণ ও জমাদান শেষে ২১ সেপ্টেম্বর প্রার্থীদের প্রাথমিক তালিকা এবং ২৫ সেপ্টেম্বর চ‚ড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে। এর আগে ২৩ সেপ্টেম্বর মনোনয়ন সংগ্রহ করা শিক্ষার্থীরা তাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে পারবেন এবং পরদিন প্রার্থীতা নিয়ে আপত্তি গ্রহণ নিষ্পত্তি হবে। ১২ অক্টোবর সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ হবে। ডাকসুর মতো ওএমআর পদ্ধতিতেই ভোট দেবেন শিক্ষার্থীরা। ভোটচলাকালে প্রার্থীরা ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনে যেতে পারবেন না। তবে তাদের পোলিং এজেন্টরা ভোটকেন্দ্রে থাকবেন।
চাকসু নির্বাচনের আচরণবিধিতে ২৫ সেপ্টেম্বর চ‚ড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করার পর নির্বাচনের ২৪ ঘণ্টা আগ পর্যন্ত প্রচার চালানো যাবে। সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টার মধ্যে প্রচার চালানোর কথা বলা হয়েছে। এবারের নির্বাচনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের বাইরেও এমফিল ও পিএইচডির শিক্ষার্থীরাও নির্বাচনের প্রার্থী হতে পারবেন। তবে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার সময় সব প্রার্থীকে ডোপ টেস্টের (মাদক পরীক্ষা) ফলাফল জমা দিতে হবে। নির্দিষ্ট ফি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে এ পরীক্ষা করাতে হবে। প্রার্থী পাঁচজনের বেশি সমর্থক নিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেয়া কিংবা নিতে আসতে পারবেন না।
১৯৮১ সালে ভিপি পদে জসীম উদ্দিন সরকার ও জিএস পদে আব্দুল গাফফারসহ ছাত্রশিবিরের পূর্ণ প্যানেল জয়ী হয়। এরপর ১৯৯০ সালের সর্বশেষ নির্বাচনে তৎকালীন জাতীয় ছাত্রলীগের নেতা নাজিম উদ্দিন (ভিপি), আজিম উদ্দিন (জিএস) ও ছাত্রদলের মাহবুবের রহমান শামীম (এজিএস) নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের নেতা ফারুকুজ্জামান নিহত হলে চাকসুর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়।