‘আপনার ক্যানসার’, শোনার পর হতভম্ব না হয়ে উপায় কী। ভয়, অনিশ্চয়তা, বিষণ্নতা—সব ধরনের নেতিবাচকতা একসঙ্গে চেপে ধরে। তবে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালে রোগের সঙ্গে লড়াইটা অনেক সহজ হয়ে যায়। ২০১৫ সালে রক্তের ক্যানসারে (অ্যাকিউট মায়েলয়েড লিউকেমিয়া) আক্রান্ত হয়েছিলেন লতিফুল হক। ১০ বছর পর বিশ্ব ক্যানসার দিবসে নিজের গল্প নিজেই লিখেছেন। জানিয়েছেন ইতিবাচকভাবে রোগের সঙ্গে লড়াইয়ের গল্প।
‘রোগী তাহলে কে?’ চিকিৎসক প্রশ্নটা করে কলম হাতে নিলেন। ব্যবস্থাপত্র লিখবেন। তাঁকে হতবাক করে দিয়ে যখন বললাম রোগী আমি নিজেই। তাঁর কলম থেমে গেল। অনেকক্ষণ কথা বলতে পারলেন না, এরপর ম্লান হাসলেন। বোনম্যারো টেস্টের রিপোর্ট দেখাতে গিয়েছিলাম। চিকিৎসক একবার চোখ বুলিয়ে যা বললেন তাঁর সারকথা এই, এ বড় ভয়ংকর রোগ, খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। পারলে আজই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। খুব বেশি আশা দিলেন না। তিনি ভেবে নিয়েছিলেন রোগী বয়স্ক কেউ। তাই যখন বললাম আমি নিজেই রোগী, বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। তা ছাড়া এর আগে কোনো রোগী নাকি একা রিপোর্ট দেখাতে আসেনি। বাঙালি যা–ই করে রেকর্ড হয়, আমিও করলাম; কঠিন সময়েও এ কথা মনে করে হাসিই পেল। চিকিৎসকের অবিশ্বাসমাখা মুখ পেছন ফেলে যখন বাইরে এলাম, বুঝিনি সামনে আরও কত কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। তবে এটা বুঝেছিলাম, এখন থেকে জীবন হয়তো পুরোপুরি বদলে গেল।
মারতেও হবে, উইকেটও হারানো যাবে না
ওয়ান ডাউনে ব্যাটিং করতাম, বেশির ভাগ দিনেই প্রথম ওভারেই ব্যাটিংয়ে নামতে হতো। নামতে নামতে পেছন থেকে শুনতাম অধিনায়কের সেই অমর বাণী, ‘এক উইকেট গেছে গা, টিকা থাক, ব্যাট তুলিস না। খেলা কিন্তু মাত্র ২০ ওভারের, প্রচুর রান লাগবে।’ ঘটনা স্কুলজীবনের। মারতেও হবে, আবার উইকেটও হারানো যাবে না—এমন আশ্চর্য সায়েন্স তখন বুঝিনি। চিকিৎসকের চেম্বার থেকে বেরিয়ে সিএনজিতে ওঠার পর প্রথমে আমার সেই ক্যাপ্টেনের কথাই মনে হলো!
আমার এক আশ্চর্য ‘গুণ’, কোনো কিছু সিরিয়াসভাবে না নেওয়া। এ জন্য জীবনে কত কী হারিয়েছি! তবে ক্যানসার ধরা পড়ার পর এটা হিতে বিপরীত হয়ে ফিরে এল। বাসায় ফিরে সারা রাত ঘুম হলো না, আমি আর নাসরিন (স্ত্রী) দুজনেই জেগে থাকলাম। সকাল হওয়ার পর প্রথমে মনে হলো, রান্না করতে হবে। বাজারও নেই। অফিসেও যেতে হবে। ঢাকায় আমাদের আত্মীয়স্বজন কেউ থাকে না। বিয়ের তখন দুই বছর, ছোট্ট দুই কামরার বাসায় দুজন থাকি। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে দ্রুতই বুঝে গেলাম, কোমর বেঁধে নামতে হবে। আমাদের রান্নাও করতে হবে, বাজারও করতে হবে, চিকিৎসার প্রস্তুতি নিতে হবে, টাকাও জোগাড় করতে হবে। মাঝেমধ্যে সময় সুযোগ পেলে কান্নাকাটি করব, তবে ‘সব শেষ’ বলে মূর্ছা গেলে চলবে না। প্রথম দিনের পর আর এক দিনও নির্ঘুম রাত কাটেনি, মন খারাপ লেগেছে কিন্তু বিষণ্নতা পেয়ে বসেনি। ক্যানসার ধরা পড়ার পরদিন অফিসে গিয়ে কাউকে বলিনি। দেখলাম, আগে কাজটাজ শেষ করি। না হলে সবারই কাজের বারোটা বাজবে। বিকেলের দিকে মনে হলো, এমন একটা খবর চেপে রেখেও যে দিনের কাজ করে যাচ্ছি, উইকেট ধরে রেখে মেরে খেলার বিজ্ঞান বোধ হয় বুঝে গেছি। নিজেই নিজের মোটিভেশনাল স্পিকারও বনে গেছি। পরে বুঝেছি, প্রথম দিন ভেঙে না পড়ে নিয়মিত সব কাজ করে যাওয়ার স্মৃতি চিকিৎসার পুরোটা সময় আমাকে মানসিক শক্তি জুগিয়ে ছিল।
প্রিয় বন্ধুরা
অফিস থেকে ফিরে রাতেই কাছের সব বন্ধুকে জানাই, ওরা জানায় ফেসবুকে। এরপর বন্ধু, অফিসের সহকর্মী থেকে সবাই যেভাবে মানসিক, আর্থিক থেকে শুরু করে সব রকমের সাহায্য করেছিল, সেটা এখনো অবিশ্বাস্য মনে হয়। কেউ দিনের পর দিন অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে, কেউ সুযোগ পেলেই ছুটে এসেছে বাসায়, কেউ নিয়ম করে ঘণ্টায় ঘণ্টায় খবর নিয়েছে। সবার কথা ছিল একটাই, ‘চাপ নেই’। সবাই যখন এতটা সাহস জোগায় তখন, চাইলেও তো আর ভেঙে পড়া যায় না। পরিবার, বন্ধু, সহকর্মী থেকে আত্মীয়স্বজনের মানসিক সমর্থন সব সময় ‘চিল’ থাকার ইচ্ছাটাকে আরও উসকে দেয়।
নিজের সঙ্গে লড়াই
ঢাকার মতো মুম্বাইয়ের চিকিৎসকও আমাকে দেখে চমকে গিয়েছিলেন। ‘এমন কঠিন এক রোগ নিয়ে একা একা এত দূর এসেছ? গুড, তুমি ঠিক হয়ে যাবে।’ চিকিৎসককে বলতে পারছিলাম না, ঠিক আত্মবিশ্বাস প্রমাণ করতে এই ‘সলো ট্রিপ’-এ আসিনি। এসেছি বাধ্য হয়ে। নাসরিন তখনো ভিসা পায়নি। এদিকে পাসপোর্ট, ভিসা আর টাকাপয়সা জোগাড় করতে করতে তিন সপ্তাহ পার! ঢাকার চিকিৎসকেরা বললেন, আরও দেরি করলে গিয়ে আর লাভ হবে না। অগত্যা ভিসা পাওয়ার পরদিনই ছুট। মুম্বাইয়ের মতো কঠিন শহরে দুর্বল শরীর নিয়ে একা একা চিকিৎসক দেখাতে পারব কি না, সে চিন্তা তখন মাথায় আসেনি। পরিস্থিতি মানুষকে বেপরোয়া করে তোলে। সলো ট্রিপে অবশ্য লাভই হয়েছিল। ‘একা একা এত দূর যেহেতু আসতে পেরেছ, ঠিক হয়ে যাবে’, এটা আমার মধ্যে কোথাও একটা বিশ্বাস তৈরি করেছিল।
তবে তখনো বুঝিনি, নাসরিন মানসিক শক্তিতে আমার চেয়েও অনেক এগিয়ে। ও গ্রামে বড় হয়েছে, বিয়ের আগে ঢাকা এসেছে হাতে গোনা কয়েকবার। সেই মেয়ে একা একা মুম্বাইয়ে আসছে শুনেই আমি হতভম্ব, কিছুটা টেনশন হচ্ছিল। তবে আসার পর ‘প্লেনে কী করেছ’ জানতে চাইলে সে যে উত্তর দিল, সেটা শুনে কী প্রতিক্রিয়া দেব বুঝতে পারছিলাম না। প্লেনে উঠেই দেখে সিটের সামনের ডিসপ্লেতে সিনেমা আছে। ইমতিয়াজ আলীর ‘জব উই মেট’ দুজনেরই খুব প্রিয়। তো সে তিন ঘণ্টার মুম্বাই যাত্রায় বসে বসে সিনেমা দেখেছে! প্লেন থামার পর পাশের ভদ্রলোক নাকি ওকে আগমনের হেতু জিজ্ঞেস করেছিল। উত্তর শুনে তাঁর নাকি মূর্ছা যাওয়ার জোগাড়।
এ গল্প শোনার পর আমরা কয়েক দফা হেসেছিলাম আর বুঝেছিলাম এই হাসিই পারে লড়াইয়ের রসদ জোগাতে। ‘ক্যানসার হয়েছে, সব শেষ’ এই হাহাকারের চেয়ে হাসিঠাট্টা মন্দ কি! কাজটা নিশ্চিতভাবেই সহজ নয়, কিন্তু যে যার মতো করে চেষ্টা তো করাই যায়।
যেকোনো ক্যানসার রোগীর জন্য তাঁর সবচেয়ে কাছের সঙ্গী খুব গুরুত্বপূর্ণ। নাসরিনের এ ঘটনা আমার মধ্যেও অদ্ভুত শক্তি সংক্রমিত করেছিল। নিশ্চিতভাবে সেটা ওর ক্ষেত্রেও হয়েছিল। পরের পাঁচ মাস প্রায় নির্ঘুম রাত কাটিয়ে কোনোমতে খেয়ে না খেয়ে যেভাবে সব সামলেছে; প্রচণ্ড মানসিক শক্তি না থাকলে সেটা সম্ভব নয়।
ক্রিকেট আর বই আর টনিক
ক্যানসারের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি। পুরো সময়টাতে শারীরিক, মানসিক নানা ধরনের ওঠা–নামার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এ সময়ে নিজের প্রিয় কাজগুলো করতে পারলে অনেকটা চাঙা থাকা যায়। ক্রিকেট পছন্দ করি, ঘটনাচক্রে সে সময় বাংলাদেশের একের পর এক খেলা ছিল। টি-টোয়েন্টি এশিয়া কাপ, ভারতের মাটিতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, তাসকিনের নিষিদ্ধ হওয়া, বেঙ্গালুরুতে সেই এক রানের পরাজয়ের রুদ্ধশ্বাস দিনগুলো আমি টিভিতে দেখেছি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে। কেমোথেরাপি নেওয়ার সময় বিছানায় থাকতে হতো, নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় শরীর ছিল দুর্বল; তবু টিভিতে চোখ রাখলেই যেন সব ভুলে যেতাম। একটা অভাব ছিল, বাংলা বই। প্রিয় বড় ভাই ঢাকা থেকে সেটাও পাঠালেন। তাঁর পাঠানো একগাদা থ্রিলার সেই সময়টায় ওষুধের মতো কাজ করেছে। তবে সবচেয়ে বড় টনিক বোধ হয় ছিলেন মা। প্রথম সার্কেলের কেমোথেরাপি শেষে বোনম্যারো টেস্ট করতে দিয়েছি। এই টেস্টের ওপর নির্ভর করছে, বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে হবে কিনা। সেদিন ছিল ২৫ ডিসেম্বর। বিকেলবেলা মা এলেন। হোটেলে ব্যাগ রেখে সোজা হাসপাতালে। মা রুমে ঢোকার কয়েক মিনিটের মধ্যেই চিকিৎসক এসে হাজির। হাসতে হাসতে বললেন, তোমার রিপোর্ট ভালো, ট্রান্সপ্লান্ট লাগবে না। মায়ের আগমনে ২৫ ডিসেম্বর আক্ষরিক অর্থেই আমার বড়দিন হয়ে উঠল।
ভালো গোয়েন্দারা প্রতিপক্ষের হাতে বন্দী হলে গোস্সা করে বসে থাকে না, যখন যা মেলে গোগ্রাসে গিলে নেয়। না খেলে তো শরীর মন কিছুই চলবে না। ক্যানসারের অন্যতম চিকিৎসা কেমোথেরাপি। আর কেমোথেরাপির পর প্রিয় খাবারও বিস্বাদ লাগে। অনেকের ক্ষেত্রে রোগের চেয়েও খাবারের সঙ্গে যুদ্ধটা বেশি কঠিন মনে হয়। সৌভাগ্যক্রমে খাবার নিয়ে আমার তত সমস্যা হয়নি। খাবার নিয়ে আগে থেকেই আগ্রহ ছিল, প্রায় ৯০ ছুঁই ছুঁই ওজন সে কথার জ্বলন্ত প্রমাণও দিচ্ছিল। শুরুর দিকে কিছুটা সমস্যা হয়েছিল সেটা রুচির কারণে নয়, খাবারের কারণে। ডাল, তরকারি থেকে শুরু করে মুম্বাইয়ের সব রান্নায় কারিপাতা দেওয়া থাকে, যেটা ঠিক আমার পোষাত না। মা আসার পর সে সমস্যা ঘুচল। খাবার দেখলে বমি তো দূর, ‘মায়ের হাতের রান্না’র জন্য রীতিমতো অপেক্ষা করে থাকতাম। একেকজনের ক্ষেত্রে একেক কৌশল কাজ করে। তবে কৌশল যা–ই হোক, চিকিৎসার সময় খাওয়াদাওয়া যে ঠিকঠাক করতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।
সেই ২৫ মার্চ
চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেছিলাম ২০১৬ সালের ২৫ মার্চ রাতে। এয়ারপোর্ট থেকে গাড়িতে ফিরতে ফিরতে সোপ অপেরার শুরুর রিক্যাপের সব যেন দেখতে পাচ্ছিলাম লুকিং গ্লাসে। সৃষ্টিকর্তা, চিকিৎসক, বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে উঠছিল। ১০ বছর পর এই লেখা লিখতে পারব সেটা তখন জানতাম না, তবে উইকেট না হারিয়েও যে রান করতে পেরেছি সেই তৃপ্তি ছিল। সেটাও বা কম কী!